দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে সিঙ্গাপুরে শ্রম দেন বাংলাদেশি জাকির হোসেন খোকন। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি লেখালেখি করতেন তিনি। তার রয়েছে বিশাল সংখ্যক অনুসারী। ফেসবুকে বিভ্রান্তিকর ও উস্কানিমূলক পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে জাকিরকে ফিরে আসতে হয়েছে দেশে। তাকে ‘বিভ্রান্তিকর উস্কানিদাতা’ আখ্যা দিয়ে কাজের অনুমতি নবায়ন করেনি সিঙ্গাপুর সরকার।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্রেইট টাইমস বলছে, দেশে ফিরে আসার কথা বুধবার (২২ জুন) সামাজিক মাধ্যমে এক বার্তায় নিশ্চিত করেন ৪৩ বছর বয়সী জাকির নিজেই।
জাকির বলেন, “সিঙ্গাপুরে ১৯ বছর ধরে আমি কাজ করেছি। গত ২৪ মে আমার কোম্পানির মানবসম্পদ বিভাব থেকে একটি নোটিশ পেয়েছি, আমার ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এটা আর নবায়ন করা যাবে না। তারা জানায়, সরকারের একটি সংস্থায় ‘বিরূপ রেকর্ড’ থাকায় কাজের অনুমতি বাড়ানো হয়নি।”
সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয় বলছে, “সিঙ্গাপুরে কাজ করার জন্য আবেদনকারীর উপযুক্ততা মূল্যায়ন করার সময় ও কাজের অনুমতি নবায়নের জন্য বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করা হয়। জাকির শ্রম অনুমতি নিয়ে এখানে ১৯ বছর কাজ করেছে।”
মন্ত্রণালয় আরও বলছে, “সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন তিনি প্রাই এখানে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে লেখালেখি করতেন। তার সক্রিয়তা ও লেখালেখি সত্ত্বেও আমরা বহুবার কাজের অনুমতি নবায়ন করেছি। তার দেওয়া পাবলিক পোস্টগুলো বিভ্রান্তিকর, মিথ্যা ও ইচ্ছাকৃতভাবে উস্কানিমূলক হওয়ায় আমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।”
২০২১ সালের অক্টোবরে মন্ত্রণালয়ের এক সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে একটি ডরমিটরিতে প্রবাসী কর্মীরা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল। ওই ঘটনায় দাঙ্গা পুলিশ পর্যন্ত ডাকতে হয়েছিল, যা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন জাকির। প্রবাসী কর্মীদের ডরমিটরিতে নিম্নমানের খাবার, সুযোগসুবিধার অভাব, কোভিডে আক্রান্ত কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবাক কেন্দ্রে নিতে বিলম্বের অভিযোগে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল কর্মীরা।
সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয় বলছে, সে সময় ফেইসবুক পোস্টে সিঙ্গাপুরে অভিবাসী কর্মীদের ‘শ্রমদাস’ ও ডরমেটরিগুলোকে ‘শ্রমিকের খোয়াড়’ হিসেবে বর্ণনা করেন জাকির। সৈন্যবাহিনী ও সাঁজোয়া যান ডরমেটরিটি ঘিরে রেখেছে বলেও সেই পোস্টে তিনি দাবি করেন। ওই ঘটনার বর্ণনাটি মিথ্যা ছিল। সেখানে কোনো সৈন্য বা সাঁজোয়া যান ছিল না।
কর্তৃপক্ষ বলছে, জাকিরের বক্তব্য ওই ডরমিটরি ও অন্যান্য এলাকার অভিবাসী কর্মীদের উসকে দিতে পারত। সেক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারত।
জাকির বলছেন, “বিষয়গুলো তুলে ধরা ‘নতুন কিছু নয়’। কোভিড মহামারী শুরু পর থেকে অনেকেই সামাজিক সমস্যা, অভিবাসী বা স্থানীয়দের সঙ্কট নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। আমি কেবল এ বিষয়গুলো তুলে ধরেছি। কারণ আমার চারপাশে সেগুলো ঘটতে দেখেছি। এগুলো অসহনীয়। জনাকীর্ণ ডরমিটরির কারণে আমি নিজেও কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলাম। একাধিকবার কোয়ারেন্টাইনে ছিলাম।”
তিনি বলেন, “দেশের বাইরে সিঙ্গাপুরই আমার বাড়ির মত। আমি চাই এই দেশটা আরও ভালো করুক। এজন্য সিঙ্গাপুরকে জনগণ, এমনকি অভিবাসীদের কথাও শুনতে শিখতে হবে। আমি কথাগুলো বলেছি, কারণ আমি বিশ্বাস করি এর মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে অভিবাসী শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি হতে পারে। আমি এই দেশকে ভালোবাসি। আমি চেয়েছিলাম সিঙ্গাপুর যেন অন্য দেশগুলোর জন্য উদাহরণ হয়।”
জাকির তার ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন না করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করলেও তার নিয়োগকর্তা তা করেননি। নিয়োগকর্তার নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়ে জাকির বলেছিলেন, “এটি খুবই আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত ছিল।”
মন্ত্রণালয় বলছে, জাকির কাজের অনুমতি নবায়নের আবেদন করলেও তার নিয়োগকর্তা তা করেননি। তার আপিল বিবেচনা করা হয়েছে। আবেদন ব্যর্থ হয়েছে। সিঙ্গাপুরে একজন বিদেশীর কাজ করার ক্ষমতা কোনো এনটাইটেলমেন্ট নয়। জাকিরকে দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুরে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যদিও তিনি দীর্ঘদিনের কর্মী ছিলেন।
জাকির বলেন, “আমার কোম্পানির মানবসম্পদ বিভাগের পরামর্শে আমি পুলিশ ক্যান্টনমেন্ট কমপ্লেক্স, ইমিগ্রেশন ও চেকপয়েন্ট অথরিটির (আইসিএ) কাছে যাই। উভয় কর্তৃপক্ষই আমাকে জানায়, আমার বিরুদ্ধে তাদের কাছে খারাপ কোনো রেকর্ড নেই। সাবেক জনশক্তি মন্ত্রী জোসেফাইন টিও বলেছিলেন, যদি ‘খারাপ রেকর্ড’-এর কারণে ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন করতে না দেওয়া হয়, তবে সেই কর্মীকে তার অপরাধ সম্পর্কে অবগত করা হবে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে দুটোর একটাও ঘটেনি।”
এদিকে জনশক্তি মন্ত্রী ট্যান সি লেংকে পাঠানো একটি চিঠি পেয়েছে দ্য স্ট্রেইট টাইমস। চিঠি অনুসারে, জাকিরের জন্য জনশক্তি মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছিলেন দেশটির এমপি লুই এনজি ও সাবেক এনএমপি অ্যান্থিয়া ওংসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)। তবে আবেদনগুলো সফল হয়নি।
সাবেক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও কবি জাকির প্রায় দুই দশক ধরে সিঙ্গাপুরের নির্মাণ খাতে কাজ করার পর ৮ জুন বাংলাদেশে তার বাড়িতে ফিরে আসেন।
জাকির ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের জন্য সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদপত্র বাংলার কণ্ঠ আয়োজিত অভিবাসী শ্রমিক কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন।