• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আহসান মঞ্জিলে একদিন


বিশেষ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২৪, ০৫:৪৩ পিএম
আহসান মঞ্জিলে একদিন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ১৪ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা

আহসান মঞ্জিল নামটা শুনলেই নবাবদের শাসনামল চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যা বাঙালীর ইতিহাসের ধারক ও বাহক। ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জানাতে এবং জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ঐতিহাসিক স্থাপনা। আর সে কাজটি করে চলেছে আহসান মঞ্জিল। 
সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ১৪ তম ব্যাচ শিক্ষার্থীরা আহসান মঞ্জিল ভ্রমণ করেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই রচিত তাদের  এই রচনা।

চলতি বছরে ৯ সেপ্টেম্বর নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সহপাঠীদের সহ আহসান মঞ্জিল পরিদর্শন এর সুযোগ হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো নবাবদের ব্যবহার্য কিছু জিনিসপত্রই সেখানে থাকবে। কিন্তু জাদুঘরটির আদ্যোপান্ত সবকিছু পরিদর্শনের পর মনে হল, পুরো ইতিহাস যেন তুলে ধরা হয়েছে আমাদের সামনে। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। নবাবদের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের পাশাপাশি নবাবদের সাথে সংশ্লিষ্ট ইতিহাসও এখানে লিখিত নথির আকারে প্রদর্শন করা হয়েছে।

আহসান মঞ্জিলকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এটি দুইটি ভাগে বিভক্ত। যার পূর্ব পাশে গম্বুজসহ প্রধান ভবনটি রঙমহল নামে পরিচিত এবং পশ্চিম দিকে অবস্থিত কক্ষসমূহ নিয়ে গঠিত ভবনটি অন্দর মহল নামে পরিচিত, যেখানে নওয়াবদের স্ত্রীরা বাস করতেন। প্রাসাদ ভবনটি দুইটি সমান অংশে বিভক্ত, যার কেন্দ্রে একটি গোলাকার কক্ষের উপরে অষ্টকোণ আকৃতির একটি গম্বুজ রয়েছে। মূলত ১৮৮৮ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এই উঁচু গম্বুজটি পুনরায় নির্মিত হয়। প্রাসাদের পূর্ব দিকের দোতলায় বৈঠকখানা, গ্রন্থাগার, কার্ডরুম এবং তিনটি অতিথি কক্ষ রয়েছে, আর পশ্চিম দিকে রয়েছে একটি নাচঘর, হিন্দুস্থানী কক্ষ এবং কিছু আবাসিক কক্ষ। নিচতলায় পূর্ব পাশে ডাইনিং হল এবং পশ্চিম পাশে বিলিয়ার্ড কক্ষ, দরবার হল ও কোষাগার অবস্থিত। প্রাসাদের উভয় তলায় উত্তর ও দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত বারান্দা রয়েছে। পুরো প্রাসাদে ৩১টি কক্ষ রয়েছে, যার মধ্যে ২৩টি কক্ষে প্রদর্শনী উপস্থাপিত হয়েছে এবং ৯টি কক্ষ সাজানো হয়েছে মি. ফ্রীৎজ কাপ এর তোলা আলোকচিত্রের সাথে মিল রেখে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে মোট ৪০৭৭টি নিদর্শন সংগ্রহিত হয়েছে।

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পুরনো ঢাকার ইসলামপুর এলাকায় অবস্থিত আহসান মঞ্জিল ছিল নবাব পরিবারের বাসভবন এবং সদর কাচারি। এই স্থাপনার সাথে ঢাকা মহানগরের উন্নয়ন ও নানা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক ঘটনার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জমিদার শেখ এনায়েত উল্লাহ এখানে ‍‍`রংমহল‍‍` নামে একটি বিনোদন ভবন নির্মাণ করেন। পরে তার পুত্র শেখ মতিউল্লাহ এটি ফরাসি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন, যারা সেখানে বাণিজ্য কুঠি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ১৮৩০ সালে ঢাকার নওয়াব পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা খাজা আলিম উল্লাহ ফরাসিদের কাছ থেকে এই ভবনটি কিনে নিজ বাসভবন হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা স্বীকৃত ঢাকার প্রথম নওয়াব, খাজা আব্দুল গনির পিতা।

১৮৭২ সালে খাজা আব্দুল গনি এই বাড়িটিকে জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদে রূপান্তর করেন এবং তার পুত্র আহসান উল্লাহর নামে এর নামকরণ করেন আহসান মঞ্জিল। এই প্রাসাদ শুধু তার সৌন্দর্যের জন্যই নয় বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এখানেই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সভা, বিচারকার্য, সামাজিক ও রাজনৈতিক আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষত, ১৯০৬ সালে অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ আহসান মঞ্জিল থেকেই নেওয়া হয়, যা উপমহাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে পাকিস্তান আমলের শুরু পর্যন্ত প্রায় ১০০ বছর ধরে ভারতের পূর্বাঞ্চলের মুসলিমদের যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ৫ জন নেতা ছিলেন এই প্রাসাদের।

