অবয়বপত্রে অনেকেই প্রশ্ন রেখেছেন, যিনি আত্মীয়-পরিজনকে সাক্ষী রেখে জীবন থেকে সরে গেলেন, তিনি কি বোধশক্তি হারিয়েছিলেন? বুধবার রাতে ওই ব্যক্তির সঙ্গে কতিপয় গণমাধ্যম এবং অবয়বপত্রের কুশীলবেরাও মানসিক বৈকল্যে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ঘটনাটি মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে যায়। তিনি যেভাবে জীবনের গল্প বলছিলেন। পাওয়া, না-পাওয়ার ‘ব্যালান্সশিট’ উপস্থাপন করছিলেন, তাতে একসময় মনে হচ্ছিল, না পাওয়ার দুঃখবোধ এবং বিষণ্নতার কথা জানিয়ে তিনি থেমে যাবেন। বড়জোর প্রিয়জন এবং পাওনাদারকে একটি হুমকি দেবেন।
না, একসময় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা যখন সম্পন্ন করতে শুরু করলেন, তখনই লাইভ কমেন্টে তাঁর প্রতি জীবন রক্ষার অনুরোধ আসতে থাকে। কেউ কেউ বাড়ির আশপাশের মানুষদের গিয়ে, তাঁকে নিবৃত্ত করার আহ্বান জানাতে থাকেন। একটি ফোনও চলে আসে। হয়তো কোনো আপনজন তাকে টেলিফোনে শেষ অনুরোধ করতে চেয়েছিলেন, কিংবা ক্ষমা চেয়ে তাঁকে জীবনে ফিরতে অনুরোধ করতেন। না, ফোন দেরি করে ফেলল। রিং বেজে ওঠার আগেই জীবন শেষ।
জীবন থেকে এমন বীভৎসভাবে যিনি চলে গেলেন, কেন গেলেন? সেই কারণগুলো ব্যক্তি নিজেই বলে গেছেন। আলোচনা তারপরও মৃত্যুর পর মুহূর্ত থেকে এখনো চলছে, রকমারি বিশ্লেষণ। তার নিজেকে সরিয়ে দেওয়াটা অপরাধ হয়েছে, নাকি পরিবার ও রাষ্ট্রকে শিক্ষা দিয়ে গেলেন, এ নিয়েও বিশ্লেষণের শেষ নেই।
আলোচনা হচ্ছে সমাজের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হওয়া, একাকিত্বের আয়োজন নিয়েও তর্কবিতর্ক চলছে। একই সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি, একটি বড় অংশ বুধবার রাত থেকে অবসাদে ডুবে আছেন। ছন্দপতন ঘটেছে তাদের প্রাত্যহিকে। রাত থেকে এখন অবধি দুই চোখ এক করতে পারেননি অনেকে।
যিনি চলে গেলেন, জীবন থেকে প্রত্যাহার করে নিলেন নিজেকে, তার যে যাপন, সেই যাপন তো আমাদের অনেকেরই। কত প্রিয়জনের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়ে বসে আছি। কিন্তু ফিরতি স্নেহ, ভালোবাসার প্রাপ্তিযোগ শূন্য। চাকরি, ব্যবসাতেও পুঁজি, লোকসান, বঞ্চনার ফর্দটা খাটো নয়। সেই মানুষগুলোর ওপর অবসাদের চাপ আরও তীব্র হলো।
অবসাদের তীব্রতা বাড়িয়ে দেওয়ার দায় নিতে হবে মূল এবং সামাজিক দুই গণমাধ্যমকে। ওনার চলে যাওয়ার ভিডিও চিত্র ভাইরাল করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাসিন্দাগণ এবং কিছু অনলাইন। অনলাইন- ইউটিউবে যা এখনো সুলভ করা আছে। আর মূলধারার গণমাধ্যম প্রকাশ করছে তিনি কীভাবে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। পদ্ধতিটি লাখো অবসাদে ভোগা মানুষদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। বিষণ্নতায় ভুগতে থাকা মানুষেরা এই পদ্ধতি দেখে, জেনে আরেকটি দুর্ঘটনার কারণ যেন তৈরি করতে পারে, এ ছাড়া স্বাভাবিক জীবনে আছেন যারা, তারাও যেন অবসাদগ্রস্ত না হয়ে পড়েন।
আমরা বরাবরই দেখছি এমন কোনো ঘটনা ঘটলে গণমাধ্যম প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে, কে কতভাবে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে পারে। যেন কোনো রান্নার রেসিপি উপস্থাপন করছে তারা। এই প্রকার রেসিপিসর্বস্ব গণমাধ্যমকেও আমার অবসাদ-আক্রান্ত মাধ্যমই মনে হয়। এখন খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ ও মূল গণমাধ্যম দাবিদারদের মনের অসুখ সারানোর। অবসাদে ভোগা গণমাধ্যম রাষ্ট্র ও জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও নিরাপদ নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট