সুনামগঞ্জের শাল্লার যুবক ঝুমন দাসকে শর্তসাপেক্ষে এক বছরের জন্যে জামিন দিয়েছেন হাই কোর্ট। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ছয় মাসের বেশি সময় কারান্তরীন ছিলেন এই যুবক। নিম্ন আদালত থেকে একের পর এক জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তার এই জামিনাদেশ স্বস্তির। ঝুমন দাস তার পরিবারের কাছে ফিরছেন এটা সুখবর। একই সঙ্গে তার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিও করি।
ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা বলছি কারণ ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে গত মার্চে সুনামগঞ্জের শাল্লার ৯০টি হিন্দুবাড়ি পোড়ানো হয়েছিল। পুড়ে যাওয়া এই বাড়িগুলোর মধ্যে ঝুমন দাসের বাড়িও ছিল, ছিল তাদের উপাসনালয়ও। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলা দিতে পুলিশ দাবি করছে তার ফেসবুক স্ট্যাটাস উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। ওই স্ট্যাটাস প্রকৃতপক্ষে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী হোক না নাই হোক কাগজে-কলমে এ বার্তাই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যদিও পুলিশ ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যে অভিযোগ দিয়েছিল সেটা ছিল হামলার পাঁচ দিন পর। অর্থাৎ ১৭ মার্চ নোয়াগাঁওয়ের হিন্দু বাড়িঘরগুলোতে হামলা হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা দেওয়া হয় ২২ মার্চ।
নোয়াগাঁওয়ে হামলার বীজ প্রোথিত হয় ১৫ মার্চের দিরাইয়ে শানে রিসালাত সম্মেলনে, যেখানে হেফাজত নেতা মামুনুল হক, জুনাইদ বাবুনগরীসহ (প্রয়াত) হেফাজতে ইসলাম নেতারা উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এমন বক্তব্য দেন। এই সম্মেলন আয়োজনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতারাও জড়িত ছিলেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। এমনকি নোয়াগাঁওয়ের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে হামলার সঙ্গে স্থানীয় অনেকেই জড়িত ছিলেন যারা সরকারদলীয় রাজনীতির সমর্থকও বটে। এখানে ঝুমন দাসের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে স্রেফ এক উপলক্ষ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা করেছে স্থানীয় ধর্মীয় দুর্বৃত্তরা। তারা একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসকে সামনে এনে হামলা করেছে, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে।
ঝুমন দাস মামুনুল হকের তৎকালীন ভূমিকা নিয়ে ফেসবুকে প্রতিবাদী ছিলেন। এমনটা ছিলেন সারাদেশের আরও অনেকেই। মামুনুলরা দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে-গুঁড়িয়ে দিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিতে চান— এমনটা তারা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন বিভিন্ন সভাসমাবেশে। তারা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ নিয়ে সারাদেশে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়েছেনও তারা। ওখানে অনেক প্রাণের অপচয় হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত অনেক সম্পদহানিও হয়েছে। তাদের সেই যুদ্ধংদেহী বক্তব্যগুলোর প্রতিবাদ প্রগতিশীল মানুষেরা করেছিল, এখনও করে। ওই সময়ে মামুনুলদের বিরুদ্ধে মুক্তচিন্তার মানুষদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, এমপি-মন্ত্রীরাও করেছিলেন, জাতীয় সংসদেও এ নিয়ে কথা হয়েছিল। বলা যায়, মামুনুলদের অতি-উৎসাহী ও রাষ্ট্রবিরোধী সেই বক্তব্য ও ভূমিকার প্রতিবাদ সকল শ্রেণিপেশার মানুষেরা করেছিল। কিন্তু এখানে ঝুমন দাসকে বলি বানানো হয়েছে। তার খেসারৎ দিলেন এতদিন তিনি জেল খেটে।
ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে যে মামলা সেটার বাদী শাল্লা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুল করিম। নোয়াগাঁওয়ে যে হামলা ও লুটপাট হয় সেখানে পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। আগে থেকেই হামলার তথ্য থাকলেও পুলিশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত গ্রামটির নিরাপত্তায় কোন উদ্যোগ নেয়নি। উপরন্তু হামলার সময়ের নানা ভিডিওচিত্রেও দেখা যায় পুলিশ হামলাকারীদের কাছাকাছি ছিল, ওখানে পুলিশের ভূমিকার পুলিশের মতো ছিল না। স্থানীয় প্রশাসন এতবড় এক হামলার আগাম তথ্য থাকা সত্ত্বেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সহায়তা চায়নি। হামলা সংঘটিত হওয়ার চারদিন পর তৎকালীন স্থানীয় পুলিশ সুপার ঝুমন দাসের রাজনৈতিক পরিচয় সামনে এনে এই হামলার উসকানিদাতা ইঙ্গিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ২১ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে এসে জানান, ঝুমন দাস ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। যদিও তাৎক্ষণিকভাবেই স্থানীয় ছাত্রদল জানিয়েছিল ঝুমন দাস ছাত্রদলের অনুমোদিত কোন কমিটিতে ছিলেন না, এবং অনেক আগেই তিনি ফেসবুকে ঘোষণা দিয়েও ছাত্রদলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই বলেও জানিয়েছেন।
ঝুমন দাসের রাজনৈতিক পরিচয় সামনে আনার চেষ্টা ছিল ঘটনার মোড় ঘোরানো, যা পুলিশ করতে চেয়েছিল। ব্যর্থ হয়েছে। তবে এই রাজনৈতিক পরিচয় সামনে এনে তাকে কারাগারে পাঠানোর বন্দোবস্ত তারা ঠিকই করেছে। যার কারণে ছয় মাসের বেশি সময় কারাগারে থাকতে হয়েছে তাকে। বলছি— তার সেই ফেসবুক স্ট্যাটাসে উত্তেজনা সৃষ্টির প্রপঞ্চ ছিল না, ছিল উগ্রবাদী ধর্মীয় নেতা মামুনুল হকের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা। ওই স্ট্যাটাস ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের পক্ষে, ওই স্ট্যাটাস ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের পক্ষে। তবু তাকে ফাঁসানো হয়েছে। ফাঁসানো হয়েছে মূলত পুলিশের দ্বারা; পুলিশ তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে এই স্ট্যাটাসকে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বলে প্রমাণ করতে চেয়েছে।
যাই হোক, এক বছরের জামিন পেয়েছেন ঝুমন দাস। এখন তিনি বাড়ি ফিরবেন। ছোট্ট ও প্রাতিষ্ঠানিক কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তিনি যেন অন্য কারাগারে না গিয়ে পড়েন সেই নিশ্চয়তা দরকার তার। কারণ তাদের গ্রামে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছিল যে দুর্বৃত্তরা তারা আগে থেকেই জামিনে আছে, ওরা যেন ঝুমন দাসের ফের কোন ক্ষতি করতে না পারে সেদিকেও দৃষ্টি দিতে পারে স্থানীয় প্রশাসন। এরবাইরে, হাই কোর্ট যে শর্ত দিয়েছেন তাকে তাতে করে ঝুমন দাস বিচারিক আদালতের অনুমতি ছাড়া সুনামগঞ্জের বাইরেও যেতে পারবেন না। আদালতে-আদালতে ঘুরতে-ঘুরতে এতদিনে জামিন পাওয়া ঝুমন দাস নিশ্চয়ই এই শর্ত অক্ষরে-অক্ষরে পালন করবেন। এই শর্ত তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতার নিশ্চয়তার বাইরেরও কিছু হলেও হোক, আপাত এ নিয়ে কিছু না বলে এই আদেশকে গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নাই। তবে আমরা আশা করি কোন একটা সময়ে এই শর্তও শিথিল হলেও হতে পারে। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় থাকছি। আমরা ঝুমন দাসের ন্যায়বিচারের পক্ষে আছি।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক