১৩ ইনিংসে তিন ফিফটিতে ৪২৫ রান, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) সদ্য সমাপ্ত আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান স্কোরার। রংপুরের টপ অর্ডারে আসর জুড়েই ভরসার নাম হয়েছিলেন তিনি। এতক্ষণে বোধহয় বুঝে গিয়েছেন কার কথা বলছি। হ্যাঁ, বলছি রংপুর রাইডার্সের হয়ে এবারের বিপিএল মাতানো রনি তালুকদারের কথা।
দেশের ক্রিকেটে নিয়মিত চোখ রাখেন এমন সবার নামটি খুবই চেনা। ঘরোয়া ক্রিকেটে রনির ব্যাট থেকে রানের ফোয়ারা ছোটে নিয়মিত। ২০১৫ সালে অপার সম্ভাবনা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভার হয়েছিল রনির। তবে দলে থাকলেও একাদশে জায়গা মিলছিল না। অবশেষে লম্বা সময় অপেক্ষার পর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় তার।
তবে সেখানেই আপাতত স্থগিত হয়ে আছে রনির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। অনেকেই সবদিক মিলিয়ে রনিকে কিছুটা দুর্ভাগা বললেও রনি সেটা মানতে নারাজ। ভাগ্যের দোষ না দিয়ে বরং নিজের ব্যর্থতাকে বড় করে দেখতে চান নারায়ণগঞ্জের এই ব্যাটার। ছোটবেলায় বাবার ইচ্ছাতে ক্রিকেটে আসা, পেশাদার ক্রিকেটার হয়ে ওঠাসহ জাতীয় দলে ফেরা এবং নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ করেছেন তিনি। এ সময়ে বিপিএলে এবার তার দল রংপুরের মালিকপক্ষকেও ভাসিয়েছেন প্রশংসায়। সেখান থেকে চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো সংবাদ প্রকাশের পাঠকের জন্য:
সংবাদ প্রকাশ: বিপিএলে দ্বিতীয় রান সংগ্রাহক হয়েছেন, নিজের পারফর্মেন্স নিয়ে কি বলবেন?
রনি: খুবই ভালো লাগছে, পারফর্মেন্স নিয়ে আমি সন্তষ্ট। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করেছি, সবমিলিয়ে ভালো লাগছে এরকম একটা প্লাটফর্মে পারফর্ম করতে পেরে।
সংবাদ প্রকাশ: এবারের বিপিএলে দেশীয় ক্রিকেটাররা দাপট দেখিয়েছেন, এটাকে কিভাবে মূল্যায়ণ করবেন?
রনি: দেখেন, সুযোগ পেলে যে দেশীয়রা ভালো করতে পারে এটা তারই প্রমাণ। এবার যারা ওপেন করছে হৃদয়, শান্তসহ বাকিরা যারা টপ অর্ডারে ব্যাটিং করছে সবাই দেশি খেলোয়াড়। দেশীয় ক্রিকেটাররা যখন উপরের দিকে ব্যাটিং করেছে তখন রান করার সুযোগ পেয়েছে আর সেটাই কাজে লাগিয়েছে। একজন ক্রিকেটার নিজের সঠিক জায়গায় খেলতে পারলে পারফর্ম করার সুযোগ থাকে, এ কারণেই দেশীয় ক্রিকেটাররা ভালো করছে এবারের বিপিএলে।
সংবাদ প্রকাশ: বিপিএলের আগে নিজের ব্যাটিং নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ছিল? সেটা কি পুরোপুরি ভাবে কাজে লাগাতে পেরেছেন?
রনি: হ্যাঁ, বিপিএলের আগে ওইভাবে অনুশীলন করেছি। আমার যে মাইন্ডসেটআপ আর পরিকল্পনা ছিল সেটা কাজে লেগেছে।
সংবাদ প্রকাশ: বিপিএলে শোয়েব মালিক, ডোয়াইন ব্রাভোর মত তারকার সাথে ড্রেসিং রুম শেয়ার করেছেন। সবমিলিয়ে অভিজ্ঞতা কেমন আর তাদের কাছ থেকে পরামর্শ পেয়েছেন কিনা
রনি: তাদের সাথে ড্রেসিংরুম শেয়ার করাটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে শোয়েব ভাইয়ের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। যখনই সময় পেতাম তার সাথে কথা বলতাম, সে আমাকে ব্যাটিংয়ে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে।
সংবাদ প্রকাশ: বিপিএলের দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে যেভাবে আউট হয়েছেন সেখানে কি মনোযোগের ঘাটতি ছিল?
রনি: না আমি যখন বলটা মিস করি তখন ভাবছিলাম বলটা জাকিরের (সিলেটের উইকেটরক্ষক) থেকে দূরে চলে গিয়েছে। তখন শানাকা ওই পাশে ছিল ও ভালো ব্যাটার, বিগ শট মারতে পারে এজন্য ওকে স্ট্রাইক দিতে চাচ্ছিলাম। টানা দুই বল মিস করাতে চাচ্ছিলাম যেভাবেই হোক স্ট্রাইক রোটেট করতে। আমি তখন খেয়াল করিনাই যে বলটা দূরে নয় ওর (জাকির) কাছেই ছিল।
সংবাদ প্রকাশ: ৪২৫ রান, তিন ফিফটি। আপনার বিচারে কোন ইনিংসটি সেরা?
রনি: দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার ম্যাচে সিলেটের বিপক্ষে ৬৬ রানের ইনিংসকে আমি এগিয়ে রাখতে চাই। এছাড়া কুমিল্লার বিপক্ষে একটা ইনিংসও আমার পছন্দের তালিকায় উপরের দিকেই থাকবে। আমার কাছে অবশ্য প্রতিটা ইনিংসই গুরুত্বপূর্ণ কারণ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ছোট ছোট রানও অনেক সময় দলের জন্য বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
সংবাদ প্রকাশ: রংপুরের মালিক পক্ষ থেকে কেমন সমর্থন দিয়েছে?
রনি: তারা আমাকে অনেক সাপোর্ট করছে, যেটা বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। চেষ্টা করেছি তাদের আস্থার প্রতিদান দিতে। তবে ফাইনাল খেলতে পারলে তাদের জন্য আরও ভালো লাগতো। এরকম একটা ফ্র্যাঞ্চাইজিতে খেলতে পারলে অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। দুর্দান্ত পরিবেশ, সবমিলিয়ে তাদের সমর্থন ছিল প্রচুর।
সংবাদ প্রকাশ: ছোটবেলায় ক্রিকেটার হওয়ার জার্নিটা শুনতে চাই…
রনি: এখানে একটা মজার ঘটনা আছে (হাসতে হাসতে)। ছোটেবেলায় এমনিতে টেপ টেনিস খেলতাম। ফুটবল ক্রিকেট সবই খেলতাম তখন। হটাৎ করে ২০০৪ সালে স্কুল টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পাই। ওই সময় থেকে ক্রিকেট বলে খেলা শুরু করি। এরপরই মূলত ক্রিকেটার হয়ে ওঠার শুরু হয়। স্কুল লিগের খেলা দেখে নারায়ণগঞ্জের এক কোচ খোকা ভাই উনি প্রিমিয়ার লিগে নিয়েছিল আমাকে।
সংবাদ প্রকাশ: ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পিছনে আপনার বাবার অবদানের গল্প শুনেছি আমরা, সেটা আপনি যদি একটু বলতেন…
রনি: আমার বাবার কথা যতই বলবো তত কম হয়ে যাবে। কারণ, আমার এখানে আসার পিছনে ওনার অবদান সবচেয়ে বেশি। শুধু আমি নয় আমার আরও দুই ভাইও ক্রিকেট খেলে। বড় ভাই সেকেন্ড ডিভিশন খেলেছে, ছোট ভাই জনি প্রিমিয়ার লিগ খেলছে, জাতীয় লিগ খেলছে। এবার প্রাইম দোলেশ্বর ক্লাবের হয়ে ঢাকা ফার্স্ট ডিভিশন খেলেছে।
সংবাদ প্রকাশ: ক্যারিয়ারের পিক টাইমে জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন কিন্তু খুব একটা সুযোগ মেলেনি, সেটা নিয়ে নিজেকে আনলাকি মনে হয়?
রনি: না, ওইভাবে নিজেকে আনলাকি মনে হয় না। যা হয় ভালোর জন্যই হয়। আমারই কিছু ভুল ছিল সেটা আমারই ব্যর্থতা।
সংবাদ প্রকাশ: ঘরোয়া লিগে নিয়মিত পারফর্ম করছেন, কিন্তু সেভাবে ফোকাসে আসেন না। এটা নিয়ে কি কোনো খারাপ লাগা কাজ করে?
রনি: না, খারাপ লাগে না তবে বুঝতে পারি যে আমার আরও ভালো করতে হবে। এগুলো আমাকে পথ দেখাচ্ছে যে আমাকে আরও পারফর্ম করতে হবে। অন্যদের থেকে আরও বেশি রান করতে হবে।
সংবাদ প্রকাশ: জাতীয় দলে আবার ফেরার ব্যাপারে কতটুকু আশাবাদী?
রনি: একজন ক্রিকেটার হিসেবে তো জাতীয় দলে ফিরতেই চাই। তবে শুধু চাইলেই তো হবে না আমাকে ওইভাবে পারফর্মও করতে হবে। আমি আমার ফোকাস নিজের পারফর্মেন্সের দিকেই দিতে চাই। পারফর্ম করতে পারলে একদিন না একদিন সুযোগ হবেই।
সংবাদ প্রকাশ: ক্রিকেটে কেউ আছে যাকে অনুসরণ করেন যার মতো ব্যাটিং করতে চান?
রনি: শচীন টেন্ডুলকার আমার খুব প্রিয় খেলোয়াড়। মূলত ওনাকে দেখেই ক্রিকেটে আসার আগ্রহ হয়েছিল আমার।
সংবাদ প্রকাশ: দেশের মধ্যে কাকে বর্তমানে সেরা মনে হয়?
রনি: এখন অনেক তরুণ ভালো খেলোয়াড় আছে। হৃদয়, জাকির, শান্ত, যে দলটা অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছে সেখানেও অনেক ভালো খেলোয়াড় আছে। সবমিলিয়ে আমার বিশ্বাস এরাই পরবর্তীতে দেশের ক্রিকেটের হাল ধরবে।
সংবাদ প্রকাশ: লিটন দাস আর আপনি প্রায় একই সাথে জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন। বর্তমানে তার আর আপনার অবস্থান বিবেচনায় আক্ষেপ হয় কতটুকু?
রনি: না ওটা নিয়ে আক্ষেপ নেই। কারণ আমি বলেছি তো, এটা আমার ব্যর্থতা। আমি নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি। লিটন বাংলাদেশের সেরা ব্যাটার, আমার বিশ্বাস ও বাংলাদেশকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।
সংবাদ প্রকাশ: লিটনের সাথে কথা হয়?
রনি: হ্যাঁ, কথাতো হয়। ওর কাছে জিজ্ঞেস করি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সময় মাইন্ডসেট কেমন থাকে, পরিকল্পনা কেমন থাকে এসব আর কি।
সংবাদ প্রকাশ: হাথুরুসিংহের অধীনে আপনার অভিষেক, তিনি আবার ফিরে আসছেন। জাতীয় দলে ফেরাতে এটা কি প্রভাব ফেলতে পারে?
রনি: দেখেন আমি এসব নিয়ে চিন্তা করি না। হাথুরু খুবই ভালো কোচ, সোজাসাপ্টা কথা বলে। উনি আসলে দেশের জন্য ভালো হবে। তবে আমি চিন্তা করছি পারফর্মেন্স নিয়ে। আমার পারফর্মেন্স যদি ভালো হয় ফিট থাকলে সেটা আমার ক্যারিয়ারের জন্যও ভালো।
সংবাদ প্রকাশ: আসন্ন ডিপিএলকে ঘিরে আলাদা কোনো পরিকল্পনা আছে?
রনি: হ্যাঁ সেটা তো থাকবেই। যেহেতু বিপিএল ভালো গিয়েছে সেহেতু ডিপিএল চাইবো ভালো করতে। লক্ষ্য থাকবে শীর্ষ তিন রান সংগ্রাহকের তালিকায় থাকার।