জনপ্রিয় চিত্রনায়ক শাকিব খান ৯ মাস পর দেশে ফিরেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে তার ভক্ত-অনুরাগী কর্তৃক সংবর্ধিত হয়েছেন। ফুলেল অভিনন্দনে সিক্ত শাকিব খান দেশে ফেরার পর দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমি খুব এক্সাইটমেন্ট’। ব্যস, আর যায় কোথায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইছে ট্রলের বন্যা। ভুল ইংরেজিতে বলা বাক্যই কাল হয়েছে তার। ৯ মাস আমেরিকা থেকে কী শিখেছেন, প্রশ্নও অনেকের। ভাবখানা এমন, আমেরিকা থাকলেই বুঝি ইংরেজির সব শেখা হয়ে যায়!
সামাজিক মাধ্যমে ট্রল করছেন যারা, তারা হয়তো ভাবছেন যারাই যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের দেশে-দেশে থাকেন, তারা সবাই শুদ্ধভাবে ইংরেজি শিখে ফেলেন। একইভাবে যারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে থাকেন, তারা শেখে ফেলেন আরবি ভাষাটাও। বিমানে চড়লেই বুঝি ভাষাশিক্ষার পাঠ সম্পন্ন হয়!
শাকিব খানের দেশে ফেরা সামাজিক মাধ্যমসহ সব মাধ্যমে আলোচনার খোরাক হয়েছে, আলোচনায় এসেছে তাকে বরণে ভক্ত-অনুরাগীদের ভিড়। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের কোনো চিত্রনায়ককে বরণে এমন ভিড় আগে কখনো দেখা যায়নি। স্বতঃস্ফূর্ত কিংবা ফরমায়েশি যেভাবেই হোক, বিষয়টি নতুন আমাদের জন্য। আরও নতুন তাকে নিয়ে টানা সংবাদ প্রকাশ। পাঠকের আগ্রহ বিবেচনায় বিভিন্ন মাধ্যমের এই সংবাদ প্রকাশ হয়তো ঠিক আছে, কিন্তু যারা ভুলভাল ইংরেজি নিয়ে অযথা ট্রল করছে, তারা বুঝি ভেবে বসে আছেন ভুল ইংরেজিতে কিছু বলা অশেষ লজ্জার!
শুদ্ধভাবে যেকোনো ভাষা বলা যাদের সহজাত, তাদের সমালোচনা হয়তো ঠিক আছে, কিন্তু ভাব দেখে মনে হয় কেবল এবং কেবলই ভুল ইংরেজিতে কিছু বললে একশ্রেণির লোক অশেষ লজ্জার বলে মনে করে। তবে এই পক্ষ আবার শুদ্ধভাবে নিজের ভাষায় কিছু লিখতে পারছে কি না, এ নিয়ে খেয়াল নেই। যেন নিজ ভাষায় ভুল কোনো ব্যাপারই না!
ভাষাসংক্রান্ত ভুল-শুদ্ধের এই দ্বন্দ্বের আধিক্য লক্ষ করা যায় সামাজিক মাধ্যমে। বেশির ভাগ লোকই নিজেদের ভুল ধরতে আগ্রহী হয় না। বাংলায় লিখলেও বানান ও বাক্য গঠনে মনোযোগ নেই। তাদের আবার অন্যের ভুল ধরতে আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যায়। যেন শুদ্ধভাবে ইংরেজি বলতে পারাটাই অশেষ যোগ্যতা। অথচ নিজের ভাষার প্রতি লক্ষ নেই একবিন্দু। শাকিব খানের ‘আমি খুব এক্সাইটমেন্ট’ বাক্যের সমালোচনা করতে এমন অনেককে দেখেছি, যাদের সেই পোস্টেই ভুল বাক্য গঠনের নমুনা। নিজ ভাষার প্রতি এমন অমনোযোগিতা সত্ত্বেও তাদের আনন্দ একজন ‘পাবলিক ফিগারের’ ভুল ইংরেজি ধরতে পারা।
কেবল ট্রলকারীই নয়, সামাজিক মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকেও দেখেছি সঠিকভাবে বাংলা না লিখতে। একবার-দুইবার নয়, অনেকবার এবং ধারাবাহিকভাবে। এই দলে আছেন সরকারের মন্ত্রী-উপমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও। বাংলা একাডেমির প্রয়াত এক মহাপরিচালকও ফেসবুকে এমন ভুল বাক্য ও বানানে প্রায়ই পোস্ট লিখতেন। এসব নিয়ে সমালোচনা হতো। একজন মন্ত্রী ও একজন উপমন্ত্রীর ফেসবুকে যেসব পোস্ট আসে তার অধিকাংশতেই থাকে ভুল বানান ও ভুল বাক্যের ব্যবহার। এসব তারা নিজেরা লেখেন কি না, জানার আগ্রহ নেই যদিও তবে আইডি ও পেজ যেহেতু তাদের নিজস্ব, সেহেতু দায়দায়িত্বও তাদের।
গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে অনেক প্রতিষ্ঠিত/পরিচিত লেখকের লেখা নিয়মিত দেখতে হয়। এমন অনেকের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হলে যে উত্তর পাই, সেখানে ভুল বানানের লেখকের চাইতে প্রশ্নকর্তারই লজ্জা পেতে হয়। ‘আমার বানান ভুল হয়ে যায়’, এমন উত্তর যখন কেউ কেউ করেন, তখন তাদের লজ্জার চাইতে গৌরবই বেশি প্রকাশিত হয়। ভুলভাবে লেখা যেন কোনো ব্যাপারই না! অথচ ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা আমাদের। সঠিক বানানে সেই লেখাটি প্রকাশিত হলে পরেরবার সে একই ভুল অনেকে আবারও করে থাকেন। তবে এর বাইরে অনেকেই আছেন, যারা সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের বানানরীতি অনুসরণ করেন, এবং পূর্বতন ভুল থেকে শিক্ষা নেন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু নোটিশের ছবি সামাজিক মাধ্যমে আসে, যেখানে থাকে ভুলের ছড়াছড়ি। অনেকেই সেগুলো উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট করে থাকেন। যারা সমালোচনা করেন, তারাও শুদ্ধভাবে সব সময় লেখেন, এমন না, কিন্তু প্রতিষ্ঠান যখন কিছু লেখে, তার ওপর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক চিঠিতে ভাষার শুদ্ধতার প্রত্যাশা বাড়াবাড়ি নয়। এখানে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, সরকারি অনেক চিঠিতেও দেখা যায় ভুলের নজির, এগুলো কাঙ্ক্ষিত নয়। যারা গণমাধ্যমে আছেন তারা জানেন, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বানান ও বাক্য গঠনের অবস্থা। বোঝাই যায়, দায়সারা ভাব সবখানে; শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেও বাংলা ভাষার প্রতি এমন গুরুত্বহীনতা!
সামাজিক মাধ্যমে ইংরেজিতে লেখার দরকার পড়ে না; অথবা সে দক্ষতাও আমার নেই। দক্ষতার অভাবের সঙ্গে আছে আবার চাপা সংকোচ, ভুল হয়ে যাবে না তো! এখানে ভুল হয়ে গেলে কেউ কেউ ঠিকই বেরিয়ে আসবে ভুল ধরতে। ভুল ধরুক সমস্যা নেই, কিন্তু এই তারা যদি বাংলার প্রতিও এমন মনোযোগী হতো, তবে সামাজিক মাধ্যমে আমাদের শুদ্ধ বানানচর্চা অনেক দূর এগিয়ে যেত। এটা ঠিক, কোটি কোটি সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীর সবার কাছ থেকে শুদ্ধ বানান ও সঠিক বাক্য গঠনের প্রত্যাশা এখনই বাড়াবাড়ি রকমের আবদার, কিন্তু নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, আধা প্রতিষ্ঠিত এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী সমাজ নিশ্চয়ই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারে। ভুল বানান ও বাক্যের গঠন ‘ব্যাপারই না’ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এতে ব্যক্তিগতভাবে সবাই যেমন লাভবান হবে, তেমনি বেগবান হবে ভাষার শুদ্ধ চর্চাও। বলে রাখি, এখানে আঞ্চলিক ভাষাকে বিরোধী পক্ষ দাঁড় করানোর দরকার নেই। আঞ্চলিক ভাষাও ভাষা, এটা অশুদ্ধ নয়। অশুদ্ধ হলো বিকৃতি। তা সচেতনভাবে কিংবা যেকোনোভাবেই হোক।
সবাই ভাষাবিদ নয়, হতেও পারে না। সবাই সঠিকভাবে লিখতে পারবে, এটাও বলছি না। তবে আগ্রহ থাকতে হবে; ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। ভুল বাংলা কোনো ‘ব্যাপারই না’ এমন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ভুল ইংরেজিতে লেখা-বলাকে যেমন ‘লজ্জার’ ভাবছে অনেকেই, তেমনিভাবে বাংলাকে ভুলভাবে ব্যবহারকে ‘লজ্জার’ বিষয় ভাবতে পারলে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া হবে আমাদের। এটা অন্তরে ধারণ করতে পারলে দেখবেন আপনা থেকেই বাংলাচর্চার শুদ্ধতার দিকে আপনার মনোযোগ বাড়তে শুরু করেছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক