করোনা অতিমারির অভিঘাত, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সর্ববৃহৎ সামরিক দ্বন্দ্বে পারমাণবিক শক্তিধর বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর অস্ত্র ও মুদ্রাযুদ্ধের কারণে আর্থসামাজিক‑রাজনৈতিকভাবে এখন ঘোর সংকটে রয়েছে বিশ্ব। দেশে দেশে তীব্র মূল্যস্ফীতিতে মৌলিক ও নিত্যপণ্যের বাজার নাগরিকদের নাগালের মধ্যে রাখতে সব দেশের সরকারই হিমশিম খাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবে বন্যা, খরা, দাবদাহ, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি। করোনার কারণে এমনিতেই বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে সব ধরনের কাঁচামালের তীব্র সংকট, তার ওপর যুদ্ধ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসেরও মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই সবকিছুর প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে। দুর্বৃত্ত পুঁজিবাদসৃষ্ট মুক্তবাজারে অতিমুনাফালোভীদের ফাটকাবাজির পাশাপাশি বিদ্যুৎ‑জ্বালানি‑যানবাহন‑খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের বাজারে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিতে জনসাধারণের একেবারে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। উপরন্তু পরাশক্তিদের শুরু করা মুদ্রাযুদ্ধের কারণে মার্কিন ডলারের সঙ্গে আন্তরাষ্ট্রীয় মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় ক্রমেই মূল্য বাড়ছে আমদানি পণ্যের। আর আমদানি পণ্যের বাড়তি মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে টান পড়ছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। রিজার্ভ সামাল দিতে না পেরে দেশে দেশে ‘দেউলিয়া রাষ্ট্র’ হওয়ার আতঙ্ক পেয়ে বসেছে।
বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা নির্ধারিত হয় তার রিজার্ভ, বিশেষত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে। এই রিজার্ভ কমা মানে হচ্ছে অর্থনীতিতে অস্থিরতা। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও গত ঈদুল আজহার দুদিন আগে দুই বছরের মধ্যে রিজার্ভ সবচেয়ে কমে ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসায় খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অর্থনীতিবিদরা। রিজার্ভের সংকটে শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য সচ্ছল রাষ্ট্রের করুণ পরিণতি দেখে অর্থনীতির কিছুই বোঝেন না, এমন মানুষজনও এখন নড়েচড়ে বসেছেন। তারা বোঝার চেষ্টা করছেন—রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, আন্তর্জাতিক ও আন্তদেশীয় মুদ্রাবিনিময়, পরাশক্তিদের মুদ্রাযুদ্ধ, আমদানি‑রপ্তানি পরিস্থিতিসহ অর্থনীতির গভীরের কিছু বিষয়, যাতে করে আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে কিছুটা সতর্ক হতে পারেন। দেশে দেশে রির্জাভ সংকট, মূল্যস্ফীতি ও দেউলিয়া হওয়ার ঘটনায় এমন ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক।
সাধারণের বোধগম্যের জন্য এখানে বলে রাখা ভালো যে, যেকোনো দেশের রাষ্ট্রীয় আর্থিক নিয়ন্ত্রক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে জনগণের আমানত হিসাবে নেওয়া মোট অর্থের একটি অংশ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়, যাকে বলে রিজার্ভ। কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওই অংশ ওই দেশের অভ্যন্তরীণ রিজার্ভ, যা জনগণের আমানতের গ্যারান্টি হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা থাকে। অন্যদিকে রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বিদেশি ঋণ বা অন্যান্য উৎস থেকে আসা সব বৈদেশিক মুদ্রা থেকে আমদানি খরচ, ঋণ ও সুদ পরিশোধ, বিদেশে শিক্ষা‑ভ্রমণ‑চিকিৎসা ইত্যাদি নানা খাতে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা বাদ দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিত থাকে, তাকে বলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
অভ্যন্তরীণ রিজার্ভে ঘাটতি মূলত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য শঙ্কার। অপর দিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতি রাষ্ট্রের অর্থাৎ জনগণের দুশ্চিন্তার কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার-১৯৭২ অনুযায়ী, রিজার্ভ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এখানে মনে রাখতে হবে, যখন দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসে, তখন তার বিপরীতে গ্রাহককে (ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান) বাংলাদেশি মুদ্রা তথা টাকা সরবরাহ করতে হয়। সুতরাং প্রবাসী বাংলাদেশি, গার্মেন্টস কর্মী বা কোনো ব্যবসায়ী বা গোষ্ঠীর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মালিকানা দাবির সুযোগ নেই। এই অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশ থেকে আনা পণ্য ও সেবার আমদানি মূল্য, নানা ধরনের ঋণ ও দায় পরিশোধ এবং দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে কর্মরত ঠিকাদারদের পাওনা পরিশোধে ব্যয় করে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চাঁদা হিসেবে দেয়। এ কারণে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি লিখিত নির্দেশনা আছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ), যেখানে তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে রাখাকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশের তিন মাসের আমদানি খরচ ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। কিন্তু পরিবর্তিত বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কাছে বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের আমদানি খরচ চালানো সম্ভব। ১৯৭০-৭১ সময়কালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের আমলে ব্রেটটন উডস্ সিস্টেম ভাঙার মাধ্যমে কত ডলার ছাপানো হবে তা নির্ধারণে সোনার মজুতের পরিমাণ বাতিল ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। এর কারণ, ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বৃত্ত অর্থের অর্থনীতি থেকে ঘাটতি অর্থের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়া। এ সময় সোনার রিজার্ভকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে যত্রতত্র ডলার ছাপিয়ে সস্তায় বিশ্ববাজারে অবাধে ঢেলে দিয়ে অর্থনীতির সর্বাত্মক আর্থিকীকরণের জন্য গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ব্যবস্থার উচ্ছেদ করে দেশটি। এই অপকর্ম বাস্তবায়নে দেশটি তাবেদার দেশের প্রত্যক্ষ সহায়তায় মার্কিন ডলারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময়ের মূল মানদণ্ড হিসেবে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে দেশে দেশে রূপান্তরযোগ্য নানা বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ সংরক্ষণ শুরু হয়। আর মার্কিন ডলারের কারসাজির কারণে এখন বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ অন্য দেশের নানা ধরনের সরকারি পেপারে বা ঝুঁকিহীন উচ্চ ঋণমানের সার্বভৌম বন্ডে বিনিয়োগ করে এবং কিছু অংশ দিয়ে স্বর্ণ কিনে রাখে। যেহেতু মার্কিন ডলারের শক্তি বেশি, সে কারণে অধিকাংশ দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখে। আর এ কারণেই অর্থনৈতিক সংকটের সময় মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে গিয়ে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান কমতে থাকে, যা এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশের মুদ্রার ক্ষেত্রেই ঘটছে।
বর্তমান বিশ্বে যার যত বেশি ডলার রিজার্ভ, সে তত দ্রুত সংকট মোকাবিলায় সক্ষম। পর্যাপ্ত রিজার্ভ ব্যতীত গুরুতর সংকটের সময়ে একটি দেশ খাদ্য, তেল, গ্যাস ও জ্বালানির মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ আমদানি খরচ ও বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধে অক্ষম। ২০২০‑২১ সময়কালে বাংলাদেশ করোনার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে বেশ সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল, মূলত বৈদেশিক রিজার্ভের কