• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে কিছু কথা


সেলিম জাহান
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২৪, ০২:২৪ পিএম
বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে কিছু কথা

মাত্র কদিন আগে সাহিত্যের নানান বিভাগে ২০২৩ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার ঘোষিত হল। তার রেশ কাটতে না কাটতেই অতি দ্রুত তিনটি ব্যাপার ঘটে গেলো—এক, পুরস্কারপ্রাপ্ত দু-একজনের পুরস্কার প্রাপ্তি সম্পর্কে কিছু গুঞ্জন উঠেছে। দুই, পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের মধ্যে এক-দুজনার বিরুদ্ধে লিখিতভাবে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়েছে এবং তিন, অতীতে পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন সাহিত্যিক তার পুরস্কার একাডেমিকে ফেরত দিয়েছেন। তার অভিযোগ, বেশ কিছু কাল ধরে একাডেমির নানান প্রক্রিয়ায় যথাযথ নিয়ম-কানুন পালিত হচ্ছে না এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে একাডেমির মান নেমে যাচ্ছে।

এই তিনটি অভিযোগের মধ্যে প্রথমটি পুরোনো, প্রতিবছরই কিছু কিছু মনোনয়ন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, কোনো কোনো পুরস্কারপ্রাপ্তদের সম্পর্কে কথা ওঠে। কোনো সাহিত্যিকের বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তিতে যখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা এমন মন্তব্য করেন, ‘যোগ্য মানুষকেই সম্মান করা হয়েছে’, কিংবা ‘ওঁর অনেক আগেই এ স্বীকৃতি পাওয়া উচিৎ ছিল’—তখন বুঝতে হবে যে সম্মাননাটি যথাস্থানেই পৌঁছেছে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পুরস্কারপ্রাপ্তিতে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। বরং এ জাতীয় মন্তব্য হচ্ছে পুরস্কারের ব্যাপারে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অনুমোদন।

এ মন্তব্য দুটোর বাইরে যখন পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তখনই বিষয়টি জটিল হয়ে ওঠে। যেমন, পুরস্কার যিনি পেলেন, তার অবদান বিষয়ে অস্বচ্ছতা থাকলে কিংবা তার কাজের মানের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে। আমার এক বন্ধু বলেন, ‘পুরস্কার পেয়ে মানুষ মহিমান্বিত হয় না, মহিমান্বিত মানুষদেরই পুরস্কার দিয়ে পুরস্কার সম্মানিত হয়।’ অন্য কথায়, পুরস্কার দিয়ে মানুষ চেনাতে হলেই মুশকিল। সেটা হলে সাধারণ মানুষের চোখে পুরস্কারপ্রাপকদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ আগে উঠেছে বলে শুনিনি। অন্যদিকে পুরস্কার ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ নতুন। উত্থাপিত এ জাতীয় নানান অভিযোগগুলো সত্যি কি মিথ্যা, সেটা বড় কথা নয়; বরং এ সব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের নির্ণায়ক ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু কাঠামোগত বিষয় সম্পর্কে কিছু কথা বলা যেতে পারে।

প্রথমত: আমি যতটুকু জানি, বাংলা একাডেমি পুরস্কার কোনো একজন ব্যক্তির কোনো বিশেষ কাজের জন্যে দেওয়া হয় না; বরং সাহিত্যের কোনো একটি শাখায় একজন ব্যক্তির জীবনব্যাপী অবদানের জন্যে দেওয়া হয়। কিন্তু জীবনব্যাপী অবদান গড়ে তুলতে হলে একটি ন্যূনতম ও বয়সের প্রয়োজন আছে। যতই প্রতিভাবান হোন না কেন, একজন ৩০ বা ৪০ বছরের সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম তার জীবনব্যাপী অবদান হতে পারে না—তার দীর্ঘ জীবন এবং তার আরও সৃজনশীল কর্মের ক্ষেত্র তখনো পড়ে আছে।

সেইসঙ্গে এটাও সত্য যে বাংলা একাডেমির মতো অত্যন্ত সম্মানজনক একটি পুরস্কার প্রাপকের কাছে জনগণের শুধুমাত্র সাহিত্যকর্মের উৎকর্ষতাই বিবেচ্য বিষয় নয়, তার অঙ্গীকার, তার অখণ্ডতা, তার মূল্যবোধ, তার একনিষ্ঠতাও গুরুত্বপূর্ণ। একটা বয়সে না পৌঁছুলে এগুলো একটি শক্ত পরীক্ষিত ভূমির ওপরে স্থিত হতে পারে না।

এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি, বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার জন্যে একটি ন্যূনতম বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া দরকার। প্রজ্ঞায়, অভিজ্ঞতায়, অঙ্গীকারে পরীক্ষিত একটি ভূমিতে পৌঁছুতে হলে সেই ন্যূনতম বয়সসীমাটি দরকার। যারা তরুণ সাহিত্যিক, তাদের স্বীকৃতির জন্যে দুস্তর সময় ও পথ পড়ে আছে।

দ্বিতীয়ত: বর্তমানে বাংলা একাডেমি পুরস্কার অনেক বেশী ছড়ানো ও বিভাজিত। এ বছর মোট ১১টি শাখায় পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বিষয়বস্তুর কেন্দ্রীভূতকরণ আলগা হয়ে গেছে। অন্যদিকে, একই সার্বিক শাখার মধ্যে একাধিক প্রশাখা ঢোকানো হয়েছে। যেমন, নাটক ও নাট্যসাহিত্যের মধ্যে যাত্রা/পালা, নাটক/ সাহিত্য বিষয়ক আর্ট ফিল্ম বা নান্দনিক আর্টফিল্ম)। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা একটা জগাখিচুড়ি এবং অর্থহীনতায় দুষ্ট।

আমি মনে করি, পুরস্কারের বিষয়াবলী কমিয়ে এনে মৌলিক কিছু  ন্যূনতম প্রধান বিষয়ে বাংলা একাডেমি পুরস্কারকে সীমিত করা দরকার। যেমন, কবিতা, কথাসাহিত্য, নাটক, অনুবাদ ইত্যাদি। দেশে অন্য প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে অন্যান্য শাখাগুলোর পুরস্কার বিকেন্দ্রীকৃত করা যেতে পারে। যেমন, শিশু সাহিত্যকে কি শিশু একাডেমির আওতায় আনা যায় না?

তৃতীয়ত: যারা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবেন, তাদের বাংলা একাডেমির কাছে একটি হলফনামা দিতে হবে যে তাদের পুরো সাহিত্যকর্ম তাদের নিজস্ব, এবং তার কাজে তিনি যদি অন্যের কাজ থেকে উদ্ধৃত করেছেন, কিংবা সহায়তা নিয়েছেন, সেগুলো খুব পরিষ্কারভাবে স্বীকৃত হয়েছে। এটা করলে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ এবং চৌর্যবৃত্তির সুযোগ কমে যাবে।

সেই সঙ্গে সঙ্গে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠলে সে অভিযোগ লিখিতভাবে একটি পূর্বগঠিত পর্ষদের সামনে পর্যালোচনার জন্যে উপস্থাপন করা যেতে পারে। সবকিছু বিবেচনার পরে সে পর্ষদ তার সিদ্ধান্ত জানাতে পারে। অভিযুক্ত হলে সংশ্লিষ্ট লেখকের কাছ থেকে পুরস্কার প্রত্যাহার করা হবে।

চতুর্থত: কোন কোন নির্ণায়কের ভিত্তিতে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেয়া হয় এবং কী কী প্রক্রিয়া এতে অনুসরণ করা হয়, সেটে একটি অঙ্গনের বাইরে তেমনভাবে দৃশ্যমান নয়। এ ব্যাপারে সাধারণ জনমনে যথেষ্ট বিভ্রান্তি রয়েছে। যেহেতু বাংলা একাডেমি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সুতরাং বাংলা একাডেমি পুরস্কারের নির্ণায়ক এবং এ পুরস্কারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানার অধিকার জনগণের আছে। অতএব এ সংক্রান্ত নীতিমালা ব্যাপক এবং পরিষ্কারভাবে জন জীবনের সামনে তুলে ধরা দরকার। এ দৃশ্যমানতার ফলে এ পুরস্কারের গুরুত্ব, বস্তুনিষ্ঠতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং তার প্রক্রিয়ার দৃশ্যমানতা সমাজে বৃদ্ধি পাবে।

পঞ্চমত: বাংলা একাডেমি পুরস্কারের বর্তমান অর্থমূল্য এক লাখ টাকা। বহুদিন ধরেই এ অর্থমূল্য অপরিবর্তিত আছে। বর্তমান সময়ের সমাজ ও অর্থনীতির বাস্তবতার নিরিখে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের অর্থমূল্য অন্তত পাঁচ লাখ টাকা করা উচিত।

বাংলা একাডেমি পুরস্কারের পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা, কর্মকাণ্ডের বিষয়ে নানান কথা উঠেছে। সেগুলো সত্য না মিথ্যা, তা গৌণ। কিন্তু অনিয়ম সম্পর্কে কথা যখন উঠেছে, সেগুলো পর্যালোচিত হওয়া দরকার। একটি পর্যালোচনা পর্ষদ গঠনের মাধ্যমে এ জাতীয় মূল্যায়ন করা যায়। মূল্যায়নের সুপারিশসমূহ একাডেমির ভবিষ্যত কর্মকাণ্ডকে চালিত করবে।

যে বিষয়গুলো উত্থাপিত হয়েছে এবং যে সব প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো সর্বদিক স্থিত বা সার্বিক এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে এগুলো একটি বস্তুনিষ্ঠ কার্যক্রম শুরু করে পুরো ব্যাপারটিকে একটি বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্য ভূমির ওপরে প্রতিস্থাপিত করতে পারে।

Link copied!