পরীমনি ও জার্মানির একটি সিনেমা


ফরিদুর রহমান
প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২১, ১১:২৭ এএম
পরীমনি ও জার্মানির একটি সিনেমা
চিরায়ত চলচ্চিত্র/৪৮:  লস্ট অনার অফ ক্যাথারিনা ব্লুম (The Lost Honour of Katharina Blum) পশ্চিম জার্মানি: ১৯৭৫।
পরিচালনা:  ভোলকার সলোন্ড্রফ ও মার্গারেট ফন ট্রোটা। 

নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক হাইনরিখ বৌলের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘লস্ট অনার অফ ক্যাথরিনা ব্লুম’ সত্তুর দশকের মাঝামাঝি পশ্চিম জার্মানিতে পুলিশি হয়রানি, পত্রপত্রিকার অপপ্রচার ও জনগণের ঔসুক্যের কারণে বিপর্যস্ত এক নারীর কাহিনী। একটি চলচ্চিত্র কিভাবে ভিন্ন দেশে ভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপটে পঞ্চাশ বছর বা তার পরেও প্রাসঙ্গিক এবং সমসাময়িক হয়ে উঠতে পারে, এই ছবিটি তার উদাহরণ। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তা কমিশনার ওয়াল্টার মাডিংয়ের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ক্যাথরিনার ঘণ্টা বাজানোর মধ্য দিয়ে ছবিটির শুরু। তবে কাহিনীর শুরু এখানে নয়, বরং শেষের এই দৃশ্যটি থেকেই দর্শককে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় যেখান থেকে ক্যাথারিনার স্বাভাবিক জীবনে বিপর্যয়ের সূত্রপাত।   

শৈশবে বাবার মৃত্যুর পরে অভাব অনটনের সংসারে দায়িত্ব অনেকটাই নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয় ক্যাথারিনাকে। মাকে বাড়ির কাজে সাহায্য করার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যায়। এরই মধ্যে রান্নাবান্না, ঘরদোর পরিষ্কারসহ গৃহকর্মে পারদর্শী হয়ে ওঠে সে। ক্যাথারিনা একটা বিয়েও করেছিল, কিন্তু এক বছরও টেকেনি সে বিয়ে। গডমাদার এলিসার পরামর্শে গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে স্নাতক পাশ করে সে সম্মানজনকভাবে হাউসকিপিংয়ের কাজ শুরু করে। তার পরিশীলিত জীবন যাপনে সন্তুষ্ট করপোরেট আইনজীবী হিউবার্ট এবং তার স্ত্রী ট্রুডের প্রিয় হয়ে ওঠে ক্যাথরিন। তাদের সহায়তার একটা অ্যাপার্টমেন্টও সে কিনে ফেলে। 

গডমাদার এলসির দেওয়া একটা পার্টিতে পলাতক সন্ত্রাসী লুডউইগের সাথে পরিচয়ের পরপরই ক্যাথারিনার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শিগগিরই এক সোর্সের মাধ্যমে পুলিশ জানতে পারে ক্যাথারিনার অ্যাপার্টমেন্টে রাত কাটাচ্ছে লুডউইগ। 

ব্রেকফাস্টের আগেই পুলিশ ক্যাথারিনার ফ্ল্যাটে অভিযান চালায়। পুলিশের অবস্থান বুঝতে পেরে ক্যাথরিন তার প্রেমিককে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। একজন খুনি এবং সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দেওয়া ও পালাতে সাহায্য করার অপরাধে ক্যাথারিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে নাস্তা করার এবং এমনকি পোশাক পাল্টাবারও সময় দেওয়া হয় না। মেয়েটিকে গ্রেপ্তার করে উপর থেকে নিচে নামিয়ে আনার সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য এবং ট্যাবলয়েট পত্রিকার রিপোর্টার ফটোগ্রাফার ছাড়াও অসংখ্য কৌতূহলী মানুষ সেখানে ভিড় করে। এরপর থেকেই পুলিশের জেরা, রিপোর্টারদের বানোয়াট কাহিনী এবং প্রতিবেশীসহ স্বজনদের অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য ক্যাথারিনার জীবন দুর্বিষহ করে ফেলে। পুলিশ, গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ ক্যাথারিনার সাতাশ বছর বয়সের দেহটিকেই সন্ত্রাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক বাহন হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবচ্ছেদ করতে আরম্ভ করে। কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা একযোগে একজন গ্রেপ্তারকৃত নারীকে হেনস্তা করার সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করতে থাকে।   

ছবির একটি দৃশ্য

জিজ্ঞাসাবাদের নামে নামে পুলিশ নানাভাবে ক্যাথারিনাকে অপদস্থ করে। নির্মোহ জীবনাচারের জন্য এতদিন মিসেস ব্লনার যাকে ‘নান’ বলে সম্বোধন করতেন, সেই ক্যাথারিনাকে গোয়েন্দা পুলিশের নানা অশ্লীল আচরণ ও অরুচিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। ক্যাথারিনার ফ্ল্যাটে একটি দামি হিরার আংটি এবং কয়েকটি প্রেমপত্র উদ্ধার করে পুলিশ। ধারণা করা হয় এই আংটি লুডউইগের চোরাইমাল। হিরার আংটিটি কে দিয়েছিল জানার জন্যে চাপ প্রয়োগ করে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। কিন্তু ক্যাথরিন কিছুতেই তার নাম বলতে রাজি হয় না। কারণ সে জানতো রক্ষণশীল দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং অর্থনীতিবিদ এ্যালয় স্ট্রব্লেন্ডারের নাম বললে কেউ বিশ্বাস করবেন না। এই প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদও ক্যাথরিনের প্রেমে পড়েছিলেন এবং মেয়েটিকে তার বাগান বাড়ির একটা চাবিও দিয়ে রেখেছিলেন। গ্রামের সেই বাড়িতে নিজে না গেলেও প্রেমিক লুডউইগকে আত্মগোপনে থাকার জন্য চাবিটা দিয়েছিল ক্যাথরিন। 

