সম্প্রতি সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াত সীমিত ও সীমাবদ্ধ করার সরকারি ঘোষণায় পর্যটক আর পর্যটন ব্যবসায়ীরা হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছেন। কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসায়ী মহল সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, সরকারের এ ব্যবস্থার ফলে প্রচুর লোক কর্মহীন হয়ে পড়বে এবং প্রচুর ব্যবসায়ী আর্থিকভাবে লোকসানে পড়বেন। এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
আমরা সবাই (সরকারি-বেসরকারি মহল) ভেবে দেখতে পারি, সেন্টমার্টিন ছাড়াও কক্সবাজারের আশেপাশে আরও নানান দিকে পর্যটনের সম্ভাবনা রয়েছে অপার। তার মধ্যে কক্সবাজার শহরের অতি নিকটেই রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বহুল পরিচিত পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী। এটি এমনই একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ দ্বীপ যা বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি দেখা পাওয়া যাবে না। দ্বীপের তিন-চতুর্থাংশ এলাকা সবুজ পাহাড়ে আবৃত এবং বনজ বৃক্ষে শোভিত। যদিও বিগত সরকারের আমলারা উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পাহাড়ের অনেক বনাঞ্চল ধ্বংস করেছে। দ্বীপের পাহাড়ি অঞ্চল বাদ দিয়ে সমতল অঞ্চলে বসবাস করে হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোক। এই দ্বীপে প্রায় সাড়ে তিন লাখ লোক বসবাস করেন। নানান জাতিগত সম্প্রদায়ের ও তাদের সংস্কৃতিগত বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য যে কোনো পর্যটককে আকৃষ্ট করে থাকবে। বিশেষ করে রাখাইন জাতির লোকেরা সুদীর্ঘকাল ধরে এ দ্বীপে বসবাস করে আসছেন, যা বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের লোকেরা জানেন না। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব পোশাক, নিজস্ব পূজা-পার্বণ ও সংস্কৃতি। তাদের রয়েছে নিজস্ব শৈল্পিক ডিজাইনের ঘরবাড়ি। আর রয়েছে দৃষ্টিনন্দন তাদের প্রাচীন বৌদ্ধমন্দির। বলাই বাহুল্য, রাখাইন জাতির লোকেরা সকলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা নারীপুরুষ সকলে কর্মট ও সৌন্দর্য চর্চায় পারঙ্গম। তাদের রয়েছে ঐতিহ্যমন্ডিত তাঁতশিল্প। রাখাইনরা মহেশখালী সদরে বসবাস করেন। তাদের পাড়ার সাথেই রয়েছে নানান প্রকার তাঁতের তৈরি কাপড়ের ও মনোহারী পন্যের দোকান। তারা সোনার অলংকার তৈরিতেও পারদর্শী এবং রয়েছে সোনার অলংকারের দোকান ও ব্যবসা।
মহেশখালীতে রয়েছে হিন্দু-মুসলমানের পাশাপাশি বসবাসের সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্য। হিন্দু-মুসলিম জনগণের মধ্যে রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য, হালচাষ ও সম্প্রীতির দারুণ সম্পর্ক। মহেশখালী সদরে অবস্থিত মহেশখালী চ্যানেলের গা ঘেঁষে, সুইচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে সুপ্রাচীন ও বহুল পরিচিত আদিনাথ মন্দির । তাতে প্রতি বছর ফাগুন মাসে শিবচতুর্দশী মেলা বসে সপ্তাহব্যাপী। তাতে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সকলের আগমন ঘটে।
