১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবের দিন। ৯ মাসের যুদ্ধে জয়ী হয়ে পাকিস্তানি শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয়। দু’শ বছরের ব্রিটিশ ও চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি শাসনের পর এই দিনে মুক্ত হয় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ভূমি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ফুটবল খেলোয়াড়দের অসাধারণ ভূমিকা ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়। যুদ্ধের সময় খেলোয়াড়রা ফুটবল খেলে স্বাধীনতার স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত এবং তহবিল গড়ে তোলার অনন্য নজির স্থাপন করেন। মুক্তিযোদ্ধা ফুটবলাররা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সবুজ সংকেত পাওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৩ জুন গঠন করা হয় বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি। সমিতির প্রথম প্রেসিডেন্ট ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে এমএনএ শামসুল হক ও লুৎফর রহমান। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সমিতিকে ১৪ হাজার ভারতীয় রুপি অনুদান দিয়েছিলেন খেলা শুরু করার জন্য। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল মুক্তিযুদ্ধের সময় ফুটবল খেলেছে ভারতের পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন স্থান ছাড়াও বিহার, বেনারস ও মুম্বাইয়ে। জাকারিয়া পিন্টু ছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক। সম্প্রতি তিনি মারা যান। আর সহ-অধিনায়ক ছিলেন প্রতাপ শংকর হাজরা। কোচ ও ম্যানেজার ছিলেন ননি বসাক ও তানভীর মাজহারুল তান্না। মোট ১৬টি প্রদর্শনী ম্যাচে অংশ নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা দল। এর মধ্যে ৯টিতে জয়, ৪টি পরাজয় এবং ৩টি খেলা ড্র হয়েছে। ম্যাচ খেলা থেকে অর্জিত পাঁচ লাখ ভারতীয় রুপি ক্রীড়া সমিতি জমা দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই দেশের ক্রীড়া ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। এই দিন ভারতের মাটিতে স্বাধীন বাংলা দল প্রথম ম্যাচ খেলেছে নদীয়া জেলার বিপক্ষে। ঐতিহাসিক ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয়েছিল।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে যারা ছিলেন: জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শঙ্কর হাজরা (সহ-অধিনায়ক), আলী ইমাম, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, অমলেশ সেন, আইনুল হক, নিহার কান্তি দাস, শেখ আশরাফ আলী, বিমল কর, শাহজাহান আলম, মনসুর আলী লালু, কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান, সুভাষ সাহা, কে এম নওশেরুজ্জামান, ফজলে সাদাইন খোকন, আবুল হাকিম, তসলিমউদ্দিন শেখ, আমিনুল ইসলাম, আবদুল মমিন জোয়ারদার, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, সাত্তার, প্রাণ গোবিন্দ কুন্ডু, মুজিবর রহমান, মেজর জেনারেল (অব.) খন্দকার নুরুন্নবী, লুৎফর রহমান, সাইদুর রহমান প্যাটেল, অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জি, সনজিব কুমার দে, মাহমাদুর রশিদ, দেওয়ান মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন।
অরুণ নন্দী ছিলেন বিশ্বখ্যাত সাঁতারু। তিনি ১৯৭১ সালে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে তহবিল সংগ্রহে কলকাতার কলেজ স্কয়ারে ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার কেটে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে পাওয়া অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করেন। ওই সময় তার সাঁতার দেখতে সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমার, ব্রজেন দাসসহ অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিরা ছুটে আসেন। এছাড়াও সাঁতার দেখতে আসা দর্শকদের মাতিয়ে রাখতে পুরস্কার মঞ্চেই গান গান মান্না দে। যার মাধ্যমে ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার হয়। অরুণ শেষ জীবনে ঢাকার হকি স্টেডিয়ামের দোতালায় একটি খুপড়ি ঘরে দীর্ঘদিন নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন এবং কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। পরে চিকিৎসার জন্য তিনি কলকাতায় যান ও কলকাতার একটি হাসপাতালে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর চিকিৎসাধীন থাকবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে হত্যা করা হয় আজাদ বয়েজ ক্লাবের ক্রিকেট সংগঠক মুশতাককে। টানা দুই দিন তার নিথর দেহ পড়েছিল ঢাকা জেলা ক্রীড়া পরিষদের সামনে। আর তা দেখে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে আজাদ বয়েজের ক্রিকেটার আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েলের বুকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রশিক্ষণের জন্য মে মাসে তিনি চলে যান ভারতে। গেরিলা বাহিনী ক্র্যাক প্লাটুনের হয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন জুয়েল। দ্রুত অস্ত্র চালনা শিখে সফল ও দুর্ধর্ষ সব লড়াইয়ে অংশ নেন। কিন্তু আগস্টে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে গেরিলা হামলার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে জুয়েল আহত হন। গ্রেনেড বিস্ফোরণে তার হাত থেঁতলে যায়। ২৯ আগস্ট বড় মগবাজার এলাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। এর পরই জুয়েলকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। ডানহাতি এ উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেটে প্রথমে খেলেন আজাদ বয়েজে। ১৯৬৮ সালে নাম লেখান মোহামেডানে, এটিই ছিল তার শেষ ক্লাব। পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অন্যতম মুখ জুয়েলের দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আত্মত্যাগ, অমর এক ইতিহাস হয়ে আছে। শহীদ জুয়েল বীর বিক্রম খেতাব পেয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলে প্রতিবাদে ঢাকা স্টেডিয়ামে আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল একাদশ বিসিসিপি একাদশের ক্রিকেট ম্যাচে দর্শকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এর ঠিক ৫ দিন আগেই পাকিস্তানি শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢাকায় নিজের ব্যাটে ‘জয় বাংলা’ স্টিকার লাগিয়ে মাঠে নামেন রকিবুল হাসান। রকিবুল মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। ষাটের দশকে ঢাকা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে অন্যতম শক্তিশালী ক্লাব বিবিসির (বকশীবাজার ক্লাব) পেসার শাফায়াত জামিলও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ক্রিকেট ছেড়ে ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের মার্চে মেজর পদে পদোন্নতি এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি পেয়েছেন বীর বিক্রম খেতাব। মেজর (অব.) নূরন্নবী ওরফে মুন্না ১৯৬৯ সালে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে খেলা শুরু করেন উদিতির হয়ে। মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের একজন যোদ্ধা তিনিও। দেশের মুক্তির জন্য লড়েছেন প্রবাসীরাও। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট দল ইংল্যান্ড সফরে গেলে প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকরা ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ করেন এবং পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পোড়ান তারা।