হাতে অর্থকড়ি না থাকলে লোকে বলে ‘পকেট গড়ের মাঠ’। কলকাতার এই গড়ের মাঠ আসলে বিশাল ফাঁকা ময়দান, সেখানে ঘরবাড়ি নেই, বড় গাছের সারি নেই, আছে খোলা জায়গা, আছে বিশুদ্ধ বাতাসের সমারোহ। কলকাতা শহরের ফুসফুস বলা যায় এই ময়দানটিকে। সেখানে ছেলেমেয়েরা খেলতে আসে, গল্প করতে আসে, বড়রা ঘুরতে আসে, বৃদ্ধরা হাঁটতে আসে। কিন্তু ঢাকায় তেমন কোনো মাঠ নেই। খোলা ময়দান বলতে যা বোঝায়, সেগুলোর ভেতর গাছ লাগিয়ে, স্থাপনা করে সব নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। পাড়া বা মহল্লা ঘেঁষে যেসব মাঠ অবশিষ্ট আছে, ব্যক্তিমালিকানায়, সেগুলোও আজকাল হয়ে যাচ্ছে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। বাচ্চারা এখন খেলছে ভবনের ছাদে। সেটাই তাদের মাঠ। ইট-কাঠ-কংক্রিটের মাঠ। বাচ্চাদের পা স্পর্শ করে না ঘাস-মাটি-জল (বিশেষ শিশুদের জন্য এই স্পর্শ কতটা জরুরি, তা একটু খোঁজ নিলেই বোঝা যাবে)। খালি জায়গার অভাবে হয় তারা ছাদের ছোট্ট গণ্ডিতে বিকেলে এক টুকরো আকাশ দেখল, নয়তো বাকি সময়টা মোবাইল ফোনে গেম খেলল। এই তো আধুনিক সময়ে বাচ্চাদের বেড়ে ওঠা। আমি বলব অসম্পূর্ণ বেড়ে ওঠা। তারা মাঠ থেকে দূরে, পাঠ থেকেও।
ঢাকা শহরে ফুটপাত নেই, মাঠ নেই, খোলা জায়গাও নেই। যে যেখানে যেমনভাবে পারে শুধু ঠেলে ভবন বানায়। মানুষের যেমন নিশ্বাস নেওয়ার জন্য বিশুদ্ধ বায়ু প্রয়োজন, তেমনি বেঁচে থাকার জন্য খোলামেলা জায়গাও জরুরি। আমরা এমন ভোগবাদী সমাজের কীটে পরিণত হয়েছি যে মানবিক বিকাশ, সামাজিক বৃদ্ধি ও সুকুমার বৃত্তির জন্য যে খোলা ময়দান বা নিদেনপক্ষে ছোটখাটো মাঠ দরকার, সেটাও আর বুঝতে পারছি না। মেটামরফোসিসের যুগে আমরা নিজেরা কীটে রূপান্তরিত হয়েছি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও আমরা চিন্তায় ও শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ করে দেওয়ার সমস্ত আয়োজন করে রাখছি। শিশুদের জন্য আমাদের প্রস্তুতি কেমন? আমরা তাদের শিক্ষার নামে তিন থেকে পাঁচ রকমের ব্যবস্থা জারি রেখেছি। স্কুল বানাচ্ছি, কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে একভাবে তো পঙ্গু করছিই, আবার সেসব স্কুলে মাঠ নেই, পাঠাগারও নেই, পাড়ার খোলা জায়গাগুলোকেও গিলে ফেলছি প্রতিনিয়ত, কাজেই তাদের শারীরিক বৃদ্ধিতেও তৈরি হচ্ছে বড় প্রতিবন্ধকতা।
এত কথা বলার কারণ সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠের ওপর নজর পড়েছে পুলিশের, সেখানে তাদের এখন থানা করতে হবে। ঢাকা শহরে কি থানার অভাব? মডেল থানা নামে তো দেখি অলিগলিতে প্রচুর ভবন রয়েছে। তারপরও কেন তাদের সরকারি খাসজমি, যেখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে, সেখানে ভবন ওঠাতে হবে? সংবাদমাধ্যমগুলো এলাকাবাসীর বরাতে জানায়, তেঁতুলতলা মাঠের এক বিঘা জমি একজন বিহারির মালিকানায় ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি আর দেশে ফেরেননি। তখন থেকেই জায়গাটিতে স্থানীয় শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করে। সরকারি খাসজমি হিসেবে নথিভুক্ত এই খালি জায়গায় থানা নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এলাকাবাসীর সঙ্গে প্রশাসনের দ্বন্দ্বের শুরু এখান থেকেই।
মাঠ রক্ষার জন্য এলাকাবাসী আন্দোলন গড়ে তুলেছে। এই আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক সৈয়দা রত্না। মাঠটিতে ভবন তৈরির সরঞ্জাম রাখা হলে তার প্রতিবাদ করে ২৪ এপ্রিল ফেসবুকে লাইভ করেন সৈয়দা রত্না। এ সময় তার সঙ্গে ছিল কিশোর ছেলে ঈসা আব্দুল্লাহ। সামান্য ফেসবুক লাইভও সহ্য হয়নি স্থানীয় প্রশাসনের, তারা মা ও ছেলেকে বেলা ১১টার দিকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা থানায় আটকে রেখে, মধ্যরাতে তাদের ছেড়ে দেয়। রমজান মাস চলছে, রত্না রোজা রেখেছিলেন, কিন্তু ও রকম পরিস্থিতিতে তিনি ইফতারও করেননি। তাদের শরীর ও মনের অবস্থা অনুমান করা যায়।
কিন্তু গোটা দেশের শরীর ও মনের অবস্থা কোন জায়গায় গেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থবিত্ত ও সম্পত্তির প্রতি সীমাহীন এক লোভী জাতিতে পরিণত হয়েছি আমরা। রাজধানীতে এক টুকরো জমি যেন সোনার হরিণ, সেটি কি ফেলে রাখা যায়? ভবন করে দোকান ভাড়া দিলে টাকা আসবে। ছেলেমেয়েদের খেলার দরকার কি? তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের প্রয়োজন নেই, অধিক দরকারি রকেট-নগদ-বিকাশের। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের একটি বাণী মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, যদি তুমি বার্ষিক পরিকল্পনা করো তাহলে ধানগাছ রোপণ করো। যদি দশ বছরের পরিকল্পনা থাকে তাহলে বৃক্ষ রোপণ করো। আর যদি পরিকল্পনা হয় শতবর্ষের তাহলে শিশুর ভেতর শিক্ষা রোপণ করো। অর্থাৎ একটি জাতির উন্নয়নের পেছনে শিশুদের প্রতি নজর দেওয়ার গুরুত্ব শত শত বছর ধরেই বলে আসছেন দার্শনিক, মনীষী ও চিন্তাবিদরা। উন্নত বিশ্বে তাই দেখবেন প্রচুর খোলা জায়গা, খেলার মাঠ, এমনকি প্রত্যেক বাড়ির সামনে ও পেছনে খালি জায়গা রাখা থাকে। সেখানে বাচ্চারা একটু দৌড়াদৌড়ি করতে পারে। এটা ঠিক ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ শহর। তো উঁচুতলা ভবন বানান। আকাশের দিকে উঠুন। বৃদ্ধি হোক উল্লম্ব বরাবর। আনুভূমিক বৃদ্ধিতে খালি জায়গা ভরাট হয়ে যাচ্ছে আর তাতেই সংকটে পড়ছে খেলার মাঠ অথবা একটু ফাঁকা জায়গা।
শুধু কি শিশুর বৃদ্ধির জন্য মাঠ বা ফাঁকা জায়গা প্রয়োজন? সকাল বা বিকেলে হাঁটাচলা কি বয়স্ক মানুষেরও দরকার নেই? আমরা হলাম বুদ্ধির ঢেঁকি, মাঠের ভেতর ভবন বানিয়ে সেখানে জিম দিয়ে ট্রেডমিলে হাঁটি। অর্থকড়িই সেখানে মূল। ব্যায়ামাগার থাকার বিরুদ্ধে আমি নই, তবে খালি জায়গায় হাঁটা আর যন্ত্রের ওপর হাঁটা এক বিষয় নয়। আবালবৃদ্ধবনিতা সবার জন্যই খালি জায়গা, মাঠ, ময়দান অতি জরুরি। একই রকমভাবে জরুরি ফুটপাত। মানুষ যদি স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটতে পারত, সময় করে মাঠে একটু দৌড়াতে পারত, আমি নিশ্চিত এই শহরে হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কমে আসত। কে শোনে কার কথা? বড়লোকেরা ট্রেডমিলে হেঁটে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে বিদেশ পাড়ি দেন। দেশে মাঠ, খোলা জায়গা তো নেই-ই, ভরসা করার মতো চিকিৎসালয়ও নেই। কী দুর্ভাগা আমরা! কী আর করা, মাঠ, মাতৃভাষায় শিক্ষা, পাঠাগার, ভালো হাসপাতাল এগুলোর দরকার নেই। আমরা এখন হয়েছি শতভাগ আমদানিনির্ভর জাতি। মাঠ বুজে দিয়ে শরীরচর্চার যন্ত্র আনি বাইরে থেকে, শিক্ষাটাও আনি বিদেশ থেকে, আর হাসপাতালে হয় বিদেশি ডাক্তার আনি, নয়তো নিজেরাই উড়াল দিই। এই তো আমাদের ৫০ বছর পরের বাংলাদেশ।
লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংবাদ প্রকাশ