জয়ের জন্য তখন প্রয়োজন মাত্র এক রান! ম্যাচ ততক্ষণে ড্র! ক্যামেরার লেন্স তখন বাংলাদেশের ডাগআউটে। সাকিব আল হাসানের সঙ্গে কথা বলছিলেন শরিফুল ইসলাম! কী বলছিলেন, সেটা জানা না গেলেও ধারণা করা যায়, এই ম্যাচ নিয়েই কিছু একটা বলছিলেন!
হয়তো জেতার পর কীভাবে সেলিব্রেশন করবেন বড় ভাই সাকিবের সঙ্গে, সেই আলাপই করছিলেন! তবে সাকিব তাতে খুব একটা পাত্তা দিলেন না! দেবেনই বা কীভাবে!
সাকিব এ রকম কত নিশ্চিত জয় চোখের সামনে হাতাছাড়া হতে দেখেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই! ফলে জয় না আসা পর্যন্ত সাকিব ছিলেন নিজের মতোই! তবে যখনই মিরাজের ব্যাটে জয় নিশ্চিত হলো সাকিব দৌড়ালেন সবার আগে!
সোজা মাঠে গিয়ে কোলে তুলে নিলেন মিরাজকে! যে মিরাজ মাত্রই খেলে ফেলেছেন বাংলাদেশে ক্রিকেট ইতিহাসে ওয়ানডে ফরম্যাটে অন্যতম সেরা ইনিংস!
ভারতের মতো দলকে ১৮৬ রানে আটকে ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়! তবে সাকিব ও এবাদতের বোলিং তোপে সেটাও আজ করা গেল! কিন্তু বিপত্তিটা বাধল সেই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে!
ইনিংসের প্রথম বলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ড্রেসিংরুমে ফিরে এলেন শান্ত! একটু পর তিন নম্বরে নামা এনামুল হক বিজয়ও একই পথে! অধিনায়কত্বের প্রথম ম্যাচে এমনিতেই রান করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন লিটন কুমার দাস।
তার ওপর আবার শুরুতেই জোড়া উইকেট চলে যাওয়া যেন নতুন অধিনায়কের চাপ বাড়িয়ে দিল আরও অনেকখানি! এরপর সাকিব আল হাসানকে নিয়ে শুরুর সেই চাপ সামাল দিলেন তিনি।
আস্তে আস্তে যখন শুরুর অস্বস্তি কাটিয়ে উঠছেন, তখনই আনকোরা এক স্পিনে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরতে হলো লিটনকে! এরপর দ্রুতই বিদায় নিলেন সাকিবও!
মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ মিলে তখন আবারও জুটি গড়ার চেষ্টায়! কিন্তু তাদের অতি রক্ষণাত্মক ব্যাটিং দলকে আরও চাপে ফেলে দিল!। দুজনে মিলে খেলেছেন ৮০ বল, অথচ বলকে একবারের জন্য বাউন্ডারির বাইরে পাঠাতে পারেননি! রান এসেছে মাত্র ৩২!
শুধু ব্যাটিংয়ের সময় নয়, যখন আউট হলেন তখনো দল পড়ল আরও বড় বিপদে! টানা দুই বলে অভিজ্ঞ দুজনকে হারিয়ে তখন রীতিমতো খাদের কিনারায় বাংলাদেশ!
তবে এরপর যেটা হলো সেটা বোধ হয় ভারতও কল্পনা করেনি! মাত্র আট রানের ব্যবধানে নেই আরও তিন উইকেটে! এর মধ্যে তো আফিফ, হাসান ও এবাদত বিদায় নিলেন তিন রানের মধ্যে! মুশফিক আর রিয়াদকে যোগ করলে আট রানে নেই পাঁচ উইকেট! ১২৮ রানে চার উইকেট থেকে ১৩৬ রানে ৯ উইকেট!
অথচ জয় থেকে তখনো ৫১ রান দূরে বাংলাদেশ! স্টেডিয়াম খালি হওয়া শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে! ২৫ হাজারে ভর্তি গ্যালারিতে তখন মাত্র পাঁচ হাজারের কাছাকাছি!
বাংলাদেশের সবচেয়ে কট্টর ভক্তও বোধহয় আশা রাখেননি এই ম্যাচ জেতার! সবাই শুধু অপেক্ষা করছিলেন কত রানে হারবে বাংলাদেশ। প্রেসবক্সে সাংবাদিকরা বাংলাদেশের পরাজয় ধরে হয়তো ম্যাচ রিপোর্টও সাজিয়ে ফেলেছিলেন!
আর ঠিক তখনই ব্যাট হাতে মিরাকেল ঘটানো শুরু করেন মেহেদী হাসান মিরাজ নামের এক বাংলাদেশি ব্যাটার। যিনি একসময় অনুর্ধ’১৯ দলে চার নম্বরে ব্যাটিং করতেন! অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর সবাই ভুলেই গেল, ছেলেটা ব্যাটিংও করতে পারে!
৪১তম ওভারে খেলা চলে! তখনো জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ৪৭ রান। ওভারের প্রথম বৈধ বলে ভারতীয় পেসার কুলদীপ সেনকে ডিপ থার্ডম্যানের ওপর দিয়ে উড়িয়ে ছক্কা মারলেন মিরাজ!
শুধু তা-ই নয়, ওই ওভারের চতুর্থ ওভারেও এলো আরও একটি ছক্কা! তখনো কি কেউ বিশ্বাস করতে পেরেছে, এই দুইটা ছক্কা আসলে মিরাকালের ইঙ্গিত ছিল! মনে হয় না! হয়তো ভেবেছেন, দুইটা ছক্কা মেরেছে তো কি হয়েছে, এখনো পথ অনেক বাকি! আউট হলেন বলে!
নাহ মিরাজ সেটা ভাবেননি! যেটা কেউ বিশ্বাস করেনি, সেটা তিনি করেছেন এবং ম্যাচ শেষে সেটা বলেছেনও!
এরপর ওভারে পাঁচ বল খেলেছেন শেষ বলে মোস্তাফিজকে স্ট্রাইকে দিয়েছেন। একদম স্বীকৃত ব্যাটাররা টেলএন্ডারদের নিয়ে যেভাবে ব্যাটিং করে থাকেন! ভারতীয় পেসারদের গতিতে, সুইংয়ে বিট হয়েছে তবে পরাস্ত হননি! দাতে দাপ চেপে লড়াই করেছেন, এদিন দেন প্রতিজ্ঞা করেই ব্যাটিংয়ে নেমেছেন যে দলের জয় নিশ্চিত করে তবেই মাঠ ছাড়বেন।
বল হাতে ইনিংসের প্রথম থেকে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিলেন দীপক চাহার। তার ওভারেও হাঁকালেন তিন চার! ততক্ষণে যেন কাউকে গোনার টাইম নেই মিরাজের! যাকে পাচ্ছেন সমানে হাঁকিয়ে চলেছেন!
এখানে আড়ালে পড়ে যাচ্ছেন মোস্তাফিজ! কিন্তু সেটা হলে হবে কেন! মিরাজ যে মিরাকেলটা ঘটালেন তার জন্য যোগ্য সমর্থনটা তো এসেছে ফিজের কাছ থেকেই! দুইটা চার মেরেছেন, সবচেয়ে বড় কথা ১১টা বল সামলিয়েছেন! এমনকি মিরাজকে আত্মবিশ্বাসও জুগিয়েছেন!
ইনিংসের ৪৬তম ওভার, জয়ের জন্য প্রয়োজন আট রান! প্রথম বলে চার মেরে দলকে জয়ের বন্দরের আরও কাছে নিয়ে গেলেন মিরাজ! ওই ওভারের তৃতীয় বলে সিঙ্গেল দিলেন মিরাজ!
বলটা নো হওয়াতে ফ্রি হিট পেল বাংলাদেশ! একটা স্বস্তির নিশ্বাস কি তবে পড়েছিল? পড়তেই পারে! অন্তত এই বলে তো আর ফিজের আউট হওয়ার ভয় নেই! কিন্তু ফিজ সেই বলটা ব্যাটেই লাগাতে পারলেন না!
আবার শঙ্কা চেপে বসল! তবে কি আরও একবার তীরে এসে নৌকা ডোবার সাক্ষী হবে বাংলাদেশ ক্রিকেট! অবশ্য আশঙ্কা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক! এরকম ঘটনা তো আর কম ঘটেনি আগে!
কয়েক দিন আগেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে নিশ্চিত জেতা ম্যাচ হারতে হয়েছে বাংলাদেশকে। তখন ম্যাচ শেষে সাকিব আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে খেলতে নামলেই কেন যেন এমন হয়!
তবে এবার আর আক্ষেপের সাক্ষী হতে হয়নি!। এরপরের দুই বলে ফিজ ও মিরাজ দুই সিঙ্গেল নিয়ে নিশ্চিত করেছেন অবিস্মরণীয় জয়। যে জয়ে ভেঙে যাবে হাজারো অবিশ্বাসের দেয়াল!
এখন অন্তত দলের বিশ্বাস তৈরি হবে ক্লোজ গেমে আমরাও ভারতকে হারাতে পারি! স্নায়ু ধরে রেখে মিরাকেল আমরাও ঘটাতে পারি! বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিশেষ করে ভারতের বিপক্ষে ঠিক এভাবেই একটি জয় খুব প্রয়োজন ছিল। সেই ‘পারফেক্ট’ জয়টা এনে দেওয়ার জন্য নিশ্চিতভাবেই একটা বড় ধন্যবাদ পেতে পারেন মিরাজ। আর ও হ্যাঁ, মোস্তাফিজও!