আফ্রিকার প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলবে মরক্কো। বিশ্ব ফুটবলে তাক লাগানো অ্যাটলাস লায়নরা শেষ চারে ওঠার পথে বিদায় করেছে র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ ১০-এ থাকা ইউরোপের তিন দল বেলজিয়াম,স্পেন ও পর্তুগালকে। বিশ্বমঞ্চে আফ্রিকার ফুটবলে নতুন ইতিহাস তৈরি করা মরক্কো আশা দেখাচ্ছে সবাইকে। জানান দিচ্ছে, ভবিষ্যতে বিশ্ব সেরা হওয়ার দৌড়ে আফ্রিকানদের প্রভাব থাকবে। তারাও যোগ্য হয়ে উঠছে ইউরোপ-ল্যাতিনদের টপকে শিরোপা ঘরে তোলার জন্য।
মরক্কোর সেমিফাইনাল নিশ্চিত করাটা মোটেও আপসেট নয়। বরং, নিজ যোগ্যতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নই তাদেরকে সাফল্য এনে দিচ্ছে। মরক্কোর সেমিফাইনাল নিশ্চিতের ঘটনা অবশ্য অনেকের চোখে এখন পর্যন্ত আপসেট হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। আগে নানাভাবে আফ্রিকার ফুটবলীয় শক্তিগুলোকে আটকে রাখার চেষ্টা হয়েছিল। সেই বাধা বিপত্তিগুলো পেরিয়ে অবশ্য নিজেদেরকে প্রমাণ করেই চলেছে আফ্রিকান দলগুলো।
বিশ্বমঞ্চে আফ্রিকার প্রথম উপস্থিতি ১৯৩৪ সালে। স্কটিশ কোচ জেমস ম্যাকক্রির অধীনে বিশ্বকাপে খেলেছিল মিশর। প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ খেলা মিশর অবশ্য কাতারে নেই। প্রথম আফ্রিকান হওয়ার পরও তারা কোনোবারই পার করতে পারেনি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের বাধা।
১৯৩৪ সালে ইতালিতে এক ম্যাচ খেলেই ফিরেছিল ঘরে। ফুটবলে সেই সময়কার পরাশক্তি হাঙ্গেরির কাছে ৪-২ গোলে হেরে নিশ্চিত হয়েছিল তাদের। শুরু থেকে নকআউট পর্ব হওয়ায় দ্বিতীয় ম্যাচের কোনো সুযোগ অবশ্য মেলেনি।
সেই ১৯৩৪ সালে শুরু হওয়া আফ্রিকানদের বিশ্বকাপ যাত্রা শুরুতে ছিল শুধুমাত্রই আনুষ্ঠানিকতা। এর মাঝেও ‘আপসেট’ ঘটানোর চেষ্টার কমতি কখনই ছিল না আফ্রিকানদের মনে। ১৯৮২ সালে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে প্রথম চমক তৈরি করে আলজেরিয়া। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে বড় আপসেট হিসেবে বিবেচিত হয়।
আফ্রিকানদের কাছে ইউরোপ কিংবা ল্যাতিন ফুটবল পরাশক্তির হারের ঘটনা দ্বিতীয় দফায় ঘটে ওই আলজেরিয়ার মাধ্যমেই। ১৯৯০ বিশ্বকাপে ৮৬’র চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে আলজেরিয়া চমক দেখায়। ওইবার তারা খেলেছিল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল।
২০০২ সালে কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপেও একই কাণ্ড ঘটায় সেনেগাল। তবে তারা আর্জেন্টিনা নয়, তখনকার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে ওঠে কোয়ার্টার ফাইনালে। বছর আটেক বাদে আফ্রিকার প্রথম বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার কীর্তি গড়ে ঘানা। উরুগুয়ের বিপক্ষে বিতর্কিত ঘটনার পর অবশ্য তাদের ছিটকে যেতে হয়।
‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’- এই মর্মে উজ্জ্বীবিত আফ্রিকান দেশগুলো বারবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ফেরত আসলেও হারায়নি মনোবল। ওই জেরেই ৯২ বছর পর সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ ঠিকই তৈরি করে নিয়েছে আফ্রিকা। আর রেকর্ডবুকে উঠেছে মরক্কোর নাম।
আলোর পথে আফ্রিকান দেশগুলোর এই যাত্রাটাই এগিয়ে নিচ্ছে আফ্রিকান ফুটবলকে। বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তারা হয়ে উঠছে ‘গরীব মহাদেশ’ খ্যাত আফ্রিকার আলোর মশাল।
আলোক বর্তিকা জ্বালানোর আগে অবশ্য বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আফ্রিকাকে। বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর সময়ে আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশই ছিল ইউরোপীয়দের উপনিবেশ। ফলে শুরুর দিকে তাদের উপস্থিতি ছিল প্রায় শূন্যের কোটায়। ধীরে ধীরে স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল বিশ্বকাপে নিজেদের জন্য জায়গা তৈরি করে নেওয়া। কারণ, ইউরোপ আর ল্যাতিনদের ভিড়ে আফ্রিকান দেশগুলো হয়ে পড়েছিল বঞ্চিত। ১৯৩৪ আসরের পর ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বকাপে ছিল না আফ্রিকানদের উপস্থিতিই। সেই বাধা ডিঙিয়ে ১৯৭০ মেক্সিকো আসরে প্রথম দেখা মেলে আফ্রিকার কোনো দেশের। সেবার আফ্রিকার প্রতিনিধি ছিল মরক্কোর।
পরে আরও কয়েকবার আফ্রিকাকে আটকে রাখার নানারকম হীন চেষ্টা ছিল। এই যেমন- ১৯৮২ সালে আলজেরিয়ার সামনে সুযোগ ছিল বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার। তবে পশ্চিম জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার প্রতারণায় তা আর হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘ আট বছর পর ওই আক্ষেপ অবশ্য ঘুচিয়েছিল ক্যামেরুন।
নানা বাধা-বিপত্তি আর আটকে রাখার চেষ্টা থাকলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে আফ্রিকান ফুটবল। জানান দিচ্ছে, তারাও বিশ্ব ফুটবল শাসনের অধিকার রাখে। তারাও করতে পারে বিশ্বফুটবলকে শাসন।