খোলা-মেলা বালকাময় সমুদ্র সৈকত আর স্বচ্ছ পানির বিরামহীন গর্জন নীল রঙের রাজ্যে পরিণত করেছে সেন্টমার্টিনকে। স্বচ্ছ নীলাভ পানি যখন দূর দিগন্তে আকাশের নীলে মেশে, তা যেন অন্য দুনিয়ায় নিয়ে যায় এদেশের বাসিন্দাদের। সামুদ্রিক প্রবাল, সাগরের ঢেউয়ের ছন্দ, সারি সারি নারিকেল গাছ, তীরে বাঁধা মাছ ধরার নৌকা-ট্রলার, কাঁকড়া, ঝিনুক, গাঙচিলের উপস্থিতি এই দ্বীপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই দ্বীপের স্বচ্ছ পানিতে দেখা যায় জেলি ফিশ, কচ্ছপসহ হরেক রকমের সামুদ্রিক প্রাণী।
সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এটি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণে অবস্থিত। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এটি। ৭.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং আয়তনে রয়েছ প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার। মূল দ্বীপ ছাড়াও আরও একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রয়েছে যা ‘ছেঁড়াদ্বীপ’ নামে পরিচিত। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় নারিকেল জিঞ্জিরা।
মূল দ্বীপের সঙ্গে ছেঁড়া দ্বীপের সংযোগস্থল (স্থানীয়ভাবে গলাচিপা নামে পরিচিত) সামান্য নিচু হওয়ায় জোয়ারের সময় এটি তলিয়ে যায়। তাই ভাটার সময় হেঁটে ছেঁড়া দ্বীপে যাওয়া গেলেও জোয়ারের সময় নৌকা নিয়ে যেতে হয়। সবচেয়ে ভালো হয় উত্তর প্রান্ত থেকে পশ্চিম বিচ ধরে সম্পূর্ণ পথ পায়ে হেঁটে গেলে। পথটা নির্জন তবে অসম্ভব সুন্দর। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাংলাদেশের প্রথম পাঁচটি ভ্রমণ স্থানের মধ্যে জায়গা দখল করে নিয়েছে।
সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
কখন যাবেন?
সাধারণত নভেম্বর থেকেই সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের ভিড় জমে। এসময় শীতের আমেজে আবহাওয়া একেবারে অনুকূল থাকে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা না থাকায় গরমের মৌসুমে ভ্রমণ খুবই কষ্টকর হয়। আর বর্ষা মৌসুমে ঝড়-বৃষ্টিতে উত্তাল সমুদ্রে নামার কথা ভাবাই যায়না। তাই সেন্টমার্টিন ভ্রমণের ভালো সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী।
যেভাবে যাবেন
সেন্টমার্টিন যেতে হলে প্রথমে কক্সবাজার পর্যন্ত যাবেন। ঢাকা থেকে গেলে কক্সবাজারের বাসে যেতে পারেন। বাসের ভাড়া সাধারণত ১০০০ থেকে ২৫০০ টাকার মধ্যেই হয়।
কক্সবাজার থেকে জাহাজে করে রওনা করতে হবে সেন্টমার্টিন। আগে থেকে টিকিট কাটা না থাকলে টিকিট কেটে নিতে হবে। প্রতিদিন ৬-৭টি জাহাজ চালু থাকে। এগুলোর মধ্যে কেয়ারি সিন্দাবাদ, কেয়ারি ক্রুজ অ্যান্ড ডাইন, আটলান্টিক, বে ক্রুজ, কর্ণফুলী, গ্রিন লাইন উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও এই সমুদ্র রুটে বেশ কিছু ট্রলার ও স্পিডবোট চলাচল করে। জেটি ঘাট থেকে প্রতিদিন এ সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টায় সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে জাহাজ। আবার সেন্টমার্টিন থেকে ওই জাহাজ ফিরবে বিকেল ৩টায়। একদিনের সফরে এই সময়ের মধ্যেই আপনাকে স্পটে থাকতে হবে।
যারা রাত্রিযাপন করতে চান, তারা পরের দিন একই জাহাজে ফেরার সুযোগ পাবেন। সেভাবেই টিকিট বুকিং করতে হবে। সেন্টমার্টিনে থাকার জন্য উন্নতমানের হোটেল ও কটেজ পাবেন। এছাড়া তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। নিজের সাধ্যমতো যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন। এগুলো আগে থেকে বুকিং দিন।
যে হোটেলে থাকবেন সেখানে খাবারের ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়াও বেশ কিছু হোটেল ও রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া সেরে নিতে পারবেন। বন্ধু কিংবা পরিবার মিলে বারবিকিউ করারও সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ খেতে পারবেন। তাছাড়া এই দ্বীপের ডাব অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাই ডাব খেতে ভুলবেন না।
সেন্টমার্টিন ভ্রমণে সচেতনতা
সেন্টমার্টিনের ধারণ ক্ষমতা ২ হাজার। কিন্তু সেখানে প্রতিদিন তার কয়েক গুণ পর্যটক থাকে। অতিরিক্ত পর্যটকের কারণে দ্বীপ পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে। পর্যটকদের ফেলা বর্জ্যের কারণে সাগরতীরের প্রাণ ও জীববৈচিত্র্য আশঙ্কাজনকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাগরে মাছ কমে যাচ্ছে। তাই প্লাস্টিক সেখানে নিয়ে যাবেন না। বা ফেলবেন না। পানি খাওয়ার পর পানির বোতলটি সঙ্গে করে নিয়ে আসুন।