প্রাসাদের প্রতিষ্ঠাতা খাজা আলিমুল্লার সাথে ব্রিটিশদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, যে কারণে ব্রিটিশরা বাংলায় এসে ইতিহাসখ্যাত আহসান মঞ্জিলেই থাকতেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় নওয়াব আব্দুল গনি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে এই প্রাসাদেই সভা ডাকেন। এই সভায় বিশৃঙ্খলা, ডাকাতি ও সহিংসতা থেকে সাধারণ জনগণকে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আহসান মঞ্জিলের নওয়াবরা স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা করে  শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যেমন- ১৮৭৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ স্থাপনে তারা অংশ নেন। তারা আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ইংরেজি শিক্ষার চর্চা চালু করেন। নওয়াব সলিমুল্লাহ  নিজে খুব বেশি শিক্ষিত না হলেও তিনি শিক্ষার কদর করতেন। ফলস্বরূপ, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ৬০০ একর জমি দান করেন। নওয়াবরা ঢাকার সাথে অন্যান্য স্থানে যোগাযোগ স্থাপনে অগ্রগতি সাধন করেছেন। অবকাঠামোগত উন্নয়নেও তারা ছিলেন সুবিদিত।

১৮৭৪ সালে ঢাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ফিল্টার পানির কল স্থাপনের জন্য নওয়াব আব্দুল গনি নিজেই আড়াই লক্ষ টাকা ব্যয় করেন এবং ১৮৭৮ সালের ২৪ মে জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ঢাকার কমিশনার জনাব এফ. বি. পিকক কর্তৃক উক্ত পানীয় জলের কল উদ্বোধন করা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯০১ সালের পূর্বে ঢাকায় কোনো বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা ছিল না। তৎকালীন ঢাকার বাসিন্দাদের রাত্রিবেলা আলোর একমাত্র উৎস ছিল কেরোসিন চালিত প্রদীপ শিখা। সন্ধ্যা নামলেই ভূতুরে অবস্থার সৃষ্টি হত। এই পরিস্থিতিতে নগরবাসীর দুর্দশা লাঘব করার জন্য, পুরান ঢাকার সৌন্দর্যবৃদ্ধি এবং আধুনিকায়নের জন্য নওয়াব আহসানুল্লাহ ১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকা ব্যয় করে ঢাকায় প্রথম বিজলী বাতির ব্যবস্থা করেন। মাঝারি ধরণের শক্তি সম্পন্ন একটি জেনারেটর চালিয়ে ডি.সি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে আহসান মঞ্জিলসহ ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও রাস্তা আলোকিত করার ব্যবস্থা করা হয় এবং এর উদ্বোধন করেছিলেন রাজস্ব বোর্ডের সদস্য জনাব সি. বোল্টন।

চিকিৎসা ক্ষেত্রেও তাদের অবদান ছিল। নওয়াব আহসানুল্লাহর কন্যা আখতার বানু বেগম গরিবদের চিকিৎসা প্রদানের লক্ষ্যে নিজস্ব উদ্যোগে আহসানুল্লাহ মেমোরিয়াল হাসপাতাল নির্মাণ করেন। এছাড়াও এদেশের আধুনিক ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে ঢাকার নওয়াবরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তৎকালে ঢাকায় ঘোড়দৌড় এর আয়োজনে নওয়াবরা ছিলেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এছাড়াও ১৮৯৯ সালে তারা "ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব" প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকায় নাটক ও থিয়েটার চর্চায়ও নওয়াবরা ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। ১৯২০ এর দশকে তারা বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান "ঢাকা ইষ্ট বেঙ্গল সিনেমেটোগ্রাফ সোসাইটি" প্রতিষ্ঠা করেন যার সফল চলচ্চিত্র ছিল "সুকুমারী" এবং "দি লাস্ট কিস"। এই প্রাসাদেরই এক নওয়াবজাদি মেহের বানু ছিলেন একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। তার আঁকা ছবিরই শিরোনাম দিতে গিয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার বিখ্যাত কবিতা "খেয়া পারের তরী" রচনা করেন।

আহসান মঞ্জিলে কর্মরত কর্মচারীদের বয়ান থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইনের আওতায় ঢাকার নওয়াব এস্টেট সরকার গ্রহণ করে। তারপর থেকেই নওয়াবদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর অযত্ন ও অবহেলায় আহসান মঞ্জিল ধ্বংসের কবলে পড়ে। ফলস্বরূপ একসময় এই প্রাসাদ বস্তিতে পরিণত হয় বলে অনেকে মনে করেন। ১৯৭৪ সালে চরম পরিস্থিতির মুখোমুখিতে নওয়াব পরিবারের সদস্যরা এই প্রাসাদটি নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্ত সেই সময়ের সরকার এই সিদ্ধান্ত বাতিল করেন এবং এখানে জাদুঘর ও পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশ দেন।

১৯৮৫ সালের ৩ নভেম্বর প্রাসাদটিতে জাদুঘর স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আহসান মঞ্জিলের  আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন সম্পন্ন হয় এবং এই জাদুঘরটি জনসাধারনের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এখন প্রায় প্রতিনিয়তই দূর-দূরান্ত থেকে এমনকি ভিনদেশ থেকেও পর্যটকরা আসে এ এই আহসান মঞ্জিল পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে।

একজন বিদেশী পর্যটক ক্যাথি জেং এর সাথে কথা বলে জানা যায় যে, তিনি চীন থেকে বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছেন। তিনি এই আহসান মঞ্জিল সম্পর্কে জানতে পেরেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আহসান মঞ্জিলের বাহ্যিক কাঠামো তাকে এটি পরিদর্শন করার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। চীন এবং বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনার তুলনা করে তিনি বলেন,বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনা গুলোতে ব্রিটিশদের প্রভাব বেশি লক্ষ্যনীয়।

Link copied!