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি ক্যাথরিনকে জড়িয়ে পত্র পত্রিকায় একের পর এক মিথ্যা অথচ মুখরোচক খবর পরিবেশিত হতে থাকে। বিশেষ করে ‘দ্য নিউজ’ পত্রিকার রিপোর্টার ওয়ার্নার টটগেজ ক্যাথারিনার সাথে সম্পর্কিত এবং বিভিন্ন সময়ের পরিচিত মানুষ ও পুরোনো সহকর্মীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে, যার বেশিরভাগই মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ। ক্যাথরিনের বিয়ে, যৌনজীবন এবং অর্থসম্পদ সম্পর্কে রঙ চড়িয়ে বিরতিহীনভাবে প্রচারে নামে কিছু পত্রিকার প্রতিবেদক ও তাদের ফটোগ্রাফার। পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রতিদিনই ক্যাথরিনের ছবি ছাপা হয়। তৎকালীন জার্মান সরকারের জন্য সবচেয়ে স্পর্শকাতর যে বিষয়, সর্বত্র কমিউনিস্টের ভূত দেখা, তাও প্রয়োগ করে ওয়ার্নার। ক্যাথরিনের নিয়োগকর্তা আইনজীবী হিউবার্টকে কমিউনিস্ট হিসাবে চিহ্নিত করে ‘দ্য নিউজ।’

পরিচিতজনদের প্রায় সকলেই ক্যাথরিনকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। ন্যায় বিচার পাবার আশা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে যেতে এবং ‘দ্য নিউজ’-এর মিথ্যা প্রচারণা থেকে রক্ষা পেতে সে নিজেই একটি পরিকল্পনা করে। একটি এক্সক্লুসিভ এবং সর্বশেষ ইন্টারভিউয়ের জন্য ওয়ার্নার টটগেজকে একটি কফিশপে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু সে ক্যাথরিনের অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসে। সেখানে সে ক্যাথরিনকে বিছানায় যাবার প্রস্তাব করে। ক্যাথরিন রাজি না হলে রিপোর্টার ওয়ার্নার টটগেজ তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে এবং ক্যাথরিনের পিস্তলের উপর্যুপরি গুলিতে নিহত হয়। এরপরই ক্যাথরিন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে আত্মসমর্পণ করে।

ক্যাথরিনের প্রেমিক লুডউইগও ধরা পড়ে। জানা যায়, সে কখনো ব্যাংক ডাকাতি করেনি আর খুন করার তো প্রশ্নই ওঠে না। নেহায়েতই সামান্য অপরাধমূলক কাজে যুক্ত লুডউইগ তার কৃতকর্মের চেয়ে অনেক বড় অপরাধের সন্দেহ মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। কারাগারে অল্প সময়ের জন্য লুডউইগের সাথে দেখা হয় ক্যাথরিনার। গভীর আবেগে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। তাদের স্বপ্ন ছিল, দুজনে মিলে একটি রেস্তোরাঁ খুলবে তারপরে সাধারণ মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনে ছেলেমেয়ে নিয়ে একটি সুখের সংসার গড়ে তুলবে, তা আর কখনোই বাস্তবায়িত হবে না। 

‘লস্ট অনার অফ ক্যাথরিনা ব্লুম’ অনেক সময়েই প্রামাণ্যচিত্রের আদলে চিত্রায়িত। কিছু কিছু দৃশ্যের চিত্রায়ন এবং সম্পাদনার সাথে স্পাই থ্রিলারের মিল পাওয়া যায়। ক্যাথরিনার ফ্ল্যাটে পুলিশের অভিযান কিংবা গ্রাম থেকে লুডউইগকে গ্রেপ্তারের দৃশ্যগুলো দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী পাকড়াও করার হলিউডি ছবির দৃশ্যের মতো ব্যাপক আয়োজনের সমঞ্জস্য রয়েছে। ক্যাথরিন ও লুডউইগের অন্তরঙ্গ দৃশ্যসহ ক্যাথরিনের উপস্থিতির অনেক দৃশ্য মনে হয় ইচ্ছাকৃতভাবে কম আলোতে ধারণ করা হয়েছে। শান্ত ও নম্র অথচ প্রয়োজনে জ্বলে ওঠার মতো দৃঢ় তরুণীর ভূমিকায় এ্যাঞ্জেলা উইঙ্কলারের অভিনয় অসাধারণ বাস্তবানুগ। অবশ্য সাতাশ বছর বয়সের তুলনায় তাকে একটু বেশি বয়সের বলে মনে হয়। 

‘লস্ট অনার অফ ক্যাথরিনা ব্লুম’এর শেষ দৃশ্যটির চিত্রায়ন নিঃসন্দেহে বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। ওয়ার্নার টটগেজের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে ‘দ্য নিউজের’ সম্পাদক তার জ্বালাময়ী ভাষণে বলেন, ‘রিপোর্টার টটগেজ হত্যাকাণ্ড গণতন্ত্র এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ!’ সবশেষে ওয়ার্নার টটগেজের কফিনে পুষ্পমাল্যের স্তূপের ওপরে ভেসে ওঠে. ‘এই গল্পের কাহিনী ও চরিত্র পুরোপুরি কাল্পনিক। যদি কোনো সংবাদপত্র বা সাংবাদিকের কাজের সাথে এই কাহিনীর মিল পাওয়া যায় তবে তা যেমন উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়, তেমনি দৈবক্রমে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাও নয়, তবে অবশ্যই অনিবার্য।

Link copied!