ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল আমেরিকান সমুদ্র অধিদপ্তর। অপরাধ? হেমিংওয়ে তাঁর ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসে বুড়ো সান্তিয়াগোকে দিয়ে একটি বিশাল তিমি শিকারের কাহিনি ফেঁদেছেন। এটা প্রাণবৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর। আমেরিকার প্রাণিসম্পদ আইনে এটা দণ্ডনীয় অপরাধ। সে কারণে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পরে হেমিংওয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে এবং দুই লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে রেহাই পান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধেও এরকম একটি মামলা হয়েছিল। অপরাধ? রবীন্দ্রনাথ তাঁর রাজর্ষী উপন্যাসে মহিষবলির কাহিনি ফেঁদেছেন। উপন্যাসটি পড়ার পর ভারতীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ একটি অপরাধ করেছেন। সে কারণে তিনি বাদী হয়ে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দিলেন মামলা ঠুকে। পরে রবীন্দ্রনাথ ক্ষমা চেয়ে ও নগদ এক লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি পান।
সম্প্রতি কলকাতায়ও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে। ‘ব্যাধ’ নামে একটি ওয়েব সিরিজ হয়েছে সেখানে। হইচইয়ে প্রদর্শিত হচ্ছে। এই সিরিজে এক লোক শত শত চড়ুই পাখি হত্যা করে। সিরিজে আঁকশি দিয়ে সেই হত্যাদৃশ্য দেখানো হয়, মৃত চড়ুইপাখিদের দেখানো হয়। ভারতীয় প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবরা সিরিজটি দেখার পর শিউরে ওঠেন। তারা এই সিরিজের পরিচালকের বিরুদ্ধে দায়ের করেন মামলা। সেই মামলা এখনো আদালতে চলমান।
কী, উপরের ঘটনা তিনটি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে, তাদের অবিশ্বাস্য মনে হওয়ারই কথা। শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে যারা নির্জ্ঞান, এ বিষয়ে যারা নির্বোধ, যারা শিল্পের বাস্তবতা আর জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন দপ্তরে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে এরকম নির্বোধের সংখ্যা অনেক, গুনে শেষ করা যাবে না। তারা শিল্পী-সাহিত্যিকদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। বলে দিচ্ছেন কোনটা শিল্প আর কোনটা শিল্প নয়।
তরুণ নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমনের দর্শকনন্দিত সিনেমা ‘হাওয়া’য় একটি শালিক পাখি খাওয়ার দৃশ্য দেখানোকে কেন্দ্র করে সুমনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। বিরাট একটি কাজ করে ফেলেছেন তারা। তাদের ভাবটা এমন যে, দেশে কোথাও কোনো বন্যপ্রাণী নিধন হচ্ছে না। দেশে সর্বপ্রাণবাদ প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। কেউ একটি পিপড়াও মারছে না, পাখি তো দূর।
অথচ প্রায়ই খবরের কাগজে দেখি পাহাড়ে হাতি হত্যা করা হচ্ছে, সুন্দরবনে বাঘ হত্যা করা হচ্ছে, হরিণ শিকার হচ্ছে, হাওরাঞ্চলে অতিথি পাখি শিকার করা হচ্ছে। ওসব নিয়ে তাদের বিশেষ কোনো দায় নেই। তাদের দায় পড়েছে ‘হাওয়া’ সিনেমায় একটি শালিক ভক্ষণের দৃশ্যকে কেন্দ্র করে।
‘হাওয়া’ সিনেমায় চান মাঝি (চঞ্চল চৌধুরী) ট্রলারের একটি খাঁচায় একটি শালিক পোষে। জাহাজ যখন দিক হারায় তখন সে পাখিটিকে ছেড়ে দেয়। এই জন্য যে, আশপাশে যদি কোনো দ্বীপ থাকে, তবে পাখিটি আর ফিরবে না। দ্বীপ না থাকলে ফিরে আসবে। পাখিটি শেষতক ফিরে আসে। চান মাঝি ক্ষুধার তাড়নায় সেটিকে কাবাব বানিয়ে খেয়ে ফেলে। শিল্পের বাস্তবতায় চান মাঝি শালিক পাখিই খেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেটি শালিক পাখি না-ও হতে পারে। সেটি একটি মুরগির বাচ্চাও হতে পারে। বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট আদালতে কীভাবে প্রমাণ করবে সেটি যে মুরগির বাচ্চা ছিল না?
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের লোকজন শিল্পের বাস্তবতা আর জীবনের বাস্তবতা কী, তা বোঝেন না। বোঝার মতো বোধ তাদের নেই। অবস্থা যদি এমন হয়, তাহলে তো ভবিষ্যতে সিনেমায় কোনো মানুষ খুনের দৃশ্য দেখানো যাবে না, কোনো ধর্ষণের দৃশ্য দেখা যাবে না। দেখালেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায়ের করে দেবে মামলা। কারণ খুন-ধর্ষণ জঘন্যতম অপরাধ।
অপরদিকে, খন্দকার হোসেন শাহরিয়ার নামে এক আইনজীবী ‘হাওয়া’ সিনেমার প্রদর্শনী বন্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে সেন্সর বোর্ডকে। কারণ কী? কারণ হচ্ছে, ‘হাওয়া’ সিনেমা নারী চরিত্রকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং অশ্লীল গালি ব্যবহার করা হয়েছে। বাপ রে! মনে হচ্ছে জনাব শাহরিয়ার সম্প্রতি আকাশমার্গে স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন, যেখানে কোনো অশ্লীল গালাগালি হয় না, যেখানকার অধিবাসীরা সদাই বিশুদ্ধ প্রমিত ভাষায় কথা বলে, সদাই শ্লীল ভাষায় কথা বলে। তারা কখনো ‘শালার পুত’ বলে না, বলে ‘শ্বশুরপুত্র।’ তারা কখনো ‘গোয়া’ বলে না, বলে, ‘পশ্চাৎদেশ’। শাহরিয়ার কখনো বাংলাদেশের রিকশা-শ্রমিকদের বুলি শোনেননি, কখনো শ্রমিকশ্রেণীর ভাষা শোনেননি, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে গণমানুষের ভাষা কতটা ‘অশ্লীল’ তিনি কখনো মেপে দেখেননি।
ওদিকে প্রতিভাবান নির্মাত মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবারের বিকেল’ সিনেমা আটকে রেখেছে সেন্সর বোর্ড। কেন? সিনেমাটি মুক্তি পেলে নাকি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। কী পরিমাণ দেশপ্রেমিক এরা একেকজন! এদের দেশপ্রেম সত্যি অভাবনীয়! এমন দেশপ্রেমিক সত্যি বিশ্ববিরল!
আচ্ছা, উপন্যাসের জন্য কি সেন্সর বোর্ড আছে? কোনো উপন্যাস প্রকাশের আগে কি সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়? না। গল্পগ্রন্থ প্রকাশের আগে? না। কবিতাগ্রন্থ প্রকাশের আগে? না। কোনো নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে সেন্সরের অনুমতির প্রয়োজন হয়? না। কোনো টিভি নাটকের ক্ষেত্রে? না। তবে সিনেমার ক্ষেত্রে কেন সেন্সরের প্রয়োজন? একুশ শতকের এই কালে, সকল দরজা-জানালা যখন উন্মুক্ত, তখন সেন্সর বোর্ড নামক প্রতিষ্ঠানটির উপস্থিতি মনে করিয়ে দেয় ডাউনোসর যুগের কথা। সেন্সর বোর্ড নামক প্রতিষ্ঠানটির বিলুপ্তি সময়ের দাবি।
সব দেখে-শুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য নিয়ে একটি সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত চলছে। সমস্ত সাংস্কৃতিক তৎপরতা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ মহল উঠেপড়ে লেগেছে। ‘হাওয়া’র বিরুদ্ধে মামলা, ‘হাওয়া’র প্রদর্শনী বন্ধে লিগ্যাল নোটিশ এবং ‘শনিবারের বিকেল’ আটকে রাখা সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ।
আজ সিনেমার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, একই ষড়যন্ত্র কাল উপন্যাস নিয়েও হতে পারে, গল্প নিয়েও হতে পারে, মঞ্চ নাটক নিয়েও হতে পারে, টিভি নাটক নিয়েও হতে পারে। এখন প্রয়োজন প্রতিরোধ। চলচ্চিত্র-নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশীলদের পাশে কবি-সাহিত্যিকদেরও দাঁড়ানো আবশ্যক। কেননা সাহিত্য থেকে সিনেমা আলাদা কিছু নয়। সকল শিল্পই একই উৎসবিন্দু থেকে উৎসারিত।