• ঢাকা
  • সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১, ২৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদায় সুবিমল মিশ্র


অমর মিত্র
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৩, ০৪:২৩ পিএম
বিদায় সুবিমল মিশ্র

আজ, ৮-ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সাল, আজ ভোর ৪টে ৫০ মিনিটে সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন। বিশ্বেন্দু নন্দর লেখা থেকে জানলাম এখন। বাংলা ভাষার সত্যিকারের সকল প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক চলে গেলেন। এক্ষেত্রে তিনি একজন। আর কেউ নেই। ছিলেন না। এই পথ তাঁর নিজের পথ ছিল। বিশ্বাসে আর যাত্রাপথে কোনো তফাৎ ছিল না। অন্যদের ক্ষেত্রে দ্বিচারিতা দেখেছি। সুবিমল এক্ষেত্রে নিজেই এই পথের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে দূর থেকে নমস্কার করি।

পদবি-বর্জিত সুবিমল মিশ্র কোনো দিন একটি বর্ণও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকায় লেখেননি। আমি তাঁকে পড়েছি লিটল ম্যাগাজিনে। সুবিমল কোনো দিন সাহিত্যের প্রতিষ্ঠান, একাডেমির কাছ দিয়ে হাঁটেননি, আমি তাঁকে পড়েছি মানিক, তারাশঙ্কর পড়তে পড়তে নিজ প্রয়োজনে। তাঁর লেখার ভিতরে যে ঝাঁজ দেখেছি সেই চল্লিশ বছর আগে, তা আমাকে শিখিয়েছিল অনেক। আমি নিজে সুবিমলের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই সহমত নই, তাঁর পথ আর আমার পথ আলাদা। কিন্তু দূরে থেকেও আমি তাঁর লেখার অনুরাগী। বহু বছর তাঁর সঙ্গে কথা হয়নি, কিন্তু তাঁর রচনাবলীর আলোচক খুঁজে না পেয়ে আমাকে যখন অনুরোধ করেন অতি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান, আমি দুই খণ্ড পড়েই লিখেছি। মনে হয়েছিল তাঁর কথা সকলে জানুক। তাঁকে পড়ে বিচার করুক। 

এ কথা সত্য—সুবিমল যে পথে হেঁটেছেন, সাহিত্যের যে উপদ্রুত এলাকায় আমাদের নিয়ে গেছেন, নিজে পৌঁছেছেন, সেখানে তাঁর আগে কেউ পৌঁছতে পারেননি। আমাদের বেলগাছিয়া থেকে প্রকাশিত একাল পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন ‘বাগানের ঘোড়া নিম গাছে দেখন চাচা থাকতেন’ এবং ‘রক্তের স্বভাব’। তখন আমি সুবিমলকে পড়তে শুরু করি। সেই ১৯৬৯—৭০ থেকে। প্রথম পড়েছিলাম তাঁর গল্পের বই, ‘হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া কিংবা সোনার গান্ধীমূর্তি’। বইটি নেই, কিন্তু গল্পগুলো মনে আছে, শিরোনামের হারাণ মাঝির বিধবা... ব্যতীত বাগানের ঘোড়া নিম গাছে দেখন চাচা থাকতেন, পরী জাতক, আর্কিমিডিসের আবিষ্কার ও তারপর, রক্তের স্বভাব, পার্ক স্ট্রিটের ট্রাফিক পোস্টে হলুদ রং। এইসব গল্প লেখা হয়েছিল ১৯৬৯,৭০,৭১—এই সময়ে। সেই কঠিন সময়ে এক তরুণ লেখক তাঁর রক্তের উষ্ণতা, মনের দীপ্তি নিয়ে স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়েছেন এবং নিজের কলমকে ক্রমাগত শাণিত করেছেন। সুবিমল যে সাহিত্যের প্রচলিত পথ ত্যাগ করে যে দুর্গমতায় যাত্রা করেছিলেন সেই স্থান থেকে সরে আসেননি। তাঁর হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি গল্পে হারাণ মাঝির ২২ বছরের বিধবা বৌ না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল। তার ছিল আঁটো শরীর, সবাই তার শরীর নিয়ে মাথা ঘামাতে চায়, না পেয়ে বদনাম দেয়। তাই সে ম’লো। মরে খালের জলে তরতর করে ভেসে যাচ্ছে। এই গল্প একসময়ে আমাদের চিরাচরিত গল্পকে আঘাত করতে পেরেছিল, এখনো করে। হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া ভাসছিল, ভাসতে ভাসতে পচা খাল দিয়ে কলকাতা শহরে এসে পড়ে। তারপর সেই মড়া গিয়ে পড়ে থাকে রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সুখী গেরস্তর দরজায়। এই গল্প লেখা হয়েছিল যখন, তখন কেন, এখনো এই সাহিত্যের এই বাস্তবতা সত্য। সত্য সময়ের এই গা ঘিনঘিনে অভিঘাত। বর্গা চাষ রেকর্ড করাতে গিয়ে ভূমিহীন চাষা হারাণ মাঝি তার চাষের অধিকার হারিয়েছিল। চাষের জমি দখলে গিয়ে মার খেয়ে মাথা দুফাল হয়ে মরে। তার বিধবার মড়া রাষ্ট্রের ঘুম কেড়ে নেয়। একাই তার শবদেহ পারে যত্রতত্র গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শান্তিকে তছনছ করে দিতে। সামনে ছিল নিবার্চন, সেই উপলক্ষে ময়দানে মিটিংয়ে খুব হাঙ্গামা হয়। হাঙ্গামায় ভেঙে যায় মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি। আমেরিকা তখন বলে, তারা সোনার গান্ধী মূর্তি বানিয়ে কলকাতায় পাঠাচ্ছে। সেই মূর্তি এলো বাক্সবন্দি হয়ে। মন্ত্রী, সান্ত্রী হাজির, বিউগল বাজে, জাতীয় সংগীত হয়। এরপর বাক্স খোলা হয় সোনার গান্ধী মূর্তিকে স্যালিউট জানাতে। হায়, দেখা গেল, সেই সোনার গান্ধী মূর্তির উপরে শুয়ে আছে হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া। তাকে না সরালে, গান্ধীমূর্তিকে ছোঁয়া যাবে না। গল্পটি বছর পঁয়তাল্লিশ আগে লেখা, গল্পটি এখনো মনে হয়, গতকাল লেখা কিংবা আগামী কাল লেখা হতে পারে। সুবিমল মিশ্র যে গল্প একসময় লিখেছেন, তা আমাদের পাঠ অভ্যাসকে আঘাত করেছিল। যা কিছু আমাদের সাহিত্য বোধ, তাকে শিকড় সমেত উৎপাটিত করে সুবিমল নতুন কথা নিয়ে এসেছিলেন। নতুনভাবে শুনিয়েছেন গল্প।

একটি গল্পের কথা বলি, ‘আপনি যখন স্বপ্নে বিভোর, কোল্ড ক্রিম আপনার ত্বকের গভীরে কাজ করে’। ১৯৭৪-এ লেখা এই গল্প তার শিরোনামেই বুঝিয়ে দেয়, সুবিমল মিশ্র এই বিজ্ঞাপিত-পণ্য নিয়ন্ত্রিত সভ্যতার কথা কত বছর আগে কীভাবে বলেছিলেন। এই গল্প বা প্রতি-গল্প (অ্যান্টি গল্প) যতি চিহ্নহীন করে লেখা। আর সমস্তটাই বিজ্ঞাপনের ভাষা। যে বিজ্ঞাপন সেই চল্লিশ বছর আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো, সুবিমল সেই বিজ্ঞাপন সাজিয়ে এমন এক নির্মাণ করেছেন, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান এবং সুখী গৃহকোণকে বিব্রত করার পক্ষে অনেক। কী লিখছেন সুবিমল তা একটু দেখি, “দাদ একজিমা সারিয়ে নিন চুলকানি সব সারিয়ে নিন ফুলের সুরভি শ্বাসে-প্রশ্বাসে মধুর পুলক ভেসে ভেসে আসে নাচুন নাচুন ধেই ধেই নাচুন ফিরিয়ে আনুন ত্বকের স্বাস্থ্য ট্যাঁকের স্বাস্থ্য যেটুকু না হলে নয় সেটুকুতেই কেনাকাটা সমঝে রাখুন দেখবেন দর বাড়বে না অসাধু ব্যবসায়ীরে পরাস্ত করুন কেমনে হে ক্রেতা ক্রেতা হে...” সুবিমল এই অ্যান্টি গল্পে আমাদের গল্পের প্রচলিত ধারাকেই যেন চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। হ্যাঁ, এর ভিতরেও গল্প আছে, “পাত্র আছে পাত্রী আছে গিটার নিপুণা সুচাকুরে উজ্জ্বল শ্যাম বহুত আছে পাঁচফুট তিন ইঞ্চি ভক্তিমতী রসবতী রাঁধিতে পারে বাঁধিতে পারে প্রয়োজন বোধে কাঁদিতে পারে চটপট করুন...।” সুবিমল পরিহাস করেছেন সুখী মধ্যবিত্তের স্বপ্ন বিভোরতা নিয়ে, এই বিভোরতা এখন আরো আরো থকথকে হয়েছে। আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা ফুটে ফুটে ক্ষীর হয়েছে।

আর একটি গল্পের কথা বলি, নুয়ে গুয়ে দুই ভাই ( ১৯৭৩)। এই গল্প বলতে বসেছেন তিনি যেন কথক ঠাকুর হয়ে। “তারা ছিল দুই ভাই নুয়ে আর গুয়ে। আপন বলতে তাদের কেউ ছিল না এক দুঃসম্পর্কের মাসি ছাড়া।” সুবিমলের এই গল্প একেকেবারেই প্রচলিত গল্পের আদলে বলা। কিন্তু তার ভিতরে চারিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রখর সমাজ বোধ। জীবনবোধও নিশ্চয়। বখাটে আর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মাসি তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। নুয়ে গুয়ে একটি খেজুর গাছের গুঁড়িতে বসে ভাবে কী করে জীবনে উন্নতি করা যায়। বড় ভাই নুয়ে বলল, বেসাতি করবে, চালাক ছোট ভাই গুয়ে বলল, বাসাতি করার কড়ি আসবে কোথা থেকে? তার চেয়ে ওয়াগন ভাঙা অনেক ভালো, ওয়াগন ভেঙে শিবুর দল লাখোপতি হয়ে গেছে। তারা তখন ওয়াগন ভাঙতে গেল নিঝুম রাতে। চারদিকে কুয়াশা, জনমনিষ্যি নেই। ওয়াগান ভেঙেই তারা বড়লোক হয়ে যাবে, তো কাজের সময় সেই অন্ধকারে এক গান্ধীটুপি এসে খাঁচ করে তাদের হাত ধরে ফেলল। তারা ভয়ে তেত্রিশ কোটি দেবতার স্মরণ নিতে লাগল। নুয়ে গুয়েকে সেই গান্ধীটুপি দয়া করল। তাদের আরো বড় উন্নতির ব্যবস্থা করল ওয়াগন থেকে কীভাবে নিজের মাল সরিয়ে তার নিজের গোডাউনে আগেই ঢুকিয়ে নেবে, সেই উপায় শিখিয়ে দিল। রেল ক্ষতিপূরণ দেবে, আবার নিজের মাল নিজের ঘরেও থাকবে। এই গল্প যেন এক আধুনিক অ-রূপকথা। নুয়ে গুয়েকে দিয়ে কাজ হাসিল করে তাদের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় সেই গান্ধীটুপি। এখনো পড়তে গিয়ে গা হিম হয়ে আসে।

সুবিমল রাজনৈতিক কথা বলেন তাঁর সমস্ত গল্পে। তাঁর মতামত খুব স্পষ্ট, কিন্তু তা কখনোই ছকে বাধা ক্লিশে হয় না তাঁর বলার গুণে। তাঁকে নিয়ে অনেক কথা হোক। মৃত্যু তো লেখকের বেঁচে থাকার শেষ কথা নয়। আবার বলি সুবিমল মিশ্র ছিলেন আমাদের ভাষার একমাত্র অপ্রাতিষ্ঠানিক লেখক। আর কেউ নন।
তাঁকে আমার শেষ নমস্কার।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক, পশ্চিমবঙ্গ

Link copied!