• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘আমি যা হতে পারিনি, মাসুদ রানা তাই‍‍’


আহমাদ মোস্তফা কামাল
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২২, ০৮:৩৮ এএম
‘আমি যা হতে পারিনি, মাসুদ রানা তাই‍‍’

‘কাজী আনোয়ার হোসেন এবং তাঁর মাসুদ রানার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল কৈশোরেই, স্কুল-পড়ুয়া বয়সে, আমার বাবার মাধ্যমে। শুনতে একটু অদ্ভুত শোনাল নিশ্চয়ই! কারণ মাসুদ রানা তো “প্রাপ্তবয়স্ক”দের বই। কোনো বাবা কি তাঁর কিশোরপুত্রকে সেসব বই পড়ার অনুমোদন দেন? ঘটনাটা তাহলে খুলেই বলি।’

‘বাবা ছিলেন ঘোরতর পড়ুয়া মানুষ, সারাক্ষণই তাঁর মুখের সামনে কোনো-না-কোনো বই খোলা থাকত। পড়ার ব্যাপারে তাঁর কোনো বাছবিচারও ছিল না। একাধিক ভাষা জানতেন, বিভিন্ন ভাষার বই তিনি মূল ভাষাতেই পড়তেন। তাঁর বাছবিচারহীন পড়াশোনার একটা উদাহরণ দিই। তাঁর কণ্ঠেই আমি জালালউদ্দীন রুমীর “মসনবী” মূল ভাষাতে শুনেছি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ; আবার শেষ বয়স পর্যন্ত “মাসুদ রানা”র মতো থ্রিলারধর্মী বইও পড়তে দেখেছি তাঁকে! শুধু পড়তেন না তিনি, আমাকে পড়তে উদ্বুদ্ধুও করতেন। একবার, আমি তখন স্কুলে পড়ি, তিনি মাসুদ রানা সিরিজের একটা বই হাতে দিয়ে বললেন—“এটা পড়ে দেখ।” আমি তো লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। বাবার সংগ্রহ থেকে চুরি করে মাসুদ রানা পড়ি বটে, কিন্তু তিনি যে সেটা ধরে ফেলেছেন, তা-তো বুঝিনি! মাসুদ রানা যা সব কাজ করে বেড়ায়! মদ খায়, মারামারি করে, মেয়েদের সঙ্গে বিছানায় যায়, আরও কত কি! এ রকম কোনো বই যদি বাবা হাতে তুলে দেন, তাহলে কি লজ্জার সীমা-পরিসীমা থাকে? মনে হলো, আমার চুরি করে পড়ার ব্যাপারটা ধরে ফেলার শাস্তি হিসেবেই যেন তিনি এটা করলেন! কী আর করা, অন্যায় করেছি, শাস্তি তো পেতেই হবে! বাবার দেওয়া বইটা এক দিনেই সাঙ্গ হলো। পরের দিন তিনি জিজ্ঞেস করলে জানালাম, হ্যাঁ পড়েছি। “কেমন লাগল?”—বাবার এই প্রশ্নে মাথা নিচু করে বসে রইলাম, লজ্জায়। তিনি বললেন, “লজ্জা পাচ্ছো কেন, বাবা? মাসুদ রানা যেসব কাজকর্ম করে বেড়ায় সেগুলো ভেবে?” আমি মাথা নিচু করেই মাথা দোলালাম। তিনি বললেন, “শুধু ওগুলো দেখলেই চলবে? ছেলেটা যা-ই করুক না কেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখে তার দেশকে। দেশের জন্য সে জীবনের ঝুঁকি নিতেও পিছপা হয় না। খুব চমৎকার ব্যাপার না এটা?” বাবার কথা শুনে আমার চোখের ওপর থেকে একটা পর্দা সরে গেল যেন! মাসুদ রানা হয়ে উঠল আমার নায়ক, মনে হলো—প্রয়োজনে আমিও দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারি।’

‘একদম শেষ দিনগুলোতে, বাবা যখন শয্যাশায়ী, আমি সবেমাত্র কলেজে উঠেছি, প্রতিদিনই তিনি বলতেন, “খোঁজ নিয়ো তো, মাসুদ রানা সিরিজের নতুন কোনো বই বেরিয়েছে কি না!” প্রতিদিন তো বেরোত না, বলাই বাহুল্য, সে কথা এসে বললে মন খারাপ করতেন তিনি। ভারি অবাক হতাম আমি। এত ভারী ভারী বই যিনি পড়েন, পড়া ছাড়া যাঁকে একদিনও দেখিনি, তিনি কেন “মাসুদ রানা”র মতো থ্রিলারের এত ভক্ত? সেসব আলাপ করার আগেই বাবা অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন। আর অনেক দিন পর আমার মনে হলো, কাজী আনোয়ার হোসেন যেমনটি বলেছিলেন, “আমি যা হতে পারিনি, মাসুদ রানা তাই”; সম্ভবত আমার বাবার কাছেও মাসুদ রানা সে রকমই এক চরিত্র। আর আমারও ছোটবেলার নায়ক মাসুদ রানাই।’

‘মাসুদ রানা নাকি কাজী আনোয়ার হোসেন? কে আসলে নায়ক আমার ছোটবেলার? ধন্ধে পড়ে যাই। এই দুজনকে কি আলাদা করা যায়? যাবে কখনো?’

‘আজ কাজী আনোয়ার হোসেন অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন, কিন্তু হারিয়ে গেলেন না তিনি। মাসুদ রানার ভেতর দিয়েই তিনি তাঁর অপূর্ণ স্বপ্নকে ধরে রাখলেন, নিজেও রয়ে গেলেন আমাদের কাছে।’

‘বিদায় কাজীদা। আপনার অনন্তযাত্রা মর্যাদাপূর্ণ হোক।’

Link copied!