পাকিস্তানে ইমরান খান সরকারের পতন ঘটেছে। সারাদিন ধরে নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ, মধ্যরাতের আগের মুহুর্তে স্পীকার এবং ডেপুটি স্পীকারের পদত্যাগ এবং অধিবেশন থেকে পাকিস্তান তেহরিক–ই-ইনসাফ দলের সদস্যদের প্রস্থান স্বত্বেও যা গত মার্চ মাস থেকেই অবশ্যম্ভাবী বলেই মনে হচ্ছিলো তাই ঘটেছে। পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ হয়েছে। কিন্ত লক্ষ্যনীয় যে, প্রয়োজনীয় ১৭২ ভোটের থেকে মাত্র দুটি বেশি ভোটে প্রস্তাব পাশ হলো যদিও গত কয়েক দিনে মনে হচ্ছিলো বিরোধীরা তাঁদের পক্ষে অনেক সমর্থন জোগাড় করতে পেরেছেন। এর আগে শনিবার রাতে ইমরান খান তাঁর মন্ত্রীসভার বৈঠক করেন, পার্লামেন্টের অধিবেশন একাধিকবার মুলতুবি করা হয়, মধ্যরাতে প্রধান বিচারপতি আদালত বসানোর উদ্যাগও নেন এবং দেশের রাজনীতির অন্যতম শক্তি সেনাবাহিনীর প্রধান ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
যদিও সন্ধ্যা থেকে কোনও কোনও গণমাধ্যমের খবরে সেনাবাহিনীর কথিত ‘ক্যু ব্রিগেড’ – সেনাবাহিনীর ১১১ ইনফেনট্রি ব্রিগেড – প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে উপস্থিত হয়েছে জানিয়ে ইঙ্গিত ছিলো যে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল অত্যাসন্ন। কিন্ত এখন পর্যন্ত তা ঘটেনি (এই ধরণের পরিস্থিতির সম্ভাবনার কথা আমি আগে লিখেছিলাম, ‘শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে কী হতে চলেছে’ প্রথম আলো অনলাইন, ৪ এপ্রিল ২০২২)।
ইতিমধ্যেই এটা স্পষ্ট যে, বিরোধী দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চলেছে। বিরোধী দলের নেতা শাহবাজ শরীফ রোববার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করবেন এবং ১১ এপ্রিল নতুন সরকার গঠন করা হবে। কিন্ত এই সব ঘটনা পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের অবসান ঘটিয়েছে তা নয়। ইমরান খান তাঁর দলের কর্মীদের ১১ এপ্রিল বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন – ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের’ এই ডাক তাঁর কর্মীরা কীভাবে নেন সেটা একটা প্রশ্ন, ইতিমধ্যে পিটিআই আদালতেরও শরনাপন্ন হয়েছে।
এগুলো হচ্ছে আগামী কয়েক দিনের সম্ভাব্য ঘটনা, কিন্ত দুটি সংকট নতুন সরকারের জন্যে অপেক্ষা করে আছে – অর্থনীতির বেহাল অবস্থা এবং নিজেদের মধ্যেকার মতপার্থক্য। গত কয়েক মাসে ইমরান খান এবং তাঁর সরকার ক্রমাগত জনপ্রিয়তা হারিয়েছে, কিন্ত তাঁদের সমর্থন এখনও আছে। ইতিমধ্যেই ইমরান খান একটা বড় রাজনৈতিক সাফল্য লাভ করেছেন। তিনি তাঁর সরকারের পতনের জন্যে দায়ী করেছেন বিদেশি ষড়যন্ত্রকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অঙ্গুলি সংকেত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছে। এই ঘটনার ফলে এখন ইমরান খানের সরকারের পতনের আলোচনা সাধারন মানুষের দুঃখ-দুর্ভোগের কারণে ঘটেছে তা যতটা না বলা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি বলা হচ্ছে ‘বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্র’-এর কথা, পক্ষে এবং বিপক্ষে। ফলে আগামী দিনগুলোতে এই সব আলোচনাই অব্যাহত থাকবে। অর্থনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন না করা গেলে এর দায় পড়বে নতুন সরকারের ওপরে। তাঁদের জন্যে এটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের মধ্যেকার ঐক্য কতটা দৃঢ় তার পরীক্ষা ১১ এপ্রিলেই শুরু হবে।
এই সরকারের মেয়াদ কতদিন সেটাও প্রশ্ন। সাংবিধানিকভাবে বিবেচনা করলে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পরবর্তী নির্বাচন হবার কথা। কিন্ত ততদিন নতুন সরকার টিকে থাকবে কীনা সেটা নিয়ে সংশয়ের কারণ আছে। ১৯৯৩ সালে আদালতের রায় নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে নাওয়াজ শরীফ তাঁর মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। এপ্রিল মাসে তাঁর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেন প্রেসিডেন্ট গুলাম ইসহাক খান। আদালতের রায়ে নাওয়াজ শরীফ ক্ষমতায় ফেরেন মে মাসে। কিন্ত ১৮ জুলাই তিনি ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্টকেও পদত্যাগ করতে হয়েছিলো। এর আগে দুই সপ্তাহ ধরে নাওয়াজ শরীফ, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা বেনজির ভুট্টো এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে আলোচনা হয়েছিলো। এই আলোচনার পেছনে ছিলো যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাইরের শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপের কারনেই পাঁচ মাসের রাজনৈতিক সংকটের সময়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে যে নির্বাচন অনুষ্টিত হয় তার ফলাফল স্মরণ করা দরকার - আসনের দিক থেকে পিপলস পার্টি বেশি পেলেও, ভোট পেয়েছিলো নাওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগের চেয়ে কম। এখন যে নতুন সরকার আসবে তাঁদের পক্ষেও পুরো মেয়াদ শেষ করা সম্ভব হবে কীনা সেটাই দেখার বিষয়। ইতিমধ্যে দেশে যদি সহিংসতা দেখা দেয় তবে অবস্থা নতুন দিকে মোড় নেবে। এসবই ইঙ্গিত দিচ্ছে সামনের দিনগুলোতে আমাদের চোখ পাকিস্তানেই নিবদ্ধ থাকবে।