পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ উত্তরাঞ্চলের বগুড়ায় গাবতলী উপজেলার দুর্গাহাটার সাইরপাড়ায় ২০২০ সালে হঠাৎ করেই বাঁশঝাড় ও জঙ্গলে ঘেরা প্রাচীন মসজিদের সন্ধান মেলে। আনুমানিক চার থেকে পাঁচশ বছরের পুরোনো সেই মসজিদ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর প্রতিদিন শত শত মানুষ দেখতে ভিড় করেন।
একইভাবে ২০২২ সালে বগুড়ার কাহালু উপজেলার বোরতা গ্রামে বটগাছ ঘের আরেক প্রাচীন মসজিদের সন্ধান পাওয়া যায়। স্থানীয়দের দাবি, মসজিদটি ৫০০ থেকে এক হাজার বছরের প্রাচীন। যা দেখতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন হাজারো মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাচীন এসব স্থাপনা ঘিরে মানুষের যে সীমাহীন কৌতুহল সেটাই হয়ে উঠতে পারে পর্যটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে, শীত মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ায় দেশের সর্ববৃহৎ চলনবিলের হাজার হাজার একরে চাষ হয় সরিষার। দিগন্ত জোড়া সরিষার ফুলের সৌন্দর্যের মোহে এসব এলাকায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ বেড়াতে যান। উদ্যোক্তারা বলছেন, চলনবিলের এই সৌন্দর্য ঘিরে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। নিরাপত্তাসহ সুপরিকল্পিত পদক্ষেপে চলনবিল পর্যটনের বড় খাত হয়ে উঠতে পারে।
শুধু উত্তরাঞ্চলই নয়, এভাবে সারা দেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে স্থানীয়ভাবে পরিচিত. জনপ্রিয় ও অপ্রচলিত হাজার হাজার পর্যটন স্পট। যা সরকারের পর্যটন মহাপরিকল্পনার অংশ হয়ে উঠতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটনের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকার ইতোমধ্যে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারসহ সারা দেশে ইতোমধ্যে সহস্রাধিক পর্যটন স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্পটে পর্যটক আকর্ষণে নানা উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।
তবে চিহ্নিত ও পরিকল্পনাধীন এসব স্পটের বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত হাজার হাজার অপ্রচলিত স্পট থেকে গেছে সরকারের মহাপরিকল্পনার বাইরে। বিভিন্ন জাতীয় উৎসব ও বিশেষ দিনগুলোতে যেসব স্পটে ভিড় করেন স্থানীয় শত শত পর্যটক। অনাবিষ্কৃত বা সদ্য আবিষ্কৃত এসব স্পট পর্যটন খাতে বড় সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে।
পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবন-জীবিকার টানে নগর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত পল্লী পর্যন্ত দিন দিন মানুষের জীবন জটিল ও সঙ্কটময় হয়ে উঠছে। প্রতিনিয়ত হাঁফিয়ে উঠছে সব শ্রেণীপেশার মানুষ। যে কারণে একটুখানি অবসর পেলেই মনের প্রশান্তি, স্বস্তি আর একটু বিনোদনের জন্য সাধ্য অনুযায়ী তারা ছুটে যান মনোরম বা দৃষ্টিকাড়া কোনো স্থানে। এভাবে সব পর্যায়ের মানুষের মধ্যেই ভ্রমণ বা পর্যটনের প্রতি আগ্রহ বেড়েই চলেছে।
পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সব মানুষের মধ্যেই বেড়েছে ভ্রমণ প্রবণতা। হাতে কিছুটা অর্থ জমলেই তারা বেরিয়ে পড়ছেন বেড়াতে। হোক সেটা বাড়ির কাছের কোনো খোলামেলা স্থান কিংবা আশপাশের দৃষ্টিকাড়া স্পট। আর ভ্রমণপ্রেমী মানুষের চাহিদার কারণেই মফস্বল শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলেও অনেক স্থান পর্যটন স্পট হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। যেসব স্পটের গুরুত্ব উঠে আসছে না পর্যটন খাতের ব্যবসায়ী বা সরকারের বিবেচনায়।
ট্যুর অপারেটররা বলছেন, পর্যটন বিভাগের চিহ্নিত ১০৫০টি সুনির্দিষ্ট স্পটের বাইরেও সারা দেশে হাজার হাজার স্বল্প পরিচিত ও অপ্রচলিত স্পট রয়েছে। যা অপার সম্ভাবনা হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, বিদেশি পর্যটকেরা ভিড়ে ঠাসা স্পটগুলো এড়িয়ে চলেন। বরং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষ ও তাদের জীবনযাপন পদ্ধতিই তাদের বেশি আকৃষ্ট করে।
পর্যটন উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই তো বটেই, এ দেশের মানুষ, সংস্কৃতি, গ্রামীণ জীবন বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের মূল কেন্দ্র। যা ছড়িয়ে আছে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। পর্যটন দিবসসহ নানা উপলক্ষ্যে প্রতি বছর বিভাগ, জেলা, উপজেলায় যেসব পর্যটন মেলার আয়োজন হচ্ছে। জেলায় জেলায় ছড়িয়ে থাকা নানান দর্শনীয়, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের বিবরণসহ ভ্রমণ সুযোগ-সুবিধাও তুলে ধরায় এসব স্পটের ব্র্যান্ডিং তথা পরিচিতি বাড়ছে। যা পর্যটন উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে।
তবে পরিচিত ও জনপ্রিয় স্পটগুলোর বাইরেও যে সারা দেশের প্রত্যন্ত পল্লী ও পাড়াগাঁয়ে যে হাজার হাজার স্বল্প পরিচিত স্পট রয়েছে পর্যটন মেলায় সেসব উঠে আসছে না। ফলে সেগুলো থেকে গেছে মহাপরিকল্পনার বাইরে। অথচ সঠিক পদক্ষপে ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে এসব স্পট হয়ে উঠতে পারে পর্যটন খাত সম্প্রসারণের বড় উপকরণ।
ট্যুরিজম বোর্ডের হিসাবে, দেশে পরিচিত ও জনপ্রিয় প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যটন স্পট আছে ১৪০০টি। এসব স্পট ঘিরে সহস্রাধিক উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। পর্যটন খাতের নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে আগ্রহ ও বিনিয়োগ দুটোই বাড়ছে। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এক একটি হোটেল ও মোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে।
পর্যটন বিভাগের তথ্যমতে, দেশে মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়ে যাওয়ার কারণে পর্যটনে আগ্রহ বেড়েছে। এক হিসাবে দেশের অভ্যন্তরেই ভ্রমণ করেন ৯০ থেকে ৯৫ লাখ পর্যটক। এসব পর্যটকের সিংহভাগ দেশীয়, তবে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা মাত্র ২ শতাংশ। হিসাব মতে, গত বছরে ঈদ কেন্দ্রিক দেশীয় পর্যটন শিল্পে আয় ছিল এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরে তা বেড়ে দুই হাজার কোটিতে পৌছতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে এসব হিসাব-নিকাশের পরেও পর্যটন মহাপরিকল্পনায় বিবেচিত হয়নি প্রত্যন্ত পল্লীর পর্যটন স্পটগুলো। কোনো পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে না। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যটনকে বিকেন্দ্রীকরণ করলে আরও আয় বাড়বে। একই সঙ্গে বিদেশি পর্যটক বাড়াতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যটনকে গুরুত্ব দিতে হবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আব্দুল সালাম আরেফ খান বলেন, বড় পর্যটনস্পটগুলোর পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ পর্যটনের সম্ভাবন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তাই পর্যটনের পরিকল্পনায় অভ্যন্তরীণ পর্যটনকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি রফেউজ্জামান বলেন, অনেক বেদেশি পর্যটক এসে গ্রামে অবস্থান করেন আমাদের গ্রামীণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে। অথচ এসব জায়গায় যাতায়াত ও অবকাঠামো ভালো নয়। তিনি মনে করেন, পর্যটনকে বিকেন্দ্রীকরণ করলে বড় স্পটগুলোর ওপর চাপ কমবে।