অলিম্পিকের পদক জেতার স্বপ্ন তো সব অ্যাথলেটেরই থাকে, তা না পারলেও অন্তত একবার অলিম্পিকে খেলাই হয়ে থাকে অনেক অ্যাথলেটের জীবনের সবচেয়ে বড় গল্প। সেই অলিম্পিকে যেতে কতই না আত্মত্যাগ করতে হয়! তেমনই এক ত্যাগ স্বীকার করলেন অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ড হকি খেলোয়াড় ম্যাট ডসন, আজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হতে যাওয়া প্যারিস অলিম্পিকে যেতে হাতের আঙুলের ওপরের ভাগই কেটে ফেলেছেন ৩০ বছর বয়সী এই খেলোয়াড়!
তা-ও কেন! এমন নয় যে তার হাতে অন্য বিকল্প ছিল না। অস্ত্রোপচারেও সহজে সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু অস্ত্রোপচার করলে সেরে উঠতে কয়েক মাস লেগে যেত। অলিম্পিকে তাহলে আর খেলা হতো না ডসনের। তাই আঙুল কেটেই ফেললেন!
দুই সপ্তাহ আগে পার্থে অনুশীলনের সময়ে ডান হাতের একটা আঙুল ভেঙেছিল ডসনের। এরপর সবাই ভেবেছিলেন, অলিম্পিকে আর খেলা হচ্ছে না তার। সমাধান তখন একটাই ভাবা হচ্ছিল–ডসন অস্ত্রোপচার করাবেন, মাস কয়েকের মধ্যে সেরে উঠবেন, আবার খেলায় ফিরবেন। এই তো!
কিন্তু সতীর্থদের ও দলের কোচকে বাকরুদ্ধ করে দিয়ে ডসন আঙুলটা কেটেই ফেললেন! তার ফল? চোট পাওয়ার ১৬ দিন পর আগামীকাল শনিবার আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মাঠে নামতে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া দলের অংশ ডসন।
সংবাদমাধ্যমকে ডসন চোট পাওয়ার সময়ের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেছেন, আঙুলটা এত বাজেভাবে ভেঙেছিল যে ড্রেসিংরুমে গিয়ে ভাঙা আঙুলের অবস্থা দেখে তিনি জ্ঞানই হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখন ভেবেছিলেন, অলিম্পিকের স্বপ্নটা বুঝি শেষই হয়ে গেল!
দ্রুত প্লাস্টিক সার্জনের শরণ নেন ডসন। সার্জন তাঁকে বলেছেন, অস্ত্রোপচার করানো হলে পুনর্বাসনের দীর্ঘ বিরতির পরও আঙুলটা আর আগের মতো অবস্থায় ফিরবে না। আর আঙুল কেটে ফেলা হলে? সে ক্ষেত্রে দিন দশেকের মধ্যেই আবার ডসন খেলায় ফিরতে পারবেন বলে জানিয়েছেন সার্জন।
তার স্ত্রী বারেবারে নিষেধ করেছিলেন, হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে। তবে ডসনের কথা, তিনি সার্জনের সঙ্গে কথা বলার পর ওই বিকেলেই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন – আঙুল কাটাই একমাত্র সমাধান!
ভাবনায় তার বয়স, খেলোয়াড়ি জীবন আর এরপর কোনো অলিম্পিকে খেলার সম্ভাবনা যে অনেক বেশি কাজ করেছেন, সেটা বোঝা যায় ‘পারলে ভু’ হকি পডকাস্টে তার কথা শুনে, ‘ক্যারিয়ারের শুরুর চেয়ে এখন শেষের ধাপেই আছি আমি। কে জানে, এটাই হয়ে থাকতে পারে আমার শেষ (অলিম্পিক)। আর যদি মনে হয়ে থাকে যে আমি এখনো আমার সেরাটা দিতে পারব, তাহলে সেটাই তো করব। সেটার মূল্য যদি হয় একটা আঙুল কেটে ফেলা, তাহলে তা-ই করব।’
অস্ট্রেলিয়ার হকি দলের অধিনায়ক অ্যারান জালেউস্কি বলছিলেন, ডসনের এই সিদ্ধান্ত পুরো দলের মধ্যে বিস্ময়ের একটা ঢেউ দিয়ে গেছে, তবে শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্তটাকে সমর্থনই করছেন। ‘বুঝতে পারছিলাম না আমাদের কী অনুভব করা উচিত। এরপর শুনলাম ও হাসপাতালে গেছে এবং আঙুলটা কেটেই ফেলেছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত। কারণ, জানি লোকে এখানে (অলিম্পিক) আসতে অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে রাজি থাকে, মাঝে মাঝে সেটা একটা আঙুলও হতে পারে।’
ডসনের সিদ্ধান্তের পেছনের ভাবনাটা জালেউস্কির কাছে এরকম, ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানো এবং সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার পথে আপনি যখন পুরো জীবনই কাটিয়েছেন ধাপে ধাপে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্য দিয়ে, এরপর আমার মনে এ সিদ্ধান্তটা ওর জন্য সহজই হয়ে গেছে।’
এই সপ্তাহের শুরুর দিকে কোকাবুরাস (অস্ট্রেলিয়ার ছেলেদের হকি দলের ডাকনাম) কোচ কলিন ব্যাচ জানিয়েছেন, ডসন দলের সঙ্গে অনুশীলনে ফিরেছেন। তবে ডসনের সিদ্ধান্তটা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সেভেন নিউজ নেটওয়ার্কে তাঁর কথা, ‘ম্যাটের প্রশংসা করতেই হয়! বোঝাই যাচ্ছে ও প্যারিসে খেলার জন্য কতটা নিবেদিত ছিল, আমি নিশ্চিত নই যে আমি হলে এমনটা করতাম। তবে ও করেছে, এটা প্রশংসার দাবিদার।’
ডসনের খেলোয়াড়ি জীবনে বড় কোনো আসরের আগে বড় চোট এটিই প্রথম নয়। ২০১৮ কমনওয়েলথ গেমসের আগে হকি স্টিকের আঘাতে একটা চোখই হারাতে বসেছিলেন। সে টুর্নামেন্টেও শেষ পর্যন্ত কোকাবুরাসের হয়ে খেলেছিলেন ডসন, অস্ট্রেলিয়া সেখানে সোনাও জিতেছিল। টোকিও অলিম্পিকে রূপা জেতা অস্ট্রেলিয়া এবার ডসনকে সোনার পদকটা এনে দিতে পারলে, তাঁর বিসর্জনের যথাযথ প্রতিদান হবে সেটা।