পরীমনিকে নিয়ে বড় বড় হাইপোথিসিস দেওয়া হচ্ছে। পরীমনি কী এমন উদ্ধার করল? পরীমনি কী এমন নারীবাদী? পরীমনি কি নারীর জন্য কল্যাণকর কিছু করেছে যে তাকে মাথায় তুলে নাচতে হবে? ইত্যাদি। মানে পরীমনি কেমন, সেটি তারা সবাই জানেন আরকি। এই গতকালই দু-তিনজন ‘সুশিক্ষিত’ নারীকে দেখলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরীমনির চরিত্রের ময়নাতদন্ত করছেন। পড়ে শুনে মনে হলো তারা শিশুকাল থেকে এক কাঁথায় শুয়ে বড় হয়েছেন পরীমনির সাথে। কিংবা পরীমনি তাদের পাশের রুমে ঘুমাতেন, একসাথে চলতেন ফিরতেন।
এদিকে পরীমনি ছাড়া পেয়েও সবাইকে রাগিয়ে দিলেন ফের। ‘মাথায় পট্টি-টট্টি সব দেখনদারি। জেলখানায় মেহেদি পেল কই? এই মেহেদী দিয়ে লিখে কী বোঝাতে চান? ‘বিচ’ কি কোনো ভালো শব্দ নাকি? ছ্যা ছ্যা!’ শুদ্ধ ভাষাতত্ত্বের পণ্ডিতরা সব গঙ্গাজলে নাইতে নেমেচেন। এ দফা জাতপাত সব রক্কে পেলে হয়!
না, পরীমনি নারীবাদী বলে নিজেকে দাবি করেননি কখনো। হয়তো তিনি এমন কোনো বিরাট কাজও করে ফেলেননি যে তাকে নারী কল্যাণের অগ্রদূত বলা যায়। তবে আমার কাছে পরীমনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন? কারণ পরীমনি হলো এই ভণ্ড মিথ্যুক প্রতারক ভানধরা সমাজের মুখের ওপর চটাস করে এসে পড়া সেই চড়, যে চড়টা সারা দিনরাত নারীবাদ কপচানোর চেয়েও অনেক জোরে এসে পড়েছে সবার মুখে।
মানে ধরুন, এই যে আপাদমস্তক ভান ধরা সমাজের নারী পুরুষ সব, এরা তো সারা দিন পরীমনির চরিত্র বিশ্লেষণ করছেন। কেন করছেন? কারণ ওই যে সতীত্বের কনসেপ্ট। ওটি ধরেই তো সব বৈতরণী পার হতে হয় তাদের। কত কত অসততা, মিথ্যাচার, প্রতারণা আর হিপোক্রেসি আড়াল করেন এই সতীত্ব তত্ত্বের বুলি কপচে। তো সতীত্বটা আসলে খুব দামি কনসেপ্ট।
ধরুন, একটি সমাজে পতিতা আছে, পতিতালয় আছে, সরকারের তরফ থেকে তাদের নিবন্ধনও দেওয়া আছে। মানে ধরুন সমাজ জানে, পুরুষের লাগে! লাগে বলেই তো জোগান রাখতে হয়। সে তো থাকবেই। তো যারা পতিতা তারা তো পতিতাই। এর বাইরে বাদ বাকি সব সতী। মানে নারী-পুরুষ সবই। নারীরা সব গঙ্গাজলে যোনি ধুয়ে সংসারে পতিসেবা ব্রতে আছেন। আর পুরুষেরা সেই সতী নারীদের পবিত্রতাকে পুজো করে চলেছেন দিনরাত এক করে। ধরুন এর মাঝে একটা মেয়ে, যে কোনো কমিটেড সম্পর্কে নেই, তবু সে কার সাথে শুচ্ছে, সেটি খুব জরুরি হয়ে উঠেছে, সবাই তা জানতে চায়। এটি শুধু পরীমনি বলে নয় কিন্তু। সমাজে যে মেয়েই একা থাকে, তার ঘরের দরজাতেই উঁকি মারে প্রতিবেশী, বন্ধু, স্বজন। তাকে সন্দেহ করে। তার নামে নানা কথা ছড়ায়। আবার যে মেয়েটি একা নয়, তাকে নিয়েও ছড়ায়। যে মেয়েটি বাপ মা ভাইবোনের সাথে বাস করে, তাকে নিয়েও ছড়ায়। যে মেয়েটি তথাকথিত অভিজাত পরিবার থেকে এসেছে, তাকে নিয়ে যেমন ছড়ায়। যে মেয়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের, যে মধ্যবিত্ত, যে চাকরি করে, যে ঘরে থাকে, যে রাস্তায় ঘুমায়, যে বড় অফিসে বড় পদে দায়িত্ব সামলায়, মানে কেউ বাদ যায় না আরকি! প্রত্যেক মেয়েই সমাজের সন্দেহের চোখ সামলে চলে। বাদ পড়ে না একটা মেয়েও। সবার যৌনতা ও যৌনজীবনে পুরো সমাজের সন্দেহের চোখ।
তো এই মেয়েরা সবাই চুপচাপ হজম করেই জীবনযাপন করে। কেউ কেউ একটা-দুটো কথাটথা বলে হঠাৎ, প্রতিবাদ করে, সে লাখে একটা। তো এর মাঝে এই পরীমনি, যার ব্যাপারে আসলে কারুর কোনো ধারণাই ছিল না যে সে কতটা ফুঁসে উঠতে পারে, সে এমন জ্বলা জ্বলে উঠল যে পুরো সমাজের মাথায় হাত! ওরা ভেবেই নিয়েছিল—শোবিজের মেয়ে, দশ পুরুষের শয্যায় শুচ্ছে, নিশ্চয় টাকা নিচ্ছে, মদ খাচ্ছে, এই মেয়েকে একটু রগড়ে দিলে কাত হয়ে যাবে। মিউ মিউ করে ফের সিধোবে পুরুষের পায়ের তলায়। বুকের তলায় ঘুমিয়ে যাবে। মানে যা হয় আরকি! হয়ে এসেছে এতকাল। পরীমনিকেও তাই ভেবেছিল ওরা।
তো কতগুলো অভিযোগ দাঁড়িয়ে গেল। কী সেগুলো? সে মদ খায়। মানে মদ তো পুরো সমাজে এই একটি মেয়েই খেয়েছে আসলে। বাকি সব নারী-পুরুষ মদের গন্ধে কাছা তুলে দৌড়ায়। এই মেয়ে একাধিক পুরুষকে সঙ্গ দেয়। কী এক বিশাল অপরাধ! এমন মারাত্মক অপরাধ কেউ করেছে কোনোকালে? নাহ! সমাজের মূল্যবোধ টুল্যবোধ সব চুলোয় গেল। এরপর? পরীমনি শুয়ে শুয়ে টাকা নিয়েছে? হে রাম! হে খোদা! হে যিশু রক্ষে করো! এমন কাজ কি কোনো সমাজে হতে পারে? এটা যে যৌনতা বিক্রি? এ তো অসম্ভব! কেউ করে না। একমাত্র পরীমনি করছে। মানে আপনি ধরে নিয়েছেন আর কি যে সে এসব করে। প্রমাণপত্রও নেই এই সন্দেহের পেছনে। যদি ধরেন আছেও প্রমাণ, তবে তো ওই কথাই! এই সমাজে কেউ শুনেছে যে কেউ এ কাজ করে? মাফ করো মাফ করো। যে সমাজে পুরুষেরা সতী নারীদের মাথায় তুলে রাখে, সেই সমাজে আবার পতিতাবৃত্তিটা কী? হয় নাকি?
নাহ, হয় না। তো পুরো সমাজটাই তো পরীমনির কাণ্ডকারখানায় রেগে কাই। এর মধ্যে মেয়েটা করল কী? ফাইট দিতে লাগল। নিজেকে একটুও বদলালো না। শিরদাঁড়া খাড়া করে কোর্টে যাচ্ছে। বের হচ্ছে। সবার গা জ্বলে যাচ্ছে। শিরদাঁড়া খাড়া থাকলে কেউ ভালবাসে না। এ আমার নিজের পোড় খেয়ে শেখা। শিরদাঁড়াটা বাঁকা করলেই সবাই খুশি হয়। তো পরীমনি তো কাউকে খুশি করতে পারল না। এই মেয়ে আবার জামিন পেয়ে ফের সেই গা জ্বলানো হাসি হেসে বেরিয়ে এসেছে। ভাবা যায়?
না, যায় না। অপরিসীম ক্ষমতাধর পিতৃতন্ত্রের মুখের ওপরে অট্টহাসি হাসা সহজ কথা নাকি? এইভাবে মাসখানেক জেলে পচেও এ রকম শক্ত মেরুদণ্ড, তা-ও আবার মেয়েমানুষ! এ তো খুব অলুক্ষুণে ব্যাপার হলো দেখি। কলিকাল একেই বলে? মেয়েমানুষের এত তেজ? হাতে মেহেদি দিয়ে কী লিখেছে ওসব? কাকে বলছে ‘বিচ’? আমাকে নাকি? নাকি ওকে? নাকি তাকে?
আজীবন নারীর একটা ছবি এঁকেছে এই সমাজ। নত মুখ, নত শির, মিনমিনে স্বর, মিউ মিউ আহ্লাদে গদগদ, শুদ্ধ যোনির সাইনবোর্ড গলায় ঝুলিয়ে ঘরের কোণে পচে মরা নারী। যে নারী নিজের মতো করে বাঁচে না, নিজের মগজ দিয়ে চিন্তা করতে জানে না, নিজের ভাষায় কথা কয় না। যে নারী পুরুষতন্ত্রের ভাষায় পুরুষতন্ত্রের সতীত্ব থিওরি প্রচারের কাজ করে। যে নারীর সতীত্ব নেই, সেই নারীকে পারলে পুড়িয়ে মারত এই সমাজ আজও। নেহাত পারছে না বলে মুখে মারছে। আইন দিয়ে মারছে। ক্ষমতা দিয়ে মারছে।
না পরীমনি বিশাল কোনো নারীবাদী নন। উনি নারী কল্যাণের জন্য কোনো এনজিও খুলে বসেননি। উনি চিত্রনায়িকা। ধরুন, এটাও বাদ দিলাম। উনি নেহাত সাধারণ একটা মেয়ে। কিন্তু উনি এখন আমার চোখে খুব দামি। কারণ, ওই চড়টা। যে চড়টা আমি আপনি দিনরাত নারীবাদ ফলিয়েও মারতে পারি না ঠিকমতো, সেই বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়খানাই সে মেরে দিয়েছে পুরো ভণ্ড সমাজটার মুখে। এই চড়টা খুব কাজ দিয়েছে। ভবিষ্যতেও দেবে। আর বাদ বাকি? সে পরে দেখা যাবে। আপাতত চড়ের জায়গায় যে জ্বলুনিটা হচ্ছে, সেটা সামলান।
লেখক: সম্পাদক, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর