আমার ছোটবেলাটা কেটেছে খিলগাঁওয়ে। আমরা যেখানে থাকতাম, তার ঠিক দুই তিনটা রাস্তার পরেই ছিল সিরাজ সিকদারদের বাড়ি। খিলগাঁও সরকারি স্কুলের মাঠ ছিল আমাদের খেলার মাঠ। সিরাজ সিকদারের ছেলে শুভ্র নিয়মিত ওই মাঠে খেলতে আসতো। খুব কাছাকাছি বসবাসের কারণে সিরাজ সিকদারের ছোট ভাইদের এবং শুভ্রকে কাছের থেকেই দেখা হয়েছে।
কোনো ধরনের রাজনৈতিক জ্ঞান তখনও না জন্মালেও এই বাড়িটার বিশেষত্ব সম্পর্কে অবগত ছিলাম আমরা। সিরাজ সিকদারকে সম্পর্কে ভাসাভাসা জানতাম। তিনি সর্বহারার রাজনীতি করতেন। জানতাম তিনি খুন হয়েছেন পুলিশের হাতে। ফলে ওই বাড়িটার এবং তার মানুষদের ব্যাপারে বিশেষ একটা কৌতূহল ছিল আমাদের।
এই বিশেষ কৌতূহল ছিল এই বাড়ির আরেক সদস্যের জন্য। তিনি হচ্ছেন শামীম সিকদার। সেই সত্তরের দশকের শেষের দিকে তাঁকে আমরা দেখতাম সাইকেল চালাতে। না, শখের বশে সাইকেল চালানো নয়। তিনি পুরুষদের মতো পোশাক পরে সাইকেলে চেপে কাজে যেতেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের প্যান্ট-শার্ট পরাটাই দুঃসাহস ছিল সেই সময়ে। আর তিনি প্যান্ট-শার্ট পরে নির্বিকার সাইকেল চালিয়ে ঢাকা শহরে চলাচল করতেন। আমরা অবাক বিস্ময় নিয়ে দূর থেকে তাঁকে দেখতাম। কাছে ঘেঁষার সাহস পেতাম না। ছেলেরা কেউ কিছু বললে তিনি নাকি তাদের পেটান, এটাও শুনেছি আমরা। যে ছেলেদের তিনি পেটান, সেই বয়সের অবশ্য আমরা ছিলাম না, তারপরেও তাঁকে ভয় পেতাম। তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয় আরও পরে। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডার গ্রাজুয়েটের ছাত্র, সেই সময়ে তাঁকে দেখেছি খুব কাছে থেকে। ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ নামের একটা ভাস্কর্য তিনি তখন তৈরি করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে। এই ভাস্কর্যটা আমাদের চোখের সামনেই তৈরি হয়েছিল।
শুরুটা হয়েছিল ডাস দিয়ে। টিএসসির সামনের সড়ক দ্বীপের দক্ষিণ কোণায় ডাস বা ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্ন্যাক্সের জন্ম হয়। সেখানকার সিঙ্গারা বেশ বড় সাইজের আর অসাধারণ মানের ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই ডাস জমজমাট হয়ে ওঠে। তখনই ডাসের ঠিক পিছনেই স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্য গড়ে উঠতে থাকে।
একটা মইয়ের উপরে উঠে তাঁকে নিয়মিত এই ভাস্কর্যটা খোদাই করতে দেখা যেত তখন। টিএসসিতে বসে আড্ডা দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মতৎপরতা অবলোকন করতাম আমরা। তিনি প্যান্ট-শার্ট পরে কাজ করতেন। তখনকার দিনে মেয়েরা প্যান্ট-শার্ট সেভাবে পরতো না। শামীম সিকদার ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁর সাবলীল চলাফেরা এবং প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী আচরণের কারণে কেউ তাঁকে ঘাটাতে সাহস করতো না। ফলে, নির্বিবাদে তিনি কাজ করে যেতেন তাঁর মতো করে।
১৯৮৮ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পরে এর উদ্বোধন হয় মার্চ মাসে। সেই সময়ে আন্নার (লেখকের স্ত্রী) একটা ছবি তুলেছিলাম এটাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে। সঠিক দিনক্ষণ অবশ্য মনে নেই। আমার একটা ইয়াসিকা এমএফ টু ক্যামেরা ছিল। সেটা দিয়েই তুলেছিলাম ছবিটা।
বিদায় শামীম সিকদার। বিদায় একজন ব্যতিক্রমী ও দুঃসাহসী মানুষ। প্রথা ভাঙার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি এই পৃথিবীতে। সেটা সুচারুভাবেই করে গিয়েছেন তিনি।