(৫৯তম জন্মজয়ন্তীতে আমার প্রিয় বন্ধু সঞ্জীবদাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা)
১৯৯৮ সালের কোনো এক শীতের সকালে মহাকাশ বার্তার কাজে আজিজ সুপার মার্কেটে যাই। নতুন গড়ে ওঠা বইয়ের মার্কেট এই আজিজ। আমার কাজ শেষে দেখা হয় সঞ্জীবদার সঙ্গে। সৌজন্য বিনিময়ের পর দাদাই বলেন,
—মদ খাবেন?
—এই সময়?
—এক বিদেশি বন্ধু গিফট দিয়েছে। খেতে চাইলে চলেন। এই মার্কেটের ওপরেই দিদির বাসা।
আমারও কাজ শেষ। আপাতত কোথাও যাওয়ার নেই। আর সঞ্জীবদার আমন্ত্রণে আমি গদগদ। এই সকালেই নির্ধারিত হয়ে যায়, আমরা আমৃত্যু কাছাকাছি থাকব।
সঞ্জীবদার সাথে প্রথম দেখা ১৯৯৭ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি। তখন বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রথম ক্লাস রুম প্ল্যানেটোরিয়াম তৈরি করা হয়। সেই প্ল্যানেটোরিয়াম তৈরির ওপর রিপোর্ট করার জন্য এক বিকেলে সঞ্জীবদা আর ফটোগ্রাফার আনিস ভাই চলে আসেন। সঞ্জীবদা সে সময় ভোরের কাগজের সাথে যুক্ত ছিলেন।
অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের যেকোনো অনুষ্ঠান হলেই সঞ্জীবদাকে দাওয়াত কার্ড পাঠাতে ভুলতাম না। যোগাযোগ বাড়তে থাকে। কোনো এক সময় জেনেও যাই, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের পিচ্চি এবং চটপটে সদস্য অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী অনন্যার মামা আমাদের সঞ্জীবদা।
—আমার ভাগনীটাকে দেখে রাখবেন। সে যেন বিজ্ঞানী হয়।
অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সেমিনার অথবা বুয়েটের মাঠে আকাশ দেখার ক্যাম্পে সারা রাতের সাথি সঞ্জীবদা। অ্যাসোসিয়েশনের পাশাপাশি আমার সাথেও গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।
সেবার ২০০০ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রথম সূর্য উৎসব আয়োজনের জন্য ঢাকা থেকে দুই বাসভর্তি অভিযাত্রী নিয়ে সেন্ট মার্টিন যাই। ২০০১-এর প্রথম সূর্যোদয় একই সাথে সহস্রাব্দের প্রথম সূর্যোদয়। সে সময় আমাদের পরস্পরকে ভালোভাবে জানাশোনার সুযোগ হয়। ফলে যেটা হয়, আমার উপস্থিতে সঞ্জীবদা পরবর্তী সময়ে পানাহার করলেও কারো ওপর রাগ করা বা ঝাড়ি দেওয়া, সেটা করতেন না। (সরি সঞ্জীবদা, আমাদের গোপন কথাগুলো বলে দিচ্ছি)
সঞ্জীবদার সাথে মজার একটা স্মৃতি সুযোগ পেলেই বন্ধু মহলে বলে থাকি। আমার বাসা কলাবাগান। দাদা থাকতেন মোহাম্মদপুর ফিজিক্যালের গলিতে। দুপুর ১টা হবে। কলাবাগান ক্লাবের গেট থেকে বাসায় যাচ্ছি, দাদা রিকশায় আমাকে অতিক্রম করছেন। চোখে চোখ পরতেই রিকশায় তুলে নিলেন।
—চলেন, এরামে।
—এই দুপুরে আবার গরম! আমি এখন খাব না। তবে আপনার সাথে যাব এবং শেষে আপনাকে ফিজিক্যালের বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসবো গান শোনাতে হবে।
এরামে দাদা নিজের জন্য বিদেশি একটা ব্র্যান্ডের অর্ডার করলেন। আমি নিলাম পরোটা আর গ্রিল। আমার খাবার চলে এলো আগেই। খাচ্ছি মজা করেই। পরে ওয়েটার এসে জানাল, দাদার অর্ডার দেওয়া ব্র্যান্ড শেষ হয়ে গেছে। দাদা আর অন্য কিছু নিলেন না। তখন বুঝলাম, আমি দাদার বন্ধুর থেকেও অনেক বড় কিছু। আর সেটাই দেখলাম বছর কয়েক পরে।
কোনো এক দুষ্ট লোকের প্ররোচনায়, এক ‘হলুদ সাপ্তাহিক‘ পত্রিকা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনকে নিয়ে একটি ভুল সংবাদ ছাপিয়েছে। দাদা সেটা দেখেই সাথে সাথে সেই ‘হলুদ সাপ্তাহিক’-এর সম্পাদককে একেবারেই ধুয়ে দিলেন। আমি ভাবতেও পারিনি, দাদা এতটা পছন্দ করেন আমাদের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কাজকে। সে জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ। এমন শুভাকাঙ্ক্ষী আর পাবে না অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন।
মহাকাশ বার্তা পত্রিকা প্রকাশ করব। টাকা কম পড়েছে। দাদা চেষ্টা করতেন সমস্যার সমাধান করতে।
ফেসবুকে আমার নাম মহাকাশ মিলন। এই মহাকাশ মিলন নামটা ভালোবেসে দাদা দিয়েছিলেন। ভোরের কাগজে তখন জমজমাট আড্ডা। সেই আড্ডায় আমার নামকরণ হয়ে যায় মহাকাশ মিলন। সে আড্ডার একজন আরিফ জেবতিক বিস্তারিত বলতে পারবেন।
সঞ্জীবদা, রাসেল ও’নীল এবং আমি—এই তিনজনের মিলিত আড্ডা হতো। তিনজনের মাঝে বোঝাপড়াটা ছিল বেশ চমৎকার।
সর্বশেষ আমি কেওক্রাডং পাহাড় হয়ে তাজিংডং পাহাড়ে যাই ২০০৭ সালে। সেই পাহাড়ের অভিযাত্রা নিয়ে একটা লেখা প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপার জন্য দিই। প্রথম আলোর শনিবারের সাময়িকী ‘ছুটির দিনে’-এর প্রচ্ছদ হিসেবে সেটা ছাপার সিদ্ধান্ত হয়। লেখাটার শিরোনাম ছিল, ‘আকাশে হেলান দিয়ে, পাহাড় ঘুমায় ঐ‘।
তখন ছুটির দিনের সম্পাদক ইকবাল চৌধুরী আমাকে বলল, এটা যেহেতু বিখ্যাত গানের কলি, তাই চেক করে নিতে হবে যেন ভুল না হয়। সে সময় গুগল ছিল কি না মনে করতে পারছি না। সঠিক কথাগুলো জানতে তখন তখনই সঞ্জীবদাকে ফোন করি। এবং সেটাই ছিল দাদার সাথে আমার শেষ কথা বলা। ঠিক তার তিন দিন পর দাদা হাসপাতাল হয়ে না-ফেরার দেশে চলে যান।
দাদা আমিও আপনার দেখানো পথে, আমার মৃত্যুর পর মৃতদেহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য দিয়ে যেতে চাই। ভালোবাসা প্রিয় সঞ্জীবদা।
লেখক : সম্পাদক, মহাকাশ বার্তা