তারুণ্যে ভরপুর একটা দল। দলে নেই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, আছে নিজেকে প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাওয়ার আকুতি। এই একদল তরুণের নেতা সাকিব আল হাসান। দেশের ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা এই ক্রিকেটারের অধিনায়কত্বে একদল ইয়াং ব্লাড যেন ক্রিকেট মাঠে আগুন হয়ে জ্বলেছে আর তাতে পুরে ছাড়খার এবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। অধিনায়ক সাকিব এই তারুণ্যে ভরপুর দল নিয়ে দেখালে কিভাবে দল হয়ে খেলতে হয়, দেখালেন বড় স্বপ্নও।
তখন জস বাটলার আর ডেভিড মালান তখন যেন উইকেটে গেড়ে বসেছেন। তাদের জুটিতে ধীরে ধীরে ম্যাচ হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের। এমন সময়ে মোস্তাফিজের বাউন্সারে মালানের ক্যাচ নিলেন লিটন। নাহ, তাতেও বিপদ পুরোপুরি কাটেনি। অন্যপ্রান্তে নিজের ভয়ঙ্কর রুপ দেখানো শুরু করেছেন জস বাটলার।
পরের বলে নতুন ব্যাটার বেন ডাকেট সিঙ্গেল নিতে গিয়েছিলেন। পয়েন্ট অঞ্চলে বল পেয়ে শরীরের ভারসাম্য ঠিক না থাকলেও নিখুঁত এক থ্রো করলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। সেই থ্রো ভেঙে দিলো স্ট্রাম্প, জ্বলে উঠলো লাল আলো। শুধু লাল আলো? না, ইংল্যান্ডের জন্য এটা চূড়ান্ত বিপদ সংকেত। কারণ রিপ্লেতে দেখা গেলো বাটলার পৌঁছানোর আগেই ভেঙেছে স্টাম্প, ফলে রান আউটের ফাঁদে পড়েছেন তিনি।
থ্রো করার পরই মিরাজ বুঝতে পেরেছেন সেটা আউট, তাই দৌড়ানো শুরু করলেন। সতীর্থরা থামাতে চাইলেন, কিন্তু মিরাজের যেন আজ থামারই নয়। ব্রিটিশদের হোয়াটওয়াশ করতে যে থ্রো রাখে প্রত্যক্ষ ভূমিকা সে থ্রোর রূপকার কেনই-বা থামতে চাইবেন!
আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচ জয়ের পরও যদি কেউ বলতো টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতবে টাইগাররা তখন কি বিশ্বাস করতেন? বিশ্বাস তো হয়তো করতেন না এমনকি মন্তব্যকারীকে পাগলও বলে বসতেন।
টি-টোয়েন্টিতে এমনিতেই বাংলাদেশের অবস্থা নাজুক তার ওপর আবার ইংল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে সিরিজ জয় আবার সেখান থেকে হোয়াইটওয়াশ। নাহ, এই ফলের ঘোর সহসাই কাটবে না, কাটার কথা না।
তবে সেই অবিশ্বাস্য, অসম্ভব কাজ করে দেখিয়েছেন সাকিব আল হাসান। তার অধিনায়কত্বে প্রটি ম্যাচেই দাপট দেখিয়েছে টাইগাররা, দলের প্রতিটি সদস্য যেন মুখিয়ে ছিলেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য। আমি বলছি না, ওয়ানডে সিরিজে দলের কেউ চেষ্টা করেনি। কিন্তু এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় সাকিবের দলে প্রতিটি সদস্য সাকিবের অধিনায়কত্বে যে শারীরী ভাষা দেখিয়েছে সেটার প্রশংসা করতে কোনো শব্দই যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে দল হয়ে খেলার আকুতি অনেক পুরোনো। প্রায় সব অধিনায়কই সাফল্য পাওয়ার জন্য দল হয়ে খেলার লক্ষ্যের কথা জানান। তবে কি এটাই দল হয়ে খেলার বাস্তব উদাহরণ? হয়তো হ্যাঁ। তিন ম্যাচের সিরিজ অথচ প্রাপ্তির খাতা লিখে শেষ করার উপায় নেই।
রেকর্ড টানা ৬১ ম্যাচ খেলার পর একাদশ থেকে বাদ পড়েছেন আফিফ হোসেন। বেশ কয়েকদিন ধরেই তার ব্যাটে চলছে রানখরা। ইংলিশদের হোয়াইটওয়াশ করার দিনে একাদশ থেকে বাদ পড়ায় তার মন খারাপ হতেই পারে। তবে সেটা যেন না হয় সেটাও নিশ্চিত করা হয়েছে। ম্যাচ শেষে আফিফের কাঁধে হাত রেখে ড্রেসিংরুমে ফিরলেন কোচ হাথুরু। কি বলছেন? হয়তো এটাই বলছেন, এই দলের অংশ তুমিও, দমে যেও না। পারফর্ম করে ফিরে এসো দ্রুত।
এই সিরিজেই কোচ হিসেবে দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব নিয়েছেন হেড কোচ চান্ডিকা হাথুরুসিংহে। সিরিজ শুরুর আগে দলকে এশিয়ার সেরা ফিল্ডিং দেশ বানাতে চেয়েছিলেন। তার বাস্তব প্রতিফলনও দেখা গেলো এই সিরিজেই। মিরাজের রান আউট, শান্তর কয়েক ফুট লাফিয়ে অসম্ভব ক্যাচ ধরার চেষ্টা বা অভিষিক্ত তৌহিদ হৃদয়ের ফুল লেন্থ ডাইভ দিয়ে রকেট গতির ক্যাচ তালুবন্দি করার চেষ্টা- এক ম্যাচ থেকেই তো কতগুলো উদাহরণ বের হয়ে আসলো।
সাকিব দেশের ইতিহাসের সেরা ক্রিকেটার এ নিয়ে তর্ক করবে এমন লোকের সংখ্যা খুবই বিরল। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে? অনেকেই বলেন সাকিব এখন আর ক্রিকেটকে সিরিয়াসলি নেন না। আবার অনেকে বলেন, সাকিব অধিনায়ক থাকলে তরুণ ক্রিকেটাররা নিজেদের উজাড় করে দেন। সাকিব তাদের সেই স্বাধীনতা দেন। যারা বলেন সাকিব ক্রিকেটকে আর সিরিয়াসলি নেন না, তারা বোধহয় এখন নিজের কাছেই লজ্জা পাচ্ছেন।
দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের কোচরা সবসময় বলেন, সাকিব সবসময় নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চান। সবসময় বিশ্বসেরাদের সাথে নিজেকে মাপতে চান। অধিনায়ক সাকিব তার দলেও একই বার্তা ছড়িয়ে দেবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
এই সিরিজটা যদি নাজমুল হোসেন শান্তর সিরিজ বলি তাহলে ভুল হবে না। এই সিরিজেই শান্ত দেখিয়েছেন, ব্যাট হাতে তার সামর্থ্য রয়েছে। উইকেটরক্ষক হিসেবে লিটন দেখিয়েছেন তার কারিসমা। ব্যাট হাতে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে প্রথম পাঁচ ম্যাচে নিষ্প্রভ থাকলেও শেষ ম্যাচে দিয়েছেন ফর্মে ফেরার বার্তা। মেহেদী হাসান মিরাজ ভারত সিরিজের অসাধারণ খেললেও ইংল্যান্ড সিরিজে প্রথমদিকে ছন্দ খুঁজে পাননি। এরপর টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে তো একাদশেই জায়গা পাননি। দ্বিতীয় ম্যাচে ফিরেই সিরিজ জয়ের ম্যাচে হয়েছেন ম্যাচ সেরা।
সিরিজ শেষে সাকিব অবশ্য কোনো নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের নাম নিতে চাইলেন না, চাইলেন দল হিসেবে প্রশংসা করতে। এটাও কি দল হিসেবে খেলতে পারার, দলকে এক সূতোয় বাধার প্রমাণ নয়? অবশ্যই হ্যাঁ।
সাকিব বলেন, “আমি ব্যক্তিগত কোনো খেলোয়াড় নিয়ে বলতে চাই না। সবাই অসাধারণ খেলছে। যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা দরকার ছিল, করেছে। যারা ভালো খেলছে, আমি প্রত্যাশা করছি তারা যতদিন সম্ভব ভালো খেলতে থাকুক। যারা হয়তো এত ভালো অবদান রাখতে পারিনি, তারা যদি ১০-১৫শতাংশ বেশি রাখতে পারে; তাহলে আমরা আরও ভালো দল হবো।”
সাকিবের অধিনায়কত্বে বড় বিষয় সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা বোধ না করা। অধিনায়কদের সাহসী হতে হয়, পুরো দলের ভার বইতে হয়। জেতার চেয়ে ভালো ক্রিকেট খেলার ও সেরা হওয়ার তাড়না সাকিবের সবসময়ই থাকে। কারণ, আপনি যখন ভালো ক্রিকেট খেলতে চাইবেন, সবার সেরা হতে চাইবেন, আপনার পরিকল্পনা সঠিক থাকবে তখন জয় এমনিতেই আসবে।
গত এশিয়া কাপে সাকিবকে দেওয়া হয়েছিল টি-টোয়েন্টি দলের দায়িত্ব। ওই টুর্নামেন্ট থেকেই বিসিবি তরুণদের নিয়ে টি-টোয়েন্টি দল সাজাতে চাইছিল। একদল ইয়াং ব্লাড সামলাতে সাকিবের চেয়ে যোগ্য আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। এশিয়া কাপ থেকেই সাকিব দলের সবার মাথায় একটাই মন্ত্র ঢুকিয়েছেন, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া, মাঠে নিজেকে উজাড় করে দেওয়া, দল হয়ে খেলা।
আর এই কারণেই ১৫৯ রানের টার্গেটে বাটলার-মালান মিলে যখন ৯০+ রানের জুটি গড়ে ফেলেন, তখন কার্যত ওখানেই ম্যাচ থেকে বাংলাদেশের ছিটকে যাওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ ছিটকে যায় না। এর কারণ? কারণ, সাকিব আল হাসানের এই দলটা অন্য ধাতুতে গড়া। এরা হারার আগে হারতে চায় না।
এদের মধ্যে ক্ষিপ্রতা, আগ্রাসন আর নিবেদনে বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই, প্রত্যেকে চায় নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে। তাইতো মিরাজ হয়ে উঠলেন জন্টি রোডস, সময়ের প্রয়োজনে মোস্তাফিজের দেখালেন কাটারের সেই পুরোনো ধার, তাসকিন স্নায়ু ধরে রেখে স্টাম্প উপড়ে ফেলেন, হাসান প্রথম দুই বলে চার হজম করেও মাথা ঠান্ডা করে দলের জয় নিশ্চিত করেন।
এশিয়া কাপে ব্যর্থ হলেও বিশ্বকাপে ১৫ বছরের খরা কাটিয়ে ঠিকই দুইটি জয় পেয়েছিল টাইগাররা। তারপর এই প্রথম টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে নেমেই বিশ্বকাপজয়ীদের প্রথমবারের মতো হোয়াইটওয়াশ। এরপরও কি বলবো না, টি-টোয়েন্টি দল কক্ষপথে ফিরেছে, রয়েছে যোগ্য লোকের হাতে।