একটি সময় ছিল যখন ঢাকা কলেজ এবং নটরডেম কলেজের মধ্যে থাকতো তুমুল প্রতিযোগিতা। তখন মাধ্যমিক পাশের পর উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে চাওয়া শিক্ষার্থীদের কাছে ঢাকা কলেজ ছিল সবচেয়ে আরাধ্য কলেজ। ঢাকা কলেজ ছিল তারকা শিক্ষক দিয়ে ভরপুর। এখান থেকে পাশ করে অনেকে বিশ্ববরেণ্য স্কলার গবেষক হয়েছেন। বিশ্ববরেণ্য গবেষক মেঘনাদ সাহা এই কলেজ থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন। বর্তমানে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের Eugene Higgins Professor জাহিদ হাসানও ঢাকা কলেজ থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক করেছিলেন।
এইরকম দেশ ও বিদেশে প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রথিতযশা স্কলার ও বিজ্ঞানী এই ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। ঢাকা কলেজ এবং নটরডেম কলেজ ছিল বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডার গ্রাজুয়েট ফিডার। ঠিক যেমন আমেরিকার লিবারেল আর্টস কলেজগুলো হলো আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গ্রাজুয়েট ফিডার।
আজ আর ঢাকা কলেজের সেই নাম ডাক নেই। তবে আগের সুনামের কারণে এখনো অনেক ভালো ছাত্র ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে ভর্তি হয়। কিন্তু এর সুনাম দিন কি দিন ফেড হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কী এবং কবে থেকে এর ধ্বংস শুরু? একটু গভীরে গেলেই বোঝা যাবে যেদিন থেকে এই কলেজে অনার্স মাস্টার্স চালু হয়েছে সেই দিন থেকেই এর সুনাম ধ্বংস হওয়া শুরু হয়েছে। শুধু ঢাকা কলেজ না। বাংলাদেশের অধিকাংশ ভালো কলেজের মান নিচের দিকে নামতে থাকে সেই কলেজগুলোতে অনার্স মাস্টার্স চালু হওয়ার দিন থেকে। এর ফলে হয়েছে কি ওই কলেজগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশুনার গুরুত্ব হ্রাস পায়।
অনার্স মাস্টার্স চালু মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর। অর্থাৎ ওগুলো একই সাথে সাধারণ কলেজ এবং অসাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু অনার্স মাস্টার্স পড়ানোর জন্য যথেষ্ট ভালো মানের শিক্ষক, গবেষক, ল্যাব ইত্যাদি তো কখনোই ছিল না। সে যাই হউক অনার্স মাস্টার্স খোলার কারণে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা তার গুরুত্ব হারায়। আর অনার্স মাস্টার্স চালু হওয়ার কারণে অনার্স মাস্টার্সের ছাত্ররাই তাদের বয়স, সংখ্যা এবং রাজনীতির কারণে হয়ে পরে মূল স্রোত। চলে ধুমিয়ে রাজনীতি।
শুধুই যে ঢাকা কলেজ নষ্ট হয়েছে তা না। বিএম কলেজ, বিএল কলেজ, আনন্দমোহন কলেজ, এমসি কলেজ ইত্যাদি অনেক খ্যাতিমান কলেজেরও রূপান্তর ঘটেছে। এইগুলোর অধিকাংশই এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স মাস্টার্স চালু। আবার একই সাথে শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিকও চালু। এটাও একটা কনফ্লিক্ট। সব মিলিয়ে কলেজগুলোর মান হারানোর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ছাত্র ফিডার হিসাবে বাংলাদেশে এখন কেবল নটরডেম, সেইন্ট জোসেফ, হলিক্রস ইত্যাদি কয়েকটি মিশনারি কলেজই আছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো কিছু ভালো ছাত্র পায় এইসব মিশনারি কলেজসহ কিছু বেঁচে যাওয়া কলেজ যেমন Rajuk Uttara Model College, রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ ইত্যাদি।
দেশে এখন শত শত বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। কিন্তু তার জন্য সেই সমানুপাতে ফিডার কলেজ তৈরিতো হয়ইনি উল্টো কমেছে। বিশ্ববিদ্যালয় হলেই হয় না সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগান দেওয়ার জন্য ফিডার কলেজও যে লাগে এই বোধ সম্ভবত আমাদের নীতিনির্ধারকরা জানেই না।
মোদ্দা কথা হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফিডার কলেজগুলোকে খুন করে ফেলেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেশে হাজার হাজার কলেজে অনার্স মাস্টার্স ডিগ্রী দেওয়ার যেই সুপারমার্কেট খুলেছে এটাই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নষ্ট করে ফেলেছে। এখান থেকে জাতির একমাত্র আউটপুট লাখ লাখ ‘শিক্ষিত’ বেকার তৈরি করা। সব সিস্টেমেরই কিছু ব্যতিক্রম আছে। কেউ কেউ এখন থেকে ভালো করছে। যারা ভালো করছে তারা নিজগুণে করছে। প্রতিষ্ঠানের কোন ভূমিকা নেই। দেশের যতোগুলো ঐতিহ্যবাহী কলেজ ছিলো, যাদের সুনাম ছিলো সেগুলাও নষ্ট করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় ক্ষতি করছে। এই কলেজগুলোকে বলা যায় শিক্ষিত গুণ্ডা বানানোর কারখানা। অথচ হওয়ার কথা মানুষ তৈরির কারখানা। এই কলেজগুলোর পরিবর্তে যদি যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষাকে প্রমোট করতে পারতাম দেশের বেশি মঙ্গল হতো।
আজকে যদি নটরডেম কলেজেও যদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যায় এবং অনার্স মাস্টার্স চালু করে তাহলে আমি নিশ্চিত লিখে দিতে পারি বাংলাদেশের শিক্ষার মান শেষ হয়ে যাবে।