মহেশখালী দ্বীপে বাইরের পর্যটকদের আরও আকর্ষণের বিষয় রয়েছে বিখ্যাত মিষ্টি পানের চাষ, যাকে পানের বরজ বলা হয়ে থাকে। দ্বীপের অর্ধেকাংশের বেশি কৃষিজীবী জনগণ এই পানচাষের সাথে জড়িত। পানচাষ একটি লাভজনক কৃষির অংশ। এটি সারা দেশে এবং বিশ্বের অনেক দেশে একটি রপ্তানিযোগ্য পণ্য। এই পানকে ঘিরে এককালে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় শিল্পী শেফালী ঘোষের কণ্ঠে গাওয়া গান ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, মহেশখালীর পানের খিলি বানাই খাওয়াইতাম’। শহরের লোকেরা বা অন্য অনেক অঞ্চলের অধিকাংশ লোকেরা পান খেতে পছন্দ করেন, পানকে ভালোবাসেন। এই পান বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। কিন্তু বহিরাগত পর্যটকেরা অনেকে পানের চাষের বরজ দেখেননি। পর্যটকেরা সকলে এই দ্বীপে ভ্রমণে এলে জনপ্রিয় পানের চাষের বরজকে স্বচক্ষে পরিদর্শন করতে পারবেন।
অনেকেই জানেন, মহেশখালী দ্বীপটি লবণ উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রও বটে। মহেশখালী দ্বীপের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চল জুড়ে দীর্ঘ এলাকা লবণচাষের এলাকা হিসেবে পরিচিত। পর্যটকেরা দ্বীপ ভ্রমণে এলে নিজ চোখে লবণচাষের মাঠ পরিদর্শনের সুযোগ পাবেন। মহেশখালীর অভ্যন্তরে সড়কপথ উন্নত থাকায় দ্বীপের দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাতায়াত করতে চাইলে, এমন কি পাহাড়ের অভ্যন্তরে ভ্রমণ করতে চাইলেও অনায়াসে সড়কপথে তা করতে পারেন। মহেশখালী ভ্রমণের একটা বিশেষ সুবিধা হলো সারাদিন ভ্রমণ শেষে সহজে মহেশখালী থেকে কক্সবাজার ফিরে আসতে পারে যদি যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো উন্নত করা যায়।
কিন্তু বর্তমানে যোগাযোগের দুর্গম বাধা ও অতিরিক্ত ভাড়া মহেশখালী দ্বীপে যাতায়াত কষ্টকর হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। কারণ, কক্সবাজার থেকে মহেশখালী যেতে একটা সংক্ষিপ্ত সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে হয়, যার নাম মহেশখালী-কক্সবাজার ফেরিঘাট। এই ঘাটটি পাকিস্থান আমলে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাত্তোর কিছুকাল বিআইডব্লিউটিএর অধীনে পরিচালিত হয়েছিল। এরপর কোনো একসময় এই ঘাটটি জেলা প্রশাসন নিয়ে নেয়। এরপর থেকে উন্নত গণপরিবহনের অভাবে মহেশখালী দ্বীপবাসীর যাতায়াতের সর্বনাশের একশেষে পর্যবশিত হয়।
কক্সবাজারে নানান অঞ্চল থেকে আগত হাজার হাজার পর্যটককে মহেশখালীর মতো আকর্ষণীয় দ্বীপে টানতে চাইলে প্রথমেই প্রয়োজন মহেশখালী-কক্সবাজার ফেরিঘাটকে সম্পূর্ণ বিআইডব্লিউটিএর অধীনে পরিচালনা করা। তাছাড়া দ্বীপবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি মহেশখালী-কক্সবাজার ফেরিঘাটে বিআইডব্লিউটিএর গণপরিবহন সার্ভিসের। যাতে শতশত যাত্রী একসাথে গণপরিবহনের মাধ্যমে কম ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারেন। মহেশখালী দ্বীপ তার বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের গুণেই ভ্রমণকারী পর্যটকদের সেন্টমার্টিনের চেয়েও বহুগুণেই আকৃষ্ট করার মতো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। শুধু প্রয়োজন পর্যটন বিভাগের প্রচার ও সরকারি উদ্যোগে স্থানীয় ইজারাদারের অকমর্ণ ও অকজো পরিবহণ ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়ে বিআইডব্লিউটিএর গণপরিবহন সার্ভিস চালু করা।
মহেশখালী দ্বীপের পাশেই রয়েছে সোনাদিয়া দ্বীপের আকর্ষণ। উল্লেখ্য, সোনাদিয়া দ্বীপটি মহেশখালী উপজেলার অংশ। অতএব হাজারহাজার ভ্রমণকারীদের ভ্রমণের তেষ্টা মেটাতে মহেশখালী দ্বীপে দৃষ্টি ফেরানোর এখনই সময়। এর ফলে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ রক্ষার সরকারি কর্মসূচি বাস্তবায়নের সুফল বয়ে আনবে বলে আশা করি।