বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সূচনা ধরা হয় ১৯৭৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রোববা, জসীমউদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠ বইটি নিয়ে জন পনেরো মানুষের আলোচনার মধ্য দিয়ে। আমি যুক্ত হয়েছিলাম ১৯৮১ সালের নভেম্বর মাসে। তবে প্রথমে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের প্রায় সকলের সঙ্গেই আমার দেখা ও কথা হয়েছে। ফলে প্রথম দিককার হৃদয়োচ্ছ্বাসও আমি দেখেছি ও উপলব্ধি করেছি। ব্যক্তিগতভাবে শিল্পসাহিত্যে নিমজ্জিত যে জীবন আমি যাপন করে চলেছি তার অনুভবভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে আমার যুক্ত থাকার সময়কাল। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর লগ্নে সে কথাও মনে করছি।
প্রায় উদ্ভব কাল থেকেই জড়িয়ে ছিলাম বলে বিভিন্ন উপলক্ষ নিয়ে লেখার সূত্রে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুরোনো দিনের কথাই বলা হয়েছে বেশি। কেন্দ্রের সবচেয়ে পরিচিত কর্মসূচিগুলো আমার যুক্ততার সময়েই শুরু হয়েছিল বলেও পুরোনো দিনের কথা অগ্রাধিকার পেয়েছে। সদ্য কৈশোর পেরোনো বয়সে সেখানে গিয়েছিলাম বলে নিজেকে উন্মোচন করার প্রয়াসে তখন ছিলাম উন্মাতাল। ফলে কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত আবেগ অনুভবের তীব্রতাও ঐ সব দিনের প্রতি ছিল প্রবল। তাই কেন্দ্রের চল্লিশ বছর পূর্তি নিয়ে লিখতে বসে দেখছি পুরোনো দিনের প্রসঙ্গই প্রাধান্য পেতে চায়।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্মধারার চল্লিশ বছর পার হয়েছে আমার চোখের সামনে ও চেতনার পরিমণ্ডলে থাকতে থাকতে; আমার নিজের ব্যক্তিগত দিনযাপনও এগিয়ে চলেছে একই সমান্তরালে এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে! সেই সূত্রে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে অতিক্রান্ত দিনগুলির প্রভাব যে গভীরভাবে আমার জীবনে বহমান তা আমি সব সময়ই অনুভব করি। তাই কেন্দ্রের দিকে ফিরে তাকাতে গেলে দেখি নিজের দিকেই ফিরে তাকানো হয়ে যায়। ১৯৮১ সালের শেষ ভাগ থেকে ১৯৯৮-এর শেষভাগ পর্যন্ত আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দিনানুদৈনিকতার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। এতটা সময় জুড়ে এর সঙ্গে থেকে কী করতে পারলাম আর কী পারলাম না তা নিয়েও আসে নানান ভাবনা। তবে সবসময়ই অনুভব করি কেন্দ্রের সঙ্গে গভীর ভাবে যুক্ত ছিলাম বলে আমার সময়ের অন্য অনেকের চেয়ে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও মননিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমি পার হয়েছি। সুতরাং সেসব অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের জীবনকে আলোকিত করতে পারলাম কিনা সে প্রশ্নও এসে যায়! আবার এ কথাও তো ঠিক যে, সব প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যাবে না। সুতরাং সেদিকে না গিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গতির সঙ্গে আমার নিজের জীবনের চলমানতার কিছু অনুষঙ্গকেই বরং তুলে ধরা যেতে পারে।
২.
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের শুরুর কালে বাংলাদেশের জীবনযাত্রার সামগ্রিকতায় এখনকার মতো বিত্তবৈভবের চিহ্ন ছিল না। সামরিক স্বৈরাচারের আবহে হতাশাক্রান্ত বিপুলসংখ্যক তারুণ্যের কাল ছিল সেটা। শিক্ষাজীবনে সেশনজটে আটকে থাকার হতাশা, অন্তহীন আন্দোলন-হরতালের অনিশ্চয়তা আর অর্জনের সম্ভাবনারহিত ক্ষোভ আমাদের প্রজন্মের তখনকার সঙ্গী! তরুণ বিপ্লবী সত্তার তখন এনজিও অভিপ্রায়ে রূপান্তর চলছে। কেউ কেউ ভাবছে বিপ্লব তো আর হবে না, দারিদ্র্যমুক্তির চেষ্টাই চলুক বরং! তবে এর পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বল্পসংখ্যক সংবেদনশীল শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত-অন্তর তখনো শিল্পসাহিত্যে খানিকটা মুক্তি খুঁজত। শিল্পসাহিত্যে মুক্তিসন্ধানী আমরা সেই ছোট্ট অংশ যুক্ত হয়েছিলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আবহে। কেউ খানিকটা জ্ঞানাগ্রহ সূত্রে, কেউ কেন্দ্রের মুক্ত অঙ্গনের নানা সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গে আসবার অবারিত প্রবেশদ্বার পেয়ে!
কেন্দ্রের নামের সঙ্গে সাহিত্য কথাটা থাকলেও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ঠিক সাহিত্য চর্চার প্রতিষ্ঠান নয়। অন্তত প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একে শুধুমাত্র সাহিত্যিক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গড়ে তুলতে চান নি। তাঁর মনে হয়েছিল তাঁর প্রজন্মের বা পূর্ব প্রজন্মের উন্নত মানুষেরা সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে সংবেদনশীল ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হওয়ার দিকে ঝুঁকতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর মনে হয়েছিল, সমকালের হতাশা ও অবক্ষয়ের বিপরীতে তরুণদের সম্মিলিত ভাবে সাহিত্য পাঠ করাতে পারলে তাদের অন্তরে উচ্চতর মূল্যবোধ ও মানবিকতা জেগে উঠবে। সাহিত্যকে তিনি অনেকটা প্রসারিত সীমানার সামগ্রী বিবেচনা করেছিলেন বলেই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি দর্শন ইতিহাস সবকিছুকেই আস্বাদন-উপলব্ধির মধ্যে রাখতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এই লক্ষ্যকে ধারণ করবার জন্যই যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে তরুণেরা সকলে যেতেন তা নয়। সামরিক শাসকের যাঁতাকলে বসবাস করেও শুধু একটু মুক্ত নিঃশ্বাস ফেলার পরিবেশ পাওয়ার জন্যও কেন্দ্রের অঙ্গনে পা রাখতেন অনেকে। তাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অঙ্গনে পা রাখার উদ্দেশ্য অনেকেরই ছিল ভিন্ন ভিন্ন। তবে ইন্দিরা রোডের বাড়ির ছোট্ট ঘাসাচ্ছাদিত লনে বা ক্যাফেটেরিয়ায়, কিংবা বাংলা মোটরের সংকীর্ণ আমতলায় বা ছাদে অসংখ্য তরুণ ও প্রবীণ প্রাণের সম্মিলনক্ষেত্র হিসেবে যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পরিচিত তা-ই আমার চোখে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। যদিও ধীরে ধীরে সারা দেশে এর নানা কর্মসূচি ছড়িয়েছে, বিপুল সংখ্যক শিশুকিশোর বই পড়েছে এরই সূত্রে তা সত্ত্বেও এখনো কেন্দ্রের প্রাঙ্গণে বেড়ে-ওঠা তারুণ্যের অন্তরে স্থান পাওয়া পরিচয়ই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আমার কাছে।
৩.
কিশোর বয়সে স্বচক্ষে মুক্তিযুদ্ধ দেখলেও এবং সেইসূত্রে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক তরুণ অন্তরে বিপ্লবী সত্তার জাগরণ ঘটলেও আমি অন্তত সে কালেই অবচেতনে বুঝে গিয়েছিলাম যে বিপ্লবী হওয়ার মতো দুঃসাহস আমার নেই। আমার বাস্তবতা বিবেচক মন এটা বুঝেছিল যে, বিপ্লবী হতে হলে কেবল স্বপ্ন থাকলেই চলবে না, স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় আনবার জন্য সংগ্রামী যে বাস্তববোধ সম্পন্ন সত্তা এবং অন্তরের নিঃশংসয় মহত্ত্ব থাকা দরকার তা আমার নেই! কিন্তু সাধারণ মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ একটা জীবন তো অন্তত অর্জন করতে হবে এমন একটা আবছায়া ভাবনা আমার মনে ততদিনে জন্ম নিয়েছে তখনকার বিরাজমান বিপ্লবী আবহের মধ্য থেকেই! আমি পরে ভেবে দেখেছি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে যুক্ত থাকার পেছনে আমার মনের এই ধরনের ভাবনাই কাজ করেছিল বেশি। মনে করেছিলাম বিত্তবৈভবের স্বপ্নে বিভোর না থেকেও উচ্চতর ভাবনালালিত একটা জীবন হয়তো যাপন করার যোগ্যতা আমি অর্জন করতে পারব। হয়তো প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তির স্বপ্ন না থাকায় জীবিকাগত সম্ভাবনা নেই জেনেও আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে অনেক দিন লেগে থাকতে পেরেছিলাম এই বিবেচনারই প্ররোচণায়। আমার যাপিত সময়ে নানা প্রলোভন-প্রভাবের হাতছানি থাকা সত্ত্বেও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সামগ্রিকতায় ঐ কালে এই রকম একটা জীবনানুভব বিরাজিত ছিল। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে সেটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যময় কাল।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যাপিত জীবনের ঐ কালখণ্ডেই সবচেয়ে বেশি লোভ-ধান্ধাহীন আদিম মানবিক বোধসম্পন্ন সরল মানুষের খোঁজ আমি পেয়েছিলাম। ঐ সময়েই পেতে শিখেছিলাম কবিতা পড়ার সুখ। একটা সিনেমার উচ্চতর শৈল্পিকতাকে অনুভব করতে পারলে বর্তে যাবে জীবন, এমন উপলব্ধির জাগরণ ঘটেছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ঐ পরিমণ্ডলে থাকবার সূত্রেই! রঙ-তুলির নিচে ঢেলে দেয়া একজন শিল্পীর আত্মার সৌন্দর্য অনুভবের পথে থাকাও যে সুখ পাওয়ার উপায় তা জেনেছিলাম ঐ পরিবেশ থেকেই। ফুটপাথে একটা দুষ্প্রাপ্য বইয়ের খোঁজে আমার অন্তর অনুপ্রাণিত হতে শিখেছে সে সময়ের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র অনুষঙ্গ থেকেই। সেখানকার বৌদ্ধিক সাহচর্য আমাকে এই উপলব্ধিতে পৌঁছে দিয়েছিল যে, খাঁটি লিটল ম্যাগাজিনের কঠিন পদচারণাতেই সাহিত্যের নতুন নতুন পথের সন্ধান পাওয়া যায়। উচ্চ জীবনানুভূতির জন্য ত্যাগী সত্তার সন্ধানও আমি পেয়েছিলাম ঐ সময়ের স্পর্শেই! ঐ সময়েই একেকজন মনীষী সম্পর্কে জেনে নিজের মধ্যে তাঁদের প্রতি অনুভব করেছি শ্রদ্ধা। হয়তো কেন্দ্রের সঙ্গে যাপিত জীবনের চেতন প্রভাবে এখনো আমি তাঁদের খুঁজে বেড়াতে কোনো ক্লান্তি অনুভব করি না। শিল্পসাহিত্যে সাফল্য অর্জনের সামান্য সম্ভাবনাও সুদূর পরাহত জেনে শিল্পসাহিত্যেরই পথে আমৃত্যু চলমান থাকব—নিজের মধ্যে এই বোধ জন্ম নিতে পেরেছিল ঐ কালপরিসরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সমগ্রতায় ছড়িয়ে থাকা উৎস থেকেই!
৪.
বাংলাদেশের উনিশশো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাতে উজ্জীবিত সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই আমার অন্তর্সত্তা সবসময় এমনভাবে আবর্তিত থেকেছে যে, জীবিকার জন্যও কখনো বিদেশবাস করবো এমন ভাবনাও মনে কখনো স্থান পায়নি। তা ছাড়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বাংলাদেশের নানা ক্ষেত্রের শীর্ষস্থানীয় মানুষের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য পেয়ে, বই ও শ্রবণ-দর্শন উপকরণাদির আস্বাদ গ্রহণ করতে পেরে আমার বিশ্বতৃষ্ণা মিটেছে বলে অনেক সময় বুঝতেই পারিনি যে আমি বৈশ্বিকতার আবহ থেকে অনেক দূরে আছি। অনেকটা এই রকম বিশ্ববোধের সূত্রে বাংলাদেশে বাস করেই বিশ্বসত্তাকে অনুভব করতে পারি মনে করে আমার সত্তা ছিল বিদেশবাস বিমুখ। কিন্তু আশ্চর্য যে, নিয়তি যেন আমাকে পরিণত বয়সে মার্কিন মুলুকে নিয়ে এসেছে। এখন আমি যেখানে বাস করছি সেই নিউইয়র্ক এমন একটা নগরী যাকে বলা যায় সারা বিশ্বের রাজধানী। বিশ্বের প্রায় সব দেশের মানুষই এখানে বাস করে তাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল রচনা করে। আমিও এই মহানগরীর বিশালতায় হারিয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র বাংলাদেশি জনসমাজের একজন হয়ে বাস করছি।
নিউইয়র্ক নগরীর নাগরিকতায় যে বিচিত্র ও উন্নত সাংস্কৃতিক আবহ রয়েছে বাংলাদেশি জনসমাজের পরিমণ্ডলে তার রঙ বা সুরের সামান্য আঁচও লাগে না। ফলে যদি বলা হয় যে, এখানকার বাংলাদেশি জনসমাজ সংকীর্ণ একটা সাংস্কৃতিকতার বাসিন্দা তাহলেও ভুল হবে না! কারণ একদিকে এই জনসমাজের বেশিরভাগ মানুষ অর্থিকভাবে অসচ্ছল বলে উন্নততর সাংস্কৃতিকতার চর্চা করতে পারেন না অন্য দিকে উত্তরপ্রজন্মের প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনপাত সংগ্রাম করে সামান্য আয় করা গেলেও তাদের দৈনন্দিন জীবনচর্চার সময়টুকুকেও খুব অপ্রতুল মনে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই এর পর সুকুমার চর্চার জন্য সামান্য সময়ও আর অবশিষ্ট পান না তাঁরা। আমি নিজেও এখানকার বাস্তবতায় স্বল্প আয়ের মানুষেরই জীবন যাপন করি। ফলে ঐ উভয় ধরনের সংকটের থাবার নিচেই আমাকেও আবদ্ধ থাকতে হয়। তা সত্ত্বেও যে নানা উপায়ে আমি তাকিয়ে দেখতে চাই বা উপভোগ করতে চাই এই মহানগরীর বিচিত্রতর ও উচ্চতর সাংস্কৃতিক সামর্থ্যের শীর্ষকে তার শিক্ষা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অতিক্রান্ত আমার দিনযাপনের অনুশীলন থেকেই পাওয়া। আমার মনে হয় চল্লিশ বছর পূর্তির লগ্নে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে বহুদূরে নিউ ইয়র্কে বসবাসসূত্রে পাওয়া আমার এই সাধারণ উপলব্ধির খবরটুকু অন্তত সকলকে জানিয়ে রাখা যেতে পারে।