কবীর সুমন ঢাকায় এসেছেন শো করতে। আমি ঢাকায় থাকলে অবশ্যই সুমনের গান দেখতে-শুনতে যেতাম। বাংলাদেশের পুলিশকে বইমেলায় বই চেক করার ও স্টল বাতিল করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তারা জাদুঘরের নিরাপত্তার কথা বলে কবীর সুমনের গানের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনাপত্তি পত্র দেয়নি বা অনুষ্ঠানটি বাতিল করেছে। ভেতরের কাহিনি কি, এখনো জানা যায় নি। তবে শো অনুষ্ঠিত হচ্ছে, ইঞ্জিয়ারিং ইনস্টিটিউটের মিলনায়তনে। পুরো ঘটনায় অতিথি কবীর সুমন, আজকাল যেমন ক্ষ্যাপা থাকেন, নিশ্চয়ই খেপে গেছেন। নাকি বাংলাদেশের প্রতি তার প্রমাণিত ভালবাসার কারণে তিনি বিব্রতই হয়েছেন মাত্র!
টিকেটের দাম একটু বেশি? লাখ টাকায় ঢাকার মানুষ বলিউডের নায়ক-নায়িকাকে দেখতে গেছে, আর হাজার টাকায় সুমনের গান দেখবো না? জানি, সুমনের সেই শারীরিক সামর্থ্য নেই, যে এক কি-বোর্ড আর হারমোনিকা দিয়ে একাই চমৎকার শো করবেন। একবার গিয়েছিলাম, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে, সেই নব্বই দশকের শেষভাগের কোনো বছরে। সেরকমই দেখেছিলাম, ওয়ান ম্যান আর্মিকে। এও জানি, সেই সিগনেচার গানগুলোর পরিবর্তে তিনি তার সাম্প্রতিক সাধনার বিষয় বাংলা খেয়ালই হয়তো বেশি বেশি পরিবেশন করবেন। তবু যেতাম। কারণ সুমন এক জাতির ইতিহাসে একজনই আসেন। হয়তো তার চিরপ্রস্থানেরও বেশি দেরী নেই, লাইভ পরিবেশনা দেখার সুযোগ ঢাকাবাসী আর পাবে কিনা সন্দেহ!
সুমন চট্টোপাধ্যায় আমার মতো অনেকেরই তরুণ বয়সের নস্টালজিয়ার অপরিহার্য় অংশ। আমিই আজ মধ্যবয়সী, সুমন বৃদ্ধ। সুমন বদলেছেন অনেক, চট্টোপাধ্যায় থেকে কবীর হয়েছেন, তার পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থানও প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে তিনি ঢাকায় আসলে তার শো আমার জন্য দেখা ফরজ ছিল। কিন্তু আমি ঢাকায় নেই। এসুযোগ আর ইহজনমে আসবে না।
আমি কবীর সুমনের ফেসবুক বন্ধু। ২০০৯ সালে একবার মেসেঞ্জারে লিখি, বলি যে লালন শাহ এবং কবীর সুমন আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমাকে যুক্ত করার জন্য অনুরোধ করি। এরপর ২০১১ সালে আরেকবার। অবশেষে ২০১৮ সালে তিনি আমাকে বন্ধু হিসেবে যুক্ত করে নেন। ওই সময় থেকে দেখছি তিনি ফেসবুকে নিয়মিত লাইভ করেন, তবে শারীরিক কারণেই হয়তো, আজকাল তাও বন্ধ। মূলত এখন বাংলা খেয়াল চর্চা করেন, বাংলা খেয়াল প্রচার ও সম্প্রসারণ তার আজকালকার ব্রত। গানের পাশাপাশি উচ্চাঙ্গ সংগীতের ওস্তাদ ও পণ্ডিতদের নিয়ে অনেক গল্প করেন, কথা বলেন। মনে হতো লোকটা মারা গেলে এসব বলার আর কেউ থাকবে না। দেখলাম বব ডিলানের ভাবশিষ্য হিসেবে যাকে চিনেছি, তিনি ক্রমশ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ধারক-বাহকে পরিণত হয়েছেন। ’জাতিস্মর‘ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করে সবাইকে চমকে দেবার পরে, ‘গিটারের লোক সেতারে কীভাবে’ এরকম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, শাস্ত্রীয় সংগীত দিয়েই তার সংগীত চর্চা শুরু, সেটা সবসময়ই তার ভেতরে ছিল।
যখন তাকে কিছুটা কাছাকাছি পেলাম, মানে ফেসবুক বন্ধু হিসেবে পেলাম, তার লাইভ শোগুলোয় কমেন্ট সেকশনে কিছুটা নিয়মিত কমেন্ট করা শুরু করলাম। হয়তো আমার মন্তব্যগুলো তার নজরে পড়েছিল। তিনি তার খেয়ালগুলো এরপর ইনবক্সে পাঠানো শুরু করলেন। বেশিরভাগই অডিও রেকর্ডিং। আমি আপ্লুত হতাম, যে তিনি নিজে মনে করে আমাকে এগুলো পাঠাচ্ছেন! শোনার পরে মন্তব্য করার চেষ্টা করতাম। আজ গুনে দেখলাম তিনি প্রায় ৩০টি রেকর্ড আমাকে বিভিন্ন সময়ে মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছেন। তবে শেষ শেয়ার করেছেন, ২০২১ সালের জুন মাসে। তিনি হয়তো বুঝে গেছেন, আমি খেয়ালের সর্বোৎকৃষ্ট শ্রোতা নই। অপাত্রে যাচ্ছে তার পরিশ্রম। সত্যিই তাই, আমি চট্টোপাধ্যায় পর্বের পুরোটা, এবং কবীর পর্বের আংশিক ভক্ত। ওই সুমন-সিগনেচার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি, সমসাময়িক খেয়াল চর্চায় শ্রদ্ধা আছে, কিন্তু আমি বিশেষ ভক্ত নই। খেয়ালের রসাস্বাদনের যোগ্যও নই।
আমি ছোটবেলায় খুব বেশি রবীন্দ্রসংগীত শুনতাম। কয়েক বছর কেবল রবীন্দ্রসংগীতই শুনেছি। তখন এবং পরেও লোককে বলতে শুনেছি, রবীন্দ্রনাথের গান সব অনুভূতির কথা বলে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও মনে করতেন গানেই তার প্রতিভার সর্বোচ্চ স্ফূরণ ঘটেছে। তিরিশের কবিরা তাকে গালমন্দ শুরু করলে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ওরা কি আমার গানকেও নেবে না? যাহোক, একসময় বুঝলাম রবীন্দ্রনাথের গানে প্রেম, প্রকৃতি ও পূজার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো থাকলেও, রাজনীতি তেমন নাই। সুমনের গানে প্রেম পেলাম, প্রকৃতি পেলাম আর পূজাকে রিপ্লেস করলো রাজনীতি। ব্যস সুমন আমার জন্য হয়ে উঠলেন একটা টোটাল প্যাকেজ। নব্বই দশকে এবং নতুন শতকের প্রথম দশকে আমরা লালন শুনি, ফিডব্যাক-মাইলস শুনি, জেমস-বাচ্চু শুনি, কিন্তু সেসবের পাশাপাশি আমি সবচেয়ে বেশি শুনি সুমন। দুই দশকজুড়ে সুমন আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। সে এক সময় ছিল! আজো সুমন হঠাৎ শুনি, নব্বইয়ের গানগুলোই শুনি। ’পাড়ার ছোট্ট পার্ক, ঘাস নেই আছে ধুলো, ঘাসের অভাব পরোয়া করেনা, সবুজ বাচ্চাগুলো’ -- এধরনের বয়ান বাংলা গানে কোনোকালে ছিল না। যা একইসঙ্গে জনজীবন, প্রকৃতি ও তার বিনাশ, প্রাণের হিন্দোল ও বিদ্রোহের কথা বলে।
যাহোক, সুমন সমাজতন্ত্রের পতনের পরও যৌথখামারের স্বপ্ন আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন গান দিয়ে। তরুণদের উদ্দীপ্ত করার জন্য বলেছেন, ‘হাল ছেড়োনা বন্ধু কেবল কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’। আমরা উদ্দীপ্ত হয়েছিও। ওদিকে তিনি যখন বলেন, ‘যখন বিকেল দেয় সন্ধ্যার আল ধরে হাঁটা’ তখন যে চিত্রকল্প অঙ্কিত হয়, তা আমাদের অচিন এক অনুভবের দিকে টেনে নিয়ে যায়। কিংবা ‘ঘাটের কাছে গল্প বলে নদীর জল’ গানে তিনি আমাদের নিয়ে ইতিহাসের এক গভীর অরণ্যে প্রবেশ করেন।
তবে একদিন দেখা গেল, বহুদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়িষ্ণু বামপন্থী দল সিপিএমের বিরুদ্ধে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনে নেমে পড়েছেন সুমন। ওই অব্দি হয়তো ঠিকঠাক ছিল। সমাজতন্ত্রী দল যদি কর্তৃত্ববাদী আচরণ করে, তবে তা প্রতিরোধ করা দরকার। সিপিএমের বিদায় আর তৃণমূলের উত্থানে খেদ থাকতে পারে, কিন্তু এনিয়ে আমার বেশি কিছু বলার নেই। যেই দলই ক্ষমতায় থাকুক, তার আচরণ গণতান্ত্রিক তো হতে হবে। সুমন অ্যাক্টিভিস্ট-শিল্পী থেকে রাজনীতিক হলেন, তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি হলেন, আবার দীর্ঘদিন জনপ্রতিনিধিত্ব করেন না। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির প্রতি বরাবরই লয়াল। তিনি বিজেপির ঘোর বিরোধী, কিন্তু তৃণমূলের অপশাসন নিয়ে কিছু বলেন না।
আমি বহুবার ভেবেছি, ’হক-কথা’য় তাকে আমন্ত্রণ জানাবো। তাকে নিয়ে একটা শো করার কথা বহুবার ভেবে আবার বাতিল করেছি। কারণ তাকে মনে হয়েছে একজন আনম্যানেজবল পারসন। লাইভ শোগুলোয় তিনি মন্তব্যকারীকেও বকাঝকা করতেন। সংগীতের আলোচনায় অনেকের নাম চলে আসতো, কখনো নাম ধরে বা কখনো ইঙ্গিত করে বকে দিতেন। মধ্যিখানে বিজেপি ধারার এক টিভির এক সাংবাদিককে চরম গালাগাল করলেন, সেই সাংবাদিক তা অনৈতিকভাবে রেকর্ড করে অনলাইনে ছেড়ে দিলেন। সুমনের গালিটাই সবার মনে রইলো। তার সর্বব্যাপী বিজেপিবিরোধিতার কথা কারো মনে থাকলো না। গালাগালির আরও কিছু রেকর্ড ঢাকায় জাদুঘরের অনুষ্ঠান বাতিল হবার পর শেয়ার হয়ে চলেছে। বাজারে চালু থাকা আরো অভিযোগ পুনরায় সামনে আসছে – তিনি বিবিধ স্ত্রীদের সঙ্গে অনৈতিক আচরণ করেছেন, মুসলমান নাম নিয়েছেন ঠিক আছে কিন্তু কখনো কখনো মোল্লাদের মতো মন্তব্য করেছেন, এক কবির স্ত্রীর উদ্দেশ্যে যৌন উত্তেজক কথা লিখেছেন, বাংলাদেশে তার বন্ধু আসাদুজ্জামান নূরসহ আওয়ামী বলয়ের লোকেরাই ইত্যাদি।
আমার কথা হলো, কলকাতার রাজনীতি আমি অল্পই জানি বা বুঝি। দৈনন্দিন কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির খবরও বেশি জানিনা। তাই তার বকাবকি-গালাগালিকে আমি ক্ষ্যাপাটে বুড়োর প্রলাপ হিসেবে ধরে নেই। এটুকু ঝেড়ে ফেলে, যা থাকে তা অমূল্য বলেই মনে হয়। মোটকথা, তার শেষজীবনের যাবতীয় অ-সাংগীতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগ নেই। তার গান ও কবিতসম লিরিক হলো আমার কাছে প্রণিধানযোগ্য বিষয়।
বোদলেয়ার আদমব্যবসায়ী ছিলেন। কে রাখে তার খবর? তার কবিতাই আমরা পড়ি। রোমান পোলনস্কি বা উডি অ্যালেনের কত নারী কেলেঙ্কারী! সেসবের বিস্তারিত কিছু জানি না, জানলেও মনে থাকে না। মনে থাকে তাদের ছবিগুলোর কথা। ওদিকে কত কত ভালো ছবির প্রযোজক হার্ভে উইনস্টাইন মি-টুর মুখোমুখি হলে দেখা গেল তিনি ছিলেন সিরিয়াল এবিউজার। সেরকম হলে প্রত্যাখ্যান ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না।
সুমনের ক্ষেত্রে কি ব্যাপারগুলো সেরকম?
তাহলে, সুমনের গানের অনুষ্ঠান কেন দেখতে যেতে চাইবো না?