আমাদের যৌবনের দিনগুলিতে যাঁদের লেখা দিয়ে প্রেমে ও প্রতিবাদে যৌবন বন্দনা করেছিলাম তাঁদের মধ্যে সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব গুহ অন্যতম প্রধান কবি ও লেখক। সেই বয়সে পড়েছি 'হলুদ বসন্ত।'
'নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।' তাঁর চোখ দিয়ে সাঁওতাল পরগণার অরণ্যকে দেখলাম একটু ভিন্নভাবে। বিভূতিভূষণের মতো মিস্টিক নয়। অরণ্য তাঁর উপন্যাসে পুরুষ আর নদী নারী। তাঁর উপন্যাসে বর্ণিত অরণ্য,নদী, আর নারীর যৌনতার স্পর্শে পাঠক বিগলিত। সে যৌনতা রিরংসা নয়, আমাদের বিদ্ধ করে কিন্তু আহত করে না। আমাদের যৌবনবেলা তখন এইরকম। তখন 'কোয়েলের কাছে', 'একটু উষ্ণতার জন্য' উপন্যাস অত্যন্ত প্রিয়।
'সুখের কাছে 'উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিলো শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। উপন্যাসের নায়ক সুখেন। রাঁচী অঞ্চলের রোডসাইড মোটরস মেকানিক। তার কপালে এমন সুন্দরী নারীর আগমন শুধু সুখেনকে নয়, আমাদের মতো পাঠককেও তন্দ্রাহারা করেছিলো। অনেক পরে পড়েছি 'মাধুকরী'। এই উপন্যাস নানা বিতর্ক ও আলোড়ন তুলেছিলো। এটি তাঁর প্রবল জনপ্রিয় উপন্যাস। কিন্তু তখন ধারাবাহিক এই উপন্যাস পড়ে আমার মনে হয়েছিলো যৌনতার ভিতর যে সারল্যের প্রকাশ তাঁর লেখার বিষয়ের একটা বড় গুণ তা তিনি হারিয়েছেন।
নাগরিক জটিলতার পাঁকে সেই শুদ্ধতাও আর নেই। পপুলার লিটারেচারের ধর্মই সেটা। জনপ্রিয়তা পেতে পেতে যে বাজার নির্মাণের দায় লেখকের ওপর এসে পড়ে তখন লেখক নিজের সত্তা বিসর্জন দেন ঐ বিনোদন বিনিয়োগের বাজরের কাছে।
১৯৮৮ সালের বইমেলায় তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম কলকাতা বইমেলায়। আমার তখন বয়স তেইশ। যৌবনের সেই মুগ্ধতায় অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম প্রিয় লেখকের। তাঁকে শেষ দেখলাম ২০২০ -র বইমেলায়। অনেক পাঠকের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছেন সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ এই লেখক। উঁকি মারলেও কাছে যাবার ইচ্ছে আর তৈরি হয় নি।
আমার বুদ্ধদেব গুহ যৌবনের সেই দিনগুলোতে আটকে গেছেন। 'মাধুকরী'র পর আর কোনো উপন্যাস পড়তে ইচ্ছে হয় নি। অনেক অতিরিক্ত গুণ ছিল তাঁর। ভালো শিকার করতে পারতেন। টপ্পা গানেও অসাধারণ গায়কী আয়ত্ত করেছিলেন।
তাঁর পরিণত বয়সের প্রয়াণে এই লেখকের প্রতি আমার সেই মুগ্ধতা রেখে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাই।