বার্সেলোনার হয়ে চমক দেখানো মুনির এল হাদ্দাদির কথা মনে আছে? ফুটবলে তার কড়ি থেকে ফুল হয়ে ওঠা বার্সার যুব একাডেমি লা মাসিয়ায়। বয়সভিত্তিক দল ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক স্পেনের হয়ে। গুগলে সার্চ করলে জানবেন এখন আর স্পেন নয়, আফ্রিকার দেশ মরক্কোকে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। স্প্যানিশদের জার্সিতে মাত্র এক ম্যাচ খেলা মুনির এল হাদ্দাদিকে দলে নিতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল মরক্কোকে। সেই শিক্ষা থেকেই ফিফার কাছে নিয়ম পরিবর্তনের আবেদন করে মরক্কো। সেই আবেদনেই বদলে গেছে দেশটির ফুটবল। শুধু বদলে যাওয়া বললে ভুল হবে, আমূল পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে দেশটির ফুটবলে।
২০১৮ সালে মরক্কো জাতীয় দলের হেড কোচের দায়িত্বে ছিলেন হার্ভে রেনার্ড। কাতার বিশ্বকাপে সৌদি আরবের ডাগআউটে দাঁড়িয়ে আর্জেন্টিনাকে দেওয়া হোঁচটে বিশ্বব্যাপী বেড়েছে তার খ্যাতি। এর আগে থেকেই আফ্রিকান ফুটবলের অন্যতম পরিচিত মুখ ছিলেন রেনার্ড। মরক্কোর জন্য ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের জন্য দল গোছাতে বেশ খাবি খেয়েছিলেন। কারণ দেশটিতে ছিল না তরুণ কোনো ফুটবল প্রতিভা। বিপরীতে অভিবাসী হয়ে দেশছাড়া পরিবারের ছেলেরা ফুটবলার হয়ে ইউরোপে চেনাচ্ছিল নিজের জাত। এরপরেও জন্মভূমির জার্সিতে সুযোগ পাবেন কি-না তা নিশ্চিত নয়।
নিজ দেশের ফুটবলার সংকট কাটাতে তাই সুযোগটা লুফে নেওয়ার চিন্তা ভাবনা করেছিল মরক্কো ফুটবল ফেডারেশন। কারণ, ইউরোপের দেশগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মরক্কো অভিবাসী পরিবারের অনেকেই হয়ে উঠেছিলেন বড় ফুটবল তারকা। তাদেরে লক্ষ্য করে ফুটবলারদের জাতীয়তা বদলের সহজ করে আনার প্রস্তাব দেয় মরক্কো।
ফিফার কাছে মরক্কোর চাওয়া ছিল দুই দেশের হয়ে নাগরিকত্ব থাকা ফুটবলারা ২১ বছরের বয়সের আগে এক দেশের হয়ে তিন বা তার চেয়ে কম ম্যাচ খেললেও অন্য দেশের হয়ে যেন সহজেই খেলতে পারে। ২০১৮ সালে মরক্কোর ওই আবেদনের প্রায় দুই বছর পর সাড়া দেয় ফিফা। মরক্কোর দেওয়া ওই প্রস্তাব কোনো পরিবর্তন ছাড়াই অনুমোদন হয়। মরক্কোর ওই আবেদন পাস হওয়ার পরই বিশ্বব্যাপী বাড়তে থাকে অভিবাসী ফুটবলারদের সংখ্যা। শেষ পর্যন্ত এই অভিবাসীরাই হয়ে উঠেছেন ফুটবলের পোস্টার বয়।
আবেদনে সাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্পেন থেকে মুনির এল হাদ্দাদিকে দলে নেয় মরক্কো। ২০২০ সালে অনুমোদন পেলেও করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এল হাদ্দাদিকে দলে আনতে এক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এখন মনে প্রশ্ন আসতেই পারে কেন মুনির এল হাদ্দাদিকে নেওয়া হলো?
মুনির এল হাদ্দাদির বাবা তরুণ বয়সে মরক্কো থেকে পাড়ি জমান স্পেনের কাতালুনিয়ায়। সেখানেই মুনির এল হাদ্দাদির জন্ম ও বেড়ে ওঠা। শুধু তাই নয়, বয়সভিত্তিক দল ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক স্পেনের হয়েই। তবে ২০১৪ সালে স্প্যানিশদের জার্সিতে এক ম্যাচ খেলার পরেই হয়ে পড়েছিলেন ব্রাত্য। ওই সুযোগটা কাজে লাগিয়েই মুনির এল হাদ্দাদিকে দলে নিয়েছিল মরক্কো।
শুধু মুনির এল হাদ্দাদি নয়, ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মরক্কোয় শিকড় থাকা সব ফুটবলারকেই দলে ভেড়ানোর উদ্যোগ নেয় দেশটি। ভিনদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই ফুটবলারদের কল্যাণেই কাতার বিশ্বকাপের মঞ্চে এসেছে মরক্কো। শুধু তাই নয়, দুই বছরের মাথায় আমূল বদলে গেছে মরক্কোর ফুটবল। অথচ মাত্র চার বছর আগে ২০১৮ সালে দল গোছাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছিলো মরক্কোকে।
কাতার বিশ্বকাপে মরক্কোর স্কোয়াডে থাকা ২৬ ফুটবলারের মধ্যে ১৬ জনেরই জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইউরোপের কোনো না কোনো দেশে। গুরুত্বপূর্ণ দুই খেলোয়াড় হাকিম জিয়েশ ও আশরাফ হাকিমিরাও বেড়ে উঠেছেন ইউরোপে। এছাড়াও ডিফেন্ডার নৌসসেইর মাজরাউ ও মিডফিল্ডার সোফয়ান আমরাবাতেরও ফুটবলে হাতেখড়ি ইউরোপেই।
আফ্রিকার দেশগুলো কাতারেই প্রথমবার নিজ নিজ জাতীয়তার কোচ নিয়ে এসেছে বিশ্বকাপে খেলতে। এরই ধারাবাহিকতায় মরক্কোকে কোচিং করাচ্ছেন দেশটির কিংবদন্তি ফুটবলার ওয়ালিদ রেগ্রাগুই। তারও জন্ম কিংবা বেড়ে ওঠা কোনোটিই মরক্কোতে নয়। ওয়ালিদের জন্ম ও ফুটবলে হাতেখড়ি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। যদিও আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রতিনিধিত্ব করেছেন মরক্কোকে।
কাতার বিশ্বকাপজুড়েই প্রভাব বিস্তার করছেন অভিবাসী ফুটবলাররা। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়া সব দলের জার্সিতেই দেখা মিলছে অভিবাসী ফুটবলারদের। তারাই হয়ে উঠছেন অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর জন্য বড় প্রভাবক।