• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

একটি মায়াময় সবুজ উপত্যকার গল্প


অনুরণন সিফাত
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩, ১০:৫২ এএম
একটি মায়াময় সবুজ উপত্যকার গল্প

গত বছর আগস্টের কথা। আমরা রওনা করলাম মেঘালয়ের দিকে। উদ্দেশ্য ঝরনা দেখা আর মেঘের রাজ্যে ঘুরে আসা। কিন্তু সত্যি বলতে কি, মেঘালয়ের চেয়ে বেশি টানছিল আমাকে নাগাল্যান্ড। এখানে একটা সিনেমার কথা উল্লেখ করাটা জরুরি। ২০১৩ সালের একটি মালায়ালাম সিনেমা- Neelakasham Pachakadal Chuvanna Bhoomi (Blue Skies, Green Water, Red Earth), মূলত রোড অ্যাডভেঞ্চার ঘরানার সিনেমা। যারা ঘুরতে পছন্দ করেন তাদের জন্য দেখা তো মোটামুটি ফরজ বলা যাবে। সিনেমার গল্পে বেশি যাব না। নায়িকাকে খুঁজতে খুঁজতে নায়ক নাগাল্যান্ডের গ্রামে চলে আসেন মোটরবাইকে চেপে। 

ভারতের অনেকগুলো রাজ্যকে এখানে ভিন্ন ভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আমার নাগাল্যান্ডের প্রথম পাঠ এই সিনেমাতেই। তাই ট্যুরপ্ল্যানে নাগাল্যান্ড দেখামাত্র কনফার্ম করতে আর দেরি করিনি। আমাদের আজকের গল্পের উপত্যকা–জ্যুকো ভ্যালি, এটা ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্যের অন্তর্গত। 

জ্যুকো (Dzukou) শব্দের অর্থ হিমশীতল পানি। নাগাল্যান্ডের দুটি আদিবাসী ভাষা আংগামী ও মাও। দুটি ভাষাতেই জ্যুকো মানে শীতল পানি। উপত্যকার নিচের দিকে ঠান্ডা পানির ছোট্ট দুটি নদী বয়ে গেছে। কিংবা খালও বলা যাবে। জ্যুকো ও জাপফু নামে এ দুটি ঠান্ডা পানির নদী উপত্যকার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে এর নাম জ্যুকো ভ্যালি রাখা হয়েছে, এমনটাই প্রচলিত আছে। 

তবে এর নামকরণ নিয়ে মতভেদও আছে। অনেকের মতে, জ্যুকো শব্দটি এসেছে উপভাষা ভিশেমা থেকে। যার অর্থ প্রাণহীন বা নিরস। নাগাল্যান্ডের আদিবাসী ভিশেমাদের পূর্বপুরুষরা নতুন বসতি গড়ার জন্য জ্যুকোতে পাড়ি জমিয়েছিল। কিন্তু শীতল আবহাওয়া এবং জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হওয়ায় তারা এই উপত্যকার নাম দেন জ্যুকো বা প্রাণহীন। কথিত আছে, একসময় এই ভ্যালিতে তুষার-মানবের দেখা মিলত। তবে পৌরাণিক গল্পে এখানে আদি মানুষ বসবাসের উল্লেখ আছে। নাম নিয়ে যেমন মতভেদ রয়েছে, বিরোধ রয়েছে জ্যুকোর মালিকানা নিয়েও। 

ভারতের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই ভ্যালি একই সঙ্গে নাগাল্যান্ড এবং মণিপুর রাজ্যের অন্তর্গত। তাই সীমান্ত এর ভাগাভাগি নিয়ে দুই রাজ্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। মণিপুর সীমান্ত দিয়ে জ্যুকোতে ভ্রমন একটু কষ্টসাধ্যই। তাই নাগাল্যান্ড দিয়ে জ্যুকোতে ভ্রমণ করেন বেশির ভাগ পর্যটক। ভিশেমা (Viswema) ও জাখামা (Zakhama) এই দুটি পয়েন্ট দিয়েই জ্যুকো ভ্যালিতে যাওয়া যাবে। তবে জাখামার রাস্তা অপেক্ষাকৃত কঠিন এবং খাড়া হওয়ায়, ভিশেমা পয়েন্ট বেছে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। 

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে জ্যুকো ভ্যালির উচ্চতা ২৪৫২ মিটার বা ৮৩০০ ফিট। তবে যতই প্রাণহীন বলা হোক না কেন, জ্যুকো ভ্যালি আসলে একটি সবুজ স্বর্গ। নিস্তব্ধতা আর নীরবতা যাদের প্রিয়, তাদের জন্য জ্যুকো অবশ্যই স্বর্গরাজ্য। জুন-জুলাই মাসে ফুলে ফুলে ভরে উঠে বলে অনেকের ভাষায় এটি-ভ্যালি অব ফ্লাওয়ারস।

জ্যুকো লিলি (Lilium Chitrangadae) নামে এক প্রজাতির লিলি আছে, যেটি শুধু জ্যুকো ভ্যালিতেই দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া এখানে দেখা মিলবে ‘ব্লিথস ট্রাপোগান‘ নামের পাখি যেটি স্বীকৃতি পেয়েছে নাগাল্যান্ডের প্রাদেশিক পাখি হিসেবে। বরং জ্যুকোকে বলা যাবে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর সবুজ উপত্যকা। যেখানে সারি সারি পাহাড় সারি, নীল আকাশের মেঘের ভেলা, বাহারি ফুল, শতবর্ষ পুরোনো গাছ, আর বিভিন্ন উদ্ভিদ আর প্রাণিকুলের সমাহার। এত প্রাণ ধরে রাখবে বলেই হয়তো প্রকৃতি এখানে জনপদ গড়ে উঠতে দিতে চায়নি। 

এবার মূল গল্পে ফেরা যাক। ডাউকি বর্ডার হয়ে আমরা মেঘালয়ে আসি। এরপর এক দিন চেরাপুঞ্জি আর একদিন শিলং ঘুরে ট্যাক্সিতে চলে গেলাম সোজা আসামের রাজধানী গোহাটিতে। নাগাল্যান্ড যাওয়ার জন্য আমরা বেছে নিয়েছিলাম রেলগাড়িকে। গোহাটি থেকে লোকাল ট্রেনে চেপে নাগাল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা করি রাত সাড়ে দশটায়। গন্তব্য ডিমাপুর রেলস্টেশন। 

আগে থেকে টিকিট কাটা হয়নি বলে লোকাল ট্রেনে চেপে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো গতি ছিল না। রীতিমতো হুড়োহুড়ি করে সিট ধরে, ঝগড়াঝাটি করে, দাঁড়িয়ে-বসে আমরা সাতজন চললাম নাগাল্যান্ড। কেউ কেউ আবার ঠায় নিল লাগেজ রাখার স্ট্যান্ডে। বেশ কবছর ধরে নাগাল্যান্ড প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তাই মনের মধ্যে একটু শঙ্কাও ছিল, নাগাল্যান্ড প্রবেশের অনুমতি মিলবে তো! সব শঙ্কা পার করে ভোর হলো। 

সকাল সাতটা নাগাদ ডিমাপুর স্টেশনে থামলো ট্রেন। রেস্টরুম খুঁজে বের করা হলো। কেউ লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, কেউ বসে আছে। আমরাও বসে পড়লাম। আটটার পর গিয়ে পার্শ্ববর্তী ডিমাপুর পুলিশ স্টেশনে নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে অনুমতি নিতে হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা। এর মধ্যে রেলস্টেশনের গোসলখানা খুঁজে বের করলাম আমরা। চড়ুইছানার গোসল করে একটু থিতু হওয়া গেল। ততক্ষণে পারমিশন নেওয়ার কাজ শেষ করে নিয়েছে টিমের দুজন সদস্য। 

ট্যুর শুরুর সময় থেকেই আমার একটু টেনশন হচ্ছিল ট্রেইলের কী অবস্থা, সে কথা ভেবে। একে তো বহুদিন ট্রেক করা হয়নি। তার ওপরে নিজের বাড়তি ওজনের অসুবিধা আছেই। আপাতত ট্যাক্সি খুঁজে বের করতে হবে কোহিমা যাওয়ার। কোহিমা নাগাল্যান্ডের রাজধানী। সেখান থেকেই প্রথমে জাখামা গ্রাম এবং পরে ভিশেমা গ্রাম। আমরা সরাসরি ভিশেমা পর্যন্ত একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম। ভিশেমা পয়েন্ট পাহাড় চড়ার জন্য তুলনামুলক সহজ। ট্যাক্সি চলতে শুরু করলো পাহাড়ি পথ বেয়ে। ডিমাপুর থেকে হালকা খাবার কিনে নিয়ে গাড়িতেই নাশতা সেরে নিলাম আমরা। সামনে পড়ে আছে প্রায় ঘণ্টা চারেকের দীর্ঘ রাস্তা। বিশাল সব পাহাড় সারি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। কিছু পাথুরে মাটিতে গড়া আবার কিছু সবুজ পাহাড়। 

জায়গায় জায়গায় পাহাড় ধস হয়েছে। মাটি সরানোর কাজ চলছে। কখনো ধুলোতে ঢেকে যাচ্ছে পথঘাট। আবার কিছু পরেই স্বচ্ছ সুন্দর আকাশ। পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। আর একটু পর পর চারটে খুঁটির ওপর ছনের একচালা ফলের দোকান। সারি সারি আনারস, কচি বাঁশ আর বিভিন্ন মৌসুমি ফলমূল। কেউ কেউ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েই ফলাহার সেরে নিচ্ছে। মাঝপথে একটা ধাবায় দাঁড়িয়ে দপুরের আহার। কেউ রুটি ভাজি নিল। আর দুজন ভেজ থালি। প্রথমেই আমাদের পাহাড়ি মরিচের ভর্তার মতোই একটা মরিচভর্তা এলো। গন্ধেই মন ভরে গেল। 

একদম খিদে বাড়িয়ে দেওয়া গন্ধ। নাগা মরিচের সুখ্যাতি আছে এখানকার। সঙ্গে আলুভাজি, পাঁপড় আর সবজি। রান্নাটা চমৎকার আমাদের চাগিয়ে ওঠা খিদের মতোই। এক থাল ভাত গপাগপ শেষ করে আবার ট্যাক্সিতে রওনা করলাম আবার। এবারে আর কোনো থামাথামি ছাড়াই ভিসমা গ্রাম। দুপুর গড়িয়ে গেছে তখন। ভিশেমা পয়েন্ট থেকে আবার এন্ট্রি পাস নিতে হলো। 

রাতে জ্যুকোতে থাকার জন্য এই পাস নেয়াটা বাধ্যতামূলক। আরো কিছুদুর গাড়ি যাওয়ার রাস্তা আছে। ছোট্ট একটা পিকআপ মতো গাড়ি পাওয়া গেলো। পেছনে টপাটপ জিনিসপত্র ভরে নিয়ে উঠে পড়লো সবাই। আমরা দুজন সামনে। ড্রাইভার বকবক করছে সমানে। কোথা থেকে এলাম। কদিন থাকবো! 

এই ফাঁকে আমি একবার হর্নবিল ফ্যাস্টিভাল এর কথা জিজ্ঞেস করে নিলাম। বললো লকডাউনের সময় থেকে দুবছর ধরে বন্ধ সমস্ত উৎসব। সাথে ওদের ব্যাবসাপাতিও। গাড়ি ঝোপঝাড় মাড়িয়ে চলছে খাড়া রাস্তা বেয়ে। পেছনের ওদের চেহারার মানচিত্র বদলে যাওয়ার কথা। চারকিলো মতো উঠে গাড়ির রাস্তা শেষ। দুয়েকটা ঘরবাড়িও চোখে পড়লো ওখানকার অধিবাসীদের। এরপর শুধু পায়েচলা রাস্তা। লোক চলাচল আছে বলে ট্রেইল অতোটা স্পষ্ট নয়। কোথাও একেবারে সরু। কখনো বা খাদের পাশ দিয়ে উঠে গেছে রাস্তা। এসমস্ত খানাখন্দ পেরিয়ে ঢুকে গেলাম একদম বনের ভেতরে। মাথার উপর শুধু সবুজ পাতার আস্তরন। জঙ্গলের মোটা ডাল ,লতা এসব মিলিয়ে একদম গা ছমছমে পরিবেশ।

পায়ের শব্দ , শুকনো পাতার মর্মর । কখনো পায়ের নীচে একটা দুটো ডাল ভাঙ্গছে মটমট করে। এই নিয়ে খাঁড়া পথ বেয়ে চলতে থাকলাম সবাই। আমি টিম থেকে বেশ খানিকটা পেছনে। ট্র্যাকিঙয়ে বেশ স্লো বলা যাবে আমাকে। ঘন্টাদুয়েকের খাড়া পেরিয়ে একটু নীল আসমান দেখা গেল। অন্ধকারের ঘন বন পেরিয়ে একটু আলোর রেখা। শেষ বিকেলের আলো। জ্যুকোর একটা ভিউ পয়েন্ট ওখানে। সবাই তখন তড়িঘড়ি ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমি বসে একটু জিরিয়ে নিলাম প্রথমে।

ঢকঢক পানি খেলাম। এর মাঝে নিজের কয়েকখানা ছবিও তুলে নিলাম। এবারের গন্তব্য ভ্যালির অন্যপ্রান্তে। চুড়া থেকে একটু ডাউনহিলের দিকে। ট্যুরিস্টদের জন্য নাগাল্যান্ড সরকার ডর্ম এর ব্যাবস্থা করে রেখেছে। রাতটা সেখানেই কাটাবো আমরা। চলতে শুরু করলাম আবার। এখন আমরা জ্যুকোর আপহিলে। আর খাড়া পাহাড় চড়ার বিষয়টি নেই। 

উপত্যাকা বেয়ে অনেকটা সমতল রাস্তা বেয়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে হেঁটে বেড়ানো। সোনালী আরাম রোদ তখন ছড়িয়ে পড়েছে উপত্যকা থেকে উপত্যকায়। থরে থরে সাজানো পাহাড় রাশি সবুজের ডালি মেলে রেখেছে। সোনালী আভায় আর পাহাডের সবুজ মিলে ঐশ্বরিক সবুজ দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে।

আমি চলা থামিয়ে অবাক চেয়ে রইলাম। এখানে আর বড় গাছপালা নেই তেমন। ছোট গুল্ম জাতীয় গাছ। বেশিরভাগই বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ। সাদা আর বেগুনী রঙের ফুলের আধিক্য বেশি। পুরো উপত্যকা যেন সবুজ মখমলের চাদর দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে কেউ। ঝিরঝিরে হালকা বাতাস শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছিলো। আমি দুলকি পায়ে এগোলাম। আশেপাশে ছোট ছোট এক প্রজাতির গাছ দেখা যাচ্ছে, যেটার পাতা বাঁশের পাতার মতো। 

আমি এর নাম দিলাম বাঁশগাছ। কয়েকটা সাদা ফুল মাথায় গুঁজে নিয়েছি কবেই। উপত্যকায় তখন সন্ধে নামছে ধীরে। আলো যাচ্ছে আঁধারের পথের পানে। একটা একটা টিলা পার করে আমি বুক ভরে দম নিতে থাকলাম। মিষ্টি গন্ধ চারপাশে, পাখিদের গুঞ্জন , অন্ধকারের গান—সবমিলিয়ে জ্যুকো উপত্যকায় একটা সবুজ সন্ধ্যে আমার মানসপটে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিলো। আঁধার এবারে একটু ঘন হয়ে আসছে। 

আর দুলকি চালে হাঁটার উপায় নেই। জোর কদমে পা চালালাম। বাকিরা তখন বেশ অনেকটাই এগিয়ে। ডর্মে পৌঁছে থাকার জায়গা এবং খাওয়ার বন্দোবস্ত করার জন্য। আকাশে চাঁদ নেই তখন। আঁধারে পথচলা মুশকিল হয়ে দাঁড়ালো। ব্যাগে টর্চ রাখা ছিলো অন্ধকারে ট্র্যাকিং এর কথা ভেবে। সেটা বের করে পথ চলতে লাগলাম। 

সামনে অনেকদূর গিয়েও কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। আমাদের পেছনেও আর কোন টিম ছিলো না সেদিন। বুঝলাম ট্রেইলে একদমই একা হয়ে পড়েছি। একটু একটু ভয় মনে দানা বাঁধতে লাগলো। মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে নাগাদের হেড হান্টিং ,আরো কতো কতো গল্প। রাস্তার পাশের বাঁশগাছ ঘন হয়ে এসেছে আরো। গায়ে লেগে হাত পা ছড়ে যাচ্ছে। এবারে আর পাত্তা দিলাম না বেশি। এগোতেই থাকলাম। পায়ের নীচের মাটি ভেজা ভেজা হয়ে আছে দেখতে পেলাম । সম্ভবত জলাধার আছে আশেপাশে। একটু পর ঝিরিঝির শব্দ কানে এলো। 

পাহাডের গা বেয়ে ক্ষীণ স্রোতধারা চুইয়ে নিচের দিকে চলে গেছে। সেটার আশেপাশে প্লাস্টিকের পানিবাহী নল দেখতে পেলাম। বুঝলাম লোকালয় কাছেই। বাঁশের ঝোপ পেরিয়ে বাক নিতেই দুজন টিমমেটের দেখা মিললো। এই জায়গাটায় দটো পথ দুদিকে চলে গেছে। রাতের ভুল পথের নেমন্তন্ন এড়াতে আমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে দুজন। বাঁ দিকের রাস্তা ধরে এগোলাম আমরা। এরপর মিনিট পাঁচেকের রাস্তা। রাতের সামিয়ানায় মাথা উচু করে আছে ডরমেটরি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সামনের উঠোনে ,বেঞ্ছিতে বসে আছে অনেকেই। বিভিন্ন জায়গা থেকেই বেশকিছু ট্রাভেলারদের সমাগম ঘটেছে। আকাশে তারার মেলা বসেছে। 

কেউ বসে আড্ডা দিচ্ছে। কেউবা তারা ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে ক্যামেরায়। আমি হাত পা মেলে বসে রইলাম খানিক। হিমশীতল বাতাস শরীর জুড়িয়ে দিলো। আশেপাশে তেমন কোন আলো নেই। প্রয়োজনমত যার যার মোবাইল বা টর্চে টুকটাক কাজ সেরে নিচ্ছে সবাই। পেছনদিকে রান্নাঘর আর ওয়াশরুম। সেদিকে একটু আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবার জন্য গনরান্না- ভাত ,ডাল, সবজি। যার যার মতো এসে খাবার সংগ্রহ করে নিবে। রাতের খাবার তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। খাবারের ডাক পড়ায় উঠতেই হলো নীরবতার কাছ থেকে। 

ডরমেটরির একটা কোণে শোবার জায়গা ধরে রাখতে হয়েছে। ভাড়া নিয়ে বিছানার চাদর আর কম্বলের ব্যবস্থা করে রেখেছিলো টিম মেম্বাররা। এটুকু ছাড়া এখানে রাত কাটানো মুশকিল। প্রথমেই কাপড় ছেড়ে স্নান করতে গিয়েই হাড় কেঁপে উঠলো কনকনে ঠান্ডা পানিতে। তবে একটু পর এটা সারাদিনের ক্লান্তির মালিশ হিসেবে কাজ করতে লাগলো। জরা কেটে একদম ফুরফুরে প্রশান্তি। একসাথে সবাই খাবার খেয়ে নিলাম। সামান্য ডাল-ভাত-সবজিই অমৃত মনে হচ্ছিলো তখন। আহার সেরে বাইরে একটু বসলাম। কিন্তু বেশিক্ষন বসা সম্ভব হলো না । প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ডরমেটরীর ভেতরে চলে যেতে হলো। 

কম্বলমুড়ি দিয়ে বসে আড্ডা দিলাম কয়েকজন। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতে লাগলো ক্লান্তিতে। ব্যাকপ্যাককে বালিশ বানিয়ে এবার শুয়ে পড়লাম । ঠান্ডার দাপাদাপিতে ছাড়া ছাড়া ঘুম হলো। আমি কখনো ভোর মিস করতে চাই না বলে, সাড়ে চারটার সময় উঠে পড়লাম। তখনো অন্ধকার কাটেনি । ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পরে বের হলাম। সামনে তখন স্নিগ্ধ ভোর। সবুজ পাহাড়ে এবার সাদা তুলির আঞ্চড়। পেজা পেজা মেঘ জমে আছে পাহাডের ভাজে ভাজে। 

আমার একটু গান গাইতে ইচ্ছে হলো । দেখলাম ঠান্ডায় গলা দিয়ে কোলা ব্যাঙের স্বর বের হচ্ছে। তাতেই বা কি! কোলাব্যাঙও তো সৃষ্টি সুখের উল্লাসে গান গায়! আমিও মনের সুখে গাইলাম খানিক। আস্তে আস্তে বের হতে লাগলো এবার সবাই। একটা দল এসেছে দিল্লী থেকে। আসাম থেকে এসেছে দুটি মেয়ে। বাঙ্গালী শুনে হাসিমুখে কথা বলতে এগিয়ে এসেছে। ওরা গতকাল বিকেলে এসেছে। বললো- ‘সময় পেলে নীচের দিকটা একবার ঘুরে আসো! ভালো লাগবে তোমার’। 

একটু দুরেই হ্যালিপ্যাড । অনেকে সেদিকে ছুটছে । আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে হলো না । আমি মেঘের সাথে জড়াজড়ি করে সেখানেই ঠায় বসে রইলাম। এই আত্মমগ্নতা কাটিয়ে ফেরার গান গাইবার সময় হলো। উঠে চট করে শাড়ি বদলে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। আগের দিন খাবার নিয়ে আসা হয়েছিলো। সকালের নাস্তা সেরেই রওনা করলাম। 

ফিরবো এবার ভিন্ন পথে। জাখামা হয়ে ওঠা কষ্টসাধ্য বলে সবাই নামার সময় এই রাস্তাটা বেছে নেয়। প্রথমে জাখামার পথের পাহাড়ের পিকটাতে যেতে হবে। আমরা চলতে শুরু করলাম গতরাতে যে পথটাকে ভয়ংকর মনে হচ্ছিলো, সকালের আলোয় সে পথটাকেই মোহনীয় মনে হচ্ছে । শিশির জমে আছে ফুলে ফুলে । শিশিরে হাত ভিজিয়ে , ফুল ছুঁয়ে যেতে যেতে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছিলো। রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে পাহাড়চূড়ার রাস্তায় উঠতে লাগলাম। যতো উপরে উঠছি মনে হচ্ছে ডুবে যাচ্ছি ফুলের সাগরে।

চারপাশে বাহারি সব ফুলের মেলা। হাঁটাপথের দুধারে ফুলেদের বিস্তার । কোন কোন গাছ মাথা পেরিয়েছে। এজন্যই হয়তো জ্যুকোকে অনেকে ভ্যালি অব ফ্লাওয়ারস’ নামেও ডাকে। আর ফুলের রাজ্যে দাঁড়িয়ে মাথায় ফুলের মুকুট পরে নিজেকে ফুলকুমারী মনে করাই যেতে পারে। 

এলিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড এর জায়গায় আমার বারবার মনে আসছিলো- সিফাত ইন দ্য জ্যুকোল্যান্ড’ । এসব ভাবতে ভাবতে পাহাড়চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। এখানে বেশ কিছ কাঠের সাইনবোর্ডে নির্দেশনা দেয়া আর কিছু সুন্দর কথামালা। ক্লান্ত ,পরিশ্রান্ত ট্রাভেলারদের এগুলো নিঃসন্দেহ উজ্জীবীত করে তোলে। নামার পালা আবার। পাথরের পর পাথর বসিয়ে সিডির মতো করে সাজানো। কিছু পাথর শেওলা জমে পিচ্ছিল। কিছু পাথরের নীচটা নড়বড়ে। বেকায়দায় পা ফসকালে ভাঙা হাত পা সমেত ফিরতে হবে এটা নিশ্চিত। 

তাই বেশ একটু সামলেই চলতে হচ্ছে। আর বাম পায়ের ইনজুরি তো আছেই। নামছি তো নামছিই। সকালের শিশির ভিজে পথটাও ভিজে আছে। টিমের একজনের লেগপুলিং হয়ে উনিও বেশ বেকায়দায়। নামতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি ঢিমেতালে আগাতে লাগলাম। এই পথে উঠতে হলে নির্ঘাত জান বের হওয়ার উপক্রম হতো। কোন গাছে ব্যাঙের ছাতা গজিয়ে গজিয়ে আছে। এই পথে নতুন প্রজাতির কিছু বুনোফুলের দেখা পেলাম। টিম থেকে পিছিয়ে পড়লাম আবারো। এ পথের গাছগুলো আরো বেশি পুরনো । একশো দেড়শো বছর তো হবেই । সুনসান পথ ঝিম ধরে আছে যেন। ঝি ঝি পোকার মতো একটানা ডেকে যাচ্ছে কোন পোকা। 

এ ছাড়া আশেপাশে আর কোন শব্দ নেই। আমি তন্ময় হয়ে শুনলাম। কেমন একটা ঘোর লেগে যাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক পর টিমের সাথে দেখা হলো। তারা একটু জিরিয়ে নিয়েছে। সাথে জলপান। আমার হাতে জল আর বিস্কুট দিয়ে ওরা আবার আগাতে লাগলো। আমায় বললো এবার একটু দ্রুত এগোতে হবে। আমি মিনিট দশেক পোকাদের আলাপন শুনে উঠলাম আবার। 

এবার পা চালালাম একটু দ্রুত। কিছুটা রাস্তা সমতল, খাড়া রাস্তা কমে এসেছে। কিন্তু আধঘন্টা পর দম নিয়ে অসুবিধা হতে লাগলো। আবার খাড়া, পিচ্ছিল পথ বেয়ে নামা। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে। এদিকে তখন পাতায় পাতায় কানাকানি শুরু হয়েছে। বাতাস শুকে মনে হলো বৃষ্টি হবে ঠিক দশমিনিট পরে মেঘের গুড়গুড় আর হতচ্ছাড়া বৃষ্টি। জোর বৃষ্টি না হলেও এ পথে হালকা বৃষ্টিও সুখকর নয় খুব একটা । আমি থামলাম না। অলরেডি অনেকটা পিছিয়ে তখন । সাইনবোর্ড বলছে সবে ৪৫০০ ফিট নেমেছি। 

তারমানে আরো আধেক পথ বাকি। এবার একটা নতুন খেলা খেলতে শুরু করলাম। গুণে গুনে ১০০ ফুটস্টেপ এরপর ৩০ সেকেন্ড বিরতি। এভাবে দেখলাম বৃষ্টি মাথায় নিয়েও বেশ ভালো এগুনো গেলো। সামনে আরেকটা ছাউনি,একচালা ছাপড়া ঘর। তবে এবার আর কাউকে পেলাম না। খুব সময় নিলাম না। চলতে শুরু করলাম আবার । তেষ্টা পেয়েছে প্রবল। কিন্তু স্টকের পানি শেষ। ফুটস্টেপ গুনছি তখনো ৯৭, ৯৮, ৯৯, ১০০…। 

আরো ৫০০ ফিট এগিয়ে কুলকুল শব্দ পেলাম। সামনেই একটা ঝরনা মনে হলো। পাশ কাটিয়ে গেলাম। দূর থেকেই দেখলাম। ওটা থেকে পানি আনতে গেলে বেশ অনেকটা সময় নষ্ট হবে। এবার বাক ঘুরে একটা ঝিরিপথে এসে পড়লাম । মনে হলো পথ ভুল করেছি! প্রথমে বসে ঘাড়ে মুখে পানি দিয়ে আজলা ভরে পানি খেলাম। এরপর আশপাশ রেকি করে একটাকে চলার পথ বলে মনে হলো। আশেপাশে কোনো ইন্ডিকেশন নেই। আমি মনস্থির করে সে পথ ধরে এগোলাম। ১০০ ফিট এগিয়েই ইন্ডকেটর পেলাম। বলছে আরো ১৫০০ ফিট। আমার হিসেবের সাথে গরমিল হলো। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আবার নতুন করে গুনতে থাকলাম। এবার নিজে নিজে কথা বলতে শুরু করেছি। সিফাত, এই তো আরো ৫০০ ফিট শেষ! ব্র্যাভো মাই গার্ল! এভাবেই পথের শেষের দিকে যাত্রা। ট্রেইলে এখন দুয়েকজন স্থানীয়দের আনাগোনা চোখে পড়ছে। 

একটা দুটো বাড়ি। ধোঁয়া উড়ছে। নিচে নেমে একটা ছাউনি। সেখানে আবার ইন্ডিকেটর চোখে পড়লো। অবশেষে ৮৩০০ ফিটের ট্রেইলের যবনিকাপাত ঘটলো। ওখানটাতে টিমের দুজনের দেখা মিললো। আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। তবে ট্রেইল শেষ হলেও আরও আধা ঘণ্টা হেঁটে, নিচের দিকে নেমে তবেই মেইনরোডের দেখা মিলেছে। গাড়িতে অপেক্ষা করছিল টিমের বাকিরা। ওরা আরও ঘণ্টাখানেক আগেই পৌঁছেছে।

গাড়ি চলতে শুরু করল। পরের গন্তব্য নাগাল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী নাগা হেরিটেজ ভিলেজ। এটার গল্প অন্য কোনদিন হবে। অসম্ভব সুন্দর একটা ভারতীয় রাজ্যের স্মৃতি নিয়ে ফিরেছিলাম নাগাল্যান্ড থেকে। তবে মনের বেশিরভাগটা জুড়ে রইলো মেঘ জড়ানো, ফুলে ফুলে ভরা একটি মায়াময় সবুজ উপত্যকা- জ্যুকোভ্যালি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও ভ্রমণপিপাসু 

Link copied!