সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক জাফর ইকবালের অনুরোধে এবং ‘সরকারের উচ্চ মহলের’ পক্ষ থেকে তাঁর মাধ্যমে দেওয়া প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে অনশন ভঙ্গ করেছেন। দেড় শ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অনশনের কারণে ইতিমধ্যেই অনেক শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে আমি উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত ছিলাম। তারপরও তাঁরা জীবন বাজি রেখেই তাঁদের দাবি আদায়ে অনড় থেকেছেন। অনশন ভাঙার পরে শিক্ষার্থীরা একে বলেছেন ‘অনশন স্থগিত’ করা এবং তাঁরা আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হয়েছিল যে সিলেটের আন্দোলনে ‘তৃতীয় পক্ষ’ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে তারা ‘তৃতীয় পক্ষের’ ইন্ধন দেখতে পান। এই তৃতীয় পক্ষ কে বা কারা, কেউই খোলামেলাভাবে বলেননি।
আপাতদৃষ্টে অধ্যাপক জাফর ইকবাল এবং অধ্যাপক ইয়াসমিন হক প্রথম বা দ্বিতীয় পক্ষ নয়। কিন্ত তাঁরা নিশ্চয় সরকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কথিত তৃতীয় পক্ষ নন। কেননা, সরকারের উচ্চ মহলের লোকজন তাঁদের কাছে উপস্থিত হলে এবং তাঁদের কাছে শিক্ষার্থীদের দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দিলেই তাঁরা সেখানে গেছেন–জাফর ইকবাল বলেছেন ‘সরকারের উচ্চ মহল আমাকে পাঠিয়েছেন’ (বাংলানিউজ২৪, ২৬ জানুয়ারি ২০২২)। তাঁর মানে কি এই দাঁড়ায় যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে যৌক্তিক মনে করলেও তিনি সেখানে গিয়েছিলেন সহমর্মিতা জানাতে নয়, সরকারের হয়ে প্রতিশ্রুতি জানাতে?
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে পাঠানো এই প্রতিনিধি এবং তাঁর মাধ্যমে সরকারের উচ্চ মহলের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করা হয় কি না। কেননা, শিক্ষার্থীদের দাবি তো একটাই–উপাচার্যের পদত্যাগ। ইতিমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন তাতে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়ে সরকারের কোনো ধরনের আগ্রহ নেই। তাহলে আসলে কী প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেটা বোঝার উপায় কী?
এই আন্দোলনে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের অভিযোগে আটক পাঁচজন শিক্ষার্থীকে ‘জামিন’ দেওয়া হয়েছে, কিন্ত তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। এই আটকের ঘটনায় কোন আইন অনুসরণ করা হয়েছে সেই বিষয়েও স্পষ্টতা নেই, এই নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রশ্ন তুলেছিল। সাবেক ৫ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামা ১৫০ জনের বিরুদ্ধে এই মামলা করেছেন সিলেট জেলা তাঁতী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজাত আহমেদ লায়েক। তাঁর বক্তব্য, ‘আন্দোলনে অর্থ সহায়তাকারীরা জামায়াত-শিবির, তাই মামলা করেছি’ (ডেইলি স্টার, জানুয়ারি ২৬, ২০২২)। এই ধরনের অভিযোগে মামলা নেওয়া এবং তাঁদের আটক করার মধ্যে যা স্পষ্ট, তা হচ্ছে আইন নয়, সরকারের ইচ্ছেই আসল কথা। এই সব জামিনের পর অভিযুক্তরা বছরের পর বছর আদালতে হাজিরা দিতে বাধ্য হন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন। অন্যদের কথা বাদই থাকল। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। এটি ইতিবাচক, কিন্তু তার মানে এই মামলাগুলোর কোনো মেরিট ছিল না। তারপরেও মামলা নেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীদের বলেছেন, “সরকারের কাছে আন্দোলনের সঠিক তথ্য নেই। তিনি সরকারের কাছে তাদের প্রকৃত তথ্য তুলে ধরবেন।” (যুগান্তর, জানুয়ারি ২৬, ২০২২)। দুই সপ্তাহের বেশি আন্দোলন হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের ওপরে ছাত্রলীগ হামলা করেছে, পুলিশ হামলা করেছে, মামলা হয়েছে কিন্তু সরকারের কাছে ‘প্রকৃত তথ্য নেই’। তাহলে কিসের ভিত্তিতে পুলিশের হামলা-মামলা। কিসের ভিত্তিতে সরকারের আশ্বাস?
এই আন্দোলনের সময় একটা ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটেছে, অনশনের সময় মেডিকেল টিম প্রত্যাহার করা হয়েছে। যুক্তিটি হাস্যকর–‘করোনা ঝুঁকি এড়াতে’ (সিলেট টুডে২৪)। এই অমানবিক আচরণের পেছনে কারা ছিল, সেটা কে অনুসন্ধান করবে? “পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের টাকা লেনদেনের কয়েকটি মোবাইল অ্যাকাউন্ট (বিকাশ, নগদ, রকেট) চিহ্নিত করে তা বন্ধ করে দেয়” (দেশ রূপান্তর, জানুয়ারি ২৬, ২০২২)। এই ধরনের পদক্ষেপ কেবল আইনের বিষয় নয়, এর সঙ্গে যুক্ত নাগরিকের অধিকারের প্রশ্ন। এই ধরনের ব্যবস্থা সবাইকে ভীত করার উদ্দেশ্যেই করা, এ কথা সহজেই বোঝা যায়।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁদের আন্দোলন কীভাবে চালাবেন, সেটা তাঁদের সিদ্ধান্ত। তাঁরা ইতিমধ্যে যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, তা প্রশংসার যোগ্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভয়াবহ অবস্থা এবং উপাচার্যদের নিয়োগ ও ভূমিকা এতে সাধারণের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। শিক্ষকদের এক বড় অংশের ভূমিকাও এখন আরও পরিষ্কার। এগুলো নতুন কিছু নয়, কিন্তু তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট করেছে এই আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো মানা হবে কি না, সেটা সহজেই দেখা যাবে এবং যারা মধ্যস্থতা করেছেন, তাঁদের দায়িত্ব সেটা নিশ্চিত করা। সেই কারণেই আমাদের চোখ আগামী দিনগুলোতেও সিলেটেই রাখা দরকার।