• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শেখ হাসিনা : ঘরহীন মানুষের ঠিকানা


মিল্টন বিশ্বাস
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২১, ০৮:৪৬ এএম
শেখ হাসিনা : ঘরহীন মানুষের ঠিকানা

দুর্যোগে-দুর্ভোগে নিঃস্ব মানুষকে কাছে টানার অনন্য ক্ষমতা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। যেমন, ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। যা ‘নিমতলি ট্র্যাজেডি’ নামে অভিহিত। ওই অগ্নিকাণ্ডে সবমিলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১২৪। ২০১৯ সালের ১৪ এপ্রিল নববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে নিমতলি ট্র্যাজেডির ঘটনায় স্বজন হারানো তাঁর তিন কন্যা ও তাদের স্বামী-সন্তানরা। এসময় প্রধানমন্ত্রীও তাদের শুভেচ্ছা জানান। উল্লেখ্য, নিমতলি ট্র্যাজেডিতে আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া তিন কন্যা উম্মে ফারওয়া আক্তার রুনা, সাকিনা আক্তার রত্না ও আসমা আক্তার শান্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। 

নিজের কন্যা পরিচয়ে তিনি নিজেই তাদের বিয়ে দেন। বর্তমানে নিয়মিত তাদের খোঁজ-খবরও রাখেন তিনি। ঘটনার দিন রাত সাড়ে দশটার দিকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে এবং এটি তিন ঘণ্টারও বেশি সময় স্থায়ী হয়। ওই অগ্নিকাণ্ডে আক্রান্ত একটি ভবনে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিলো এবং এজন্য সেখানে ছিল অনেক অতিথির সমাগম। ফলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বেড়ে যায়। পরেরদিন শুক্রবার(৪ জুন) আসমা আক্তার শান্তার বিয়ের পান-চিনির অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিলো। মেয়ের বিয়ের জন্য বাবা মুসলিম খান আড়াই ভরি ওজনের একটি সোনার নেকলেস তৈরি করেছিলেন। মায়ের ছিলো সাড়ে চার ভরি সোনা। অলঙ্কারগুলো সবই আগুনে গলে যায়। তার মা আমেরি বেগম, নানী নূর বানু এবং বড় ভাইয়ের মেয়ে রোকেয়া আক্তার আগুনে পুড়ে মারা যান। বাবা মুসলিম খানের শরীরের বেশীরভাগ অংশই পুড়ে যায়। বড় বোনসহ পরিবারের আরও দুইজন অগ্নিদগ্ধ হন। নির্বাক আসমা আপনজনদের হারিয়ে যখন দিশেহারা তখন এগিয়ে আসেন মমতাময়ী শেখ হাসিনা। 

আসমার মতো হতভাগ্য রুনা-রত্নারও জীবন। ওই সন্ধ্যায় আগুনে ছাই হয়ে যায় সাকিনা আক্তার রত্নার স্বপ্ন। ২২ জুন তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। ৩ জুন সন্ধ্যায় নিমতলির রত্নাদের বাসায় ছোট বোন রুনার বাগদান অনুষ্ঠানের সময় আগুনে ছাই হয়ে যায় সবকিছু। দুই বোন আর ভাই ফয়সল ছাড়া বাড়ির সবাই মারা যান। রুনা-রত্নার পরিবারের ২১ জন নিহত হন। অগ্নিকাণ্ডের পর পরিবার-পরিজন হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া রুনা, রত্না ও শান্তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপন করে নেন। ঘোষণা দেন তারা নিজের সন্তানের মতো তাঁর আপনজন। এরপরই গণভবনে নিজে উপস্থিত থেকে তাঁর তিন কন্যার বিয়ে দেন। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়েরা তাঁর দোয়ায় ভালোই আছে। তবে হারিয়ে যাওয়া মা, খালা, বোনদের কথা বার বার মনে হয়। তাদেরকে হারানোর পর প্রধানমন্ত্রীকে ‘মা’ হিসেবে পাবার পর তাদের আর কোনো কষ্ট নেই। মায়ের (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) ব্যস্ততা আর নিরাপত্তার জন্য তাদের সঙ্গে নিয়মিত আর দেখা হয় না। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেন; তাদের সন্তানদের আদর করেন। বিয়ের সময় বিশ্বমানবতার নেত্রী রুনার স্বামীকে একটি চাকরি দেয়ার কথা বলেছিলেন। সে অনুযায়ী সে নৌ বাহিনীতে চাকরি পেয়েছে। আবার যখন কেউ দেখার ছিল না তখন গণভবনে রত্নার বিয়ের পর তার স্বামীকে বেসিক ব্যাংকে চাকরি দেয়া হয়। অন্যদিকে শান্তার স্বামীকে প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীতে চাকরি দিয়েছেন। আপন মা যেমন জামাই বাড়ি গ্রীষ্মের ফল পাঠান, মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রীও তার তিনকন্যার বাসায় প্রত্যেকবার ফল পাঠান। সরাসরি বছরে একবার দেখা হলেও শত ব্যস্ততায় বিভিন্ন উৎসবে নিয়মিতই খোঁজ নেন তাদের। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ করা তিনকন্যার উকিল বাবা হাজী সেলিম এমপি, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এবং আওয়ামী লীগ নেতা এম, এ আজিজ তাদের নিয়মিত খোঁজ খবর রাখেন। আপন মেয়ের মতো সব ভালোমন্দ দেখেন তারা।  

সব হারানো মানুষের পাশে থাকেন যেমন, তেমনি গৃহহীনকে ঘর দিয়ে শেখ হাসিনা আজ আনন্দিত। ‘মুজিববর্ষ’র অঙ্গীকার অনুসারে ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩ জানুয়ারি (২০২১) ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে গণভবন থেকে দেশের ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ৬৯ হাজার ৯শ’৪ জন ভূমিহীন ও গৃহহীনকে পাকাঘর প্রদান কার্যক্রমের প্রথম পর্যায়ের শুভ উদ্বোধন করেন। ফেব্রুয়ারি মাসে আরো ১ লাখ পরিবার বাড়ি পেয়েছে। হস্তান্তরকৃত প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানি সরবরাহের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। প্রতিটি জমি ও বাড়ির মালিকানা স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে দেওয়া হচ্ছে। দেশের গৃহহীন প্রতিটি মানুষ ঘর না পাওয়া পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলমান থাকবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আজ আমার অত্যন্ত আনন্দের দিন। ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর প্রদান করতে পারা বড় আনন্দের।’ তাঁর সবচেয়ে আনন্দের এই দিনটি জনগণের জন্যও সুখের কারণ একসময় আমরা রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে কেবল হাজার হাজার প্রতিশ্রুতি শুনতাম, বাস্তবায়ন ছিল সুদূর দুরাশার। কিন্তু শেখ হাসিনার একটানা শাসনের গত ১২ বছরে তার বিপরীত চিত্র দেখছি। তিনি কথা দেন এবং সাধ্যমতো জনগণের জন্য প্রতিশ্রুতি পূরণ করে দেখিয়ে দেন যে তিনিই প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করেন। গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য কাজ করার এই স্বভাব তিনি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। এজন্য ওইদিন তিনি বলেছেন- ‘আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের কথাই ভাবতেন। আমাদের পরিবারের লোকদের চেয়ে তিনি গরিব অসহায় মানুষদের নিয়ে বেশি ভাবতেন এবং কাজ করেছেন। এই গৃহ প্রদান কার্যক্রম তারই শুরু করা।’

বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই চলছেন শেখ হাসিনা। ‘আমার বাংলাদেশ, আমার ভালোবাসা’ এই অমৃতবাণী বাংলাদেশের তিনিই উচ্চারণ করেছেন। তিনি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত। সততা, নিষ্ঠা, রাজনৈতিক দৃঢ়তা; গণতন্ত্র, শান্তি, সম্প্রীতি ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের অনন্য রূপকার আর মানব কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ- তার চেয়েও আরো আরো অনেককিছু তিনি। দরদী এই নেতা দুঃখী মানুষের আপনজন; নির্যাতিত জনগণের সহমর্মী তথা ঘরের লোক। তিনি বলেছেন, ‘বাবার মতো আমাকে যদি জীবন উৎসর্গ করতে হয়, আমি তা করতে প্রস্তুত।’ মানবতার দিশারি শেখ হাসিনা দেশের মানুষের জন্য নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করতে পারেন নির্দ্বিধায়। সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। তাঁকে কেন্দ্র করে, তাঁর নেতৃত্বে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের সবকিছু। ২০০৯ সালে লিখেছিলেন- ‘রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম আমার। পিতা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। একদিন যে আমাকেও তাঁর মতো রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে দেশ পরিচালনা করতে হবে ভাবিনি। সময়ের দাবি আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমি এই আদর্শ নিয়ে বিগত ২৮ বছর যাবৎ জনগণের সেবক হিসেবে রাজনীতি করে যাচ্ছি।’ (ভূমিকা,  শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র ১ম খণ্ড) 

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে গৃহহীন মানুষের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি পরিষ্কারভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ একটি নিরাপদ আশ্রয়ে বসবাস করা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। আর এই অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। তাই বিপন্ন মানুষের আশ্রয় ও গৃহহীন মানুষের আবাসন নিশ্চিত করাকে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য বা ভিশন হিসেবে নিয়ে কাজ করছে শেখ হাসিনা সরকার। প্রকল্পের আপাতত লক্ষ্য বা মিশন হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় গৃহহীন মানুষের আশ্রয়, প্রশিক্ষণ এবং ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে পুনর্বাসন। আশ্রয়ণ প্রকল্পটি শেখ হাসিনার অন্যতম মানবিক উদ্যোগ। এর সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাও জড়িত।  

২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৯৩টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা এসডিজি অনুমোদন করেন। এসডিজি'র লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্যই নেওয়া হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগ। ১০টি বিশেষ উদ্যোগ ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম সে লক্ষ্যেই পরিচালিত। এ ১০টি উদ্যোগ যথাক্রমে আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লি সঞ্চয় ব্যাংক, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, কমিউনিটি ক্লিনিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, বিনিয়োগে বিকাশ এবং পরিবেশ সুরক্ষা। আশ্রয়ণ প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে। তবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্দেশ্য তিনটি ১. ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল,অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ২. ঋণ প্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা ৪. আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যদূরীকরণ।

প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়, এছাড়া অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং আরও নানা আকস্মিক দুর্যোগেও গৃহহীন হয় বহু মানুষ। দেশে রয়েছে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গৃহহীন পরিবার। এ কারণেই প্রয়োজন হয়েছে তাদের আশ্রয়ণের ব্যবস্থা। দেশের ভূমি ও গৃহহীন আট লাখ ৮২ হাজার ৩৩টি পরিবারকে ঘর ও জমি দেওয়ার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এ তালিকার সবাই এই সুবিধা পাবে। উপকারভোগীদের মধ্যে যাদের জমি আছে, তারা শুধু ঘর পাবে। যাদের জমি নেই, তারা ২ শতাংশ জমি পাবে (বন্দোবস্ত)। দুই কক্ষবিশিষ্ট প্রতিটি ঘর তৈরিতে খরচ হচ্ছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। সরকারের নির্ধারিত একই নকশায় হচ্ছে এসব ঘর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে থাকা আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এই কাজ করছে। খাসজমিতে গুচ্ছ ভিত্তিতে এসব ঘর তৈরি হচ্ছে। কোথাও কোথাও এসব ঘরের নাম দেওয়া হচ্ছে ‘স্বপ্ননীড়’, কোথাও নামকরণ হচ্ছে ‘শতনীড়’, আবার কোথাও ‘মুজিব ভিলেজ’। সরকারের এই উদ্যোগ বিশ্বের ইতিহাসে নতুন সংযোজন বলে জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সেখানকার অভিমত হলো- ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ব ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের বিশাল অর্জন।’

এ কথা সত্য, গৃহহীন মানুষ তার আশ্রয়ের নিশ্চয়তা পেলে খুব দ্রুত বদলে নিতে পারে নিজের ও পরিবারের জীবনমান। অথচ ১৯৪৭-পরবর্তী পাকিস্তান সরকার বা তার আগে ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশ সরকার- এরা কেউই গৃহহীন মানুষের আশ্রয়ের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকার কিছু কাজ করলেও ১৯৯৭ সালের আগ পর্যন্ত ঘরবাড়ি হারানো পরিবারগুলোর আশ্রয়ের জন্য সংগঠিতভাবে কোনো চিন্তা কেউ করেননি। উল্লেখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে গৃহহীন মানুষের দুর্দশা লাঘবে তাদের গৃহে পুনর্বাসনের মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ‘গ্রামে গ্রামে কাজ করো, দুঃখের দিনে মানুষের পাশে দাঁড়াও’- এটি ছিল নেতা-কর্মীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। 

তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মূলত এসব গৃহহীন পরিবারের আশ্রয়ের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিন্তা শুরু করেন। ওই বছর ১৯ মে কক্সবাজারসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে বহু পরিবার গৃহহীন হয়। সেসময়ের ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই এলাকা দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি গৃহহারা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে তাদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রয়ণ’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এরপর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়ন তিন ধাপে আশ্রয়ণ প্রকল্প কাজ করছে। 

‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’ স্লোগানকে ধারণ করে ২০১০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প কার্যক্রমের চিত্র নিম্নরূপ-

জুলাই ১৯৯৭-জুন ২০১৯ অবধি প্রকল্প গ্রামের সংখ্যা  ২,০৩১টি , নির্মিত ব্যারাক সংখ্যা ১৯,৮৭৮টি, যার জমি আছে ঘর নেই তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ ১,৪৩,৭৭৭টি,  তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জন্য বিশেষ ডিজাইনের ঘর নির্মাণ ২১৪টি, নির্মিত টং ঘর-২০টি , কবুলিয়ত রেজিস্ট্রি সংখ্যা ১,৪১,৪১৮টি পরিবার, প্রশিক্ষণ প্রদান ২,৭৫,৬৫৬ জন, ঋণ প্রদান ১,৩৮,৭১৮টি পরিবার, বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান ১,১০১টি । অন্যদিকে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প ৩য় সংশোধিত ডিপিপি এর লক্ষ্যমাত্রা (জুলাই ২০১৯-জুন ২০২২) হলো- নির্মিতব্য প্রকল্প গ্রামের সংখ্যা ৪১৮টি, নির্মিতব্য ব্যারাক সংখ্যা ৬,৪৪৫টি, ব্যারাকে পুনর্বাসিতব্য পরিবার সংখ্যা ৩২,২২৫টি, যার জমি আছে ঘর নেই তার নিজ জমিতে নির্মিতব্য গৃহ ২৭,০২৯টি পরিবার, তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জন্য বিশেষ ডিজাইনের নির্মিতব্য ঘর ৩৬৬টি, কবুলিয়ত রেজিস্ট্রি সংখ্যা ৪৪,৪৯৫টি পরিবার, প্রশিক্ষণ প্রদান ৯৬,১৭০ জন, ঋণ প্রদান ৪৭,১৯৫টি পরিবার, বৃক্ষ রোপণ ৬,২৪,৯৭৫টি বৃক্ষ, বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান ৫৪৬টি পরিবারে। বর্তমানে ২.৫০ লক্ষ ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায় দরিদ্র পরিবার পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ-২ (জুলাই ২০১০-জুন ২০২২) নামে প্রকল্পের কার্যক্রম চলছে। 

মূলত এখন সারাদেশে গ্রামাঞ্চলে ব্যারাক হাউস এবং বিভাগীয় সদর ও রাজউক, বিভিন্ন সিটি করপোরেশন এলাকা, জেলা ও উপজেলা সদর এবং পৌরসভা এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে। প্রকল্পটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দারিদ্র্যবিমোচনমূলক একটি মানবিক উদ্যোগ। পুনর্বাসিত ভূমিহীন, গৃহহীন, দুর্দশাগ্রস্ত ও ছিন্নমূল পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে ভূমির মালিকানা স্বত্বের দলিল/কবুলিয়ত সম্পাদন, রেজিস্ট্রি ও নামজারি করে দেওয়া হয়। পুনর্বাসিত পরিবারসমূহের জন্য সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ, মসজিদ নির্মাণ, কবরস্থান, পুকুর ও গবাদিপশু প্রতিপালনের জন্য সাধারণ জমির ব্যবস্থা করা হয়। পুনর্বাসিত পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন উৎপাদনমুখী ও আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহারিক ও প্রশিক্ষণদান এবং প্রশিক্ষণ শেষে তাদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচনে শেখ হাসিনা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অন্যতম হলো ‘বয়স্কভাতা’। বর্তমানে উপকারভোগীর সংখ্যা ৪৯ লাখ, আর্থিক বরাদ্দ ২৯৪০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে।

আসলে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য তিনটি সূচককে বিবেচনা করা হয়। এগুলো হচ্ছে- ১. মাথাপিছু আয়, ২. মানবসম্পদ সূচক, ৩, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের যা দরকার ছিল- মাথাপিছু আয় বিগত তিন বছরের গড় ১২৩০ মার্কিন ডলার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন ২০৬৪ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের জন্য দরকার ছিল ৬৬ বা তার বেশি। এ সূচকে বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়েছে ৭৩.১৫তে। সম্প্রতি এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানকেও ছাড়িয়ে গেছে মানবসম্পদ সূচকে। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন ছিল ৩২ বা তার কম স্কোর। এ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ২৫.২২। উন্নয়নের এই সোপানে আরোহণ শেখ হাসিনার অনন্য কৃতিত্ব। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তাচেতনা এবং সৃজনশীলতা দ্বারা উদ্ভাবিত বিশেষ ১০টি উদ্যোগসমূহের মধ্যে অন্যতম উদ্যোগ হলো আশ্রয়ণ প্রকল্প। সব গৃহহীন পরিবারকে গৃহায়ণ সুবিধার আওতায় আনার লক্ষ্যে তিনি ‘সবার জন্য গৃহায়ণ’ ঘোষণা করেছিলেন। এক্ষেত্রে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোর অবস্থার অগ্রগতির জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এই প্রকল্প। তিনি লিখেছেন- ‘দেশের জন্য, মানুষের জন্য কতটুকু করতে পারলাম সেটাই বড় কথা। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি নিয়ে।’(বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্যে উন্নয়ন) তাঁর মতে, জনগণের সমস্যা দূর করতে পারলেই তো রাজনীতি জনগণের কল্যাণের জন্য করা বোঝায়। আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই জনগণকে কিছু দিয়েছে। এদেশের মানুষ যা অর্জন করেছে তার সিংহভাগ আওয়ামী লীগের দেওয়া। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে এজন্যই আনন্দিত হয়েছেন গৃহহীনদের ঘর দিয়ে, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। তাঁর কারণেই অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। উজ্জীবিত হয়েছে নিঃস্ব মানুষগুলো। 

লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Link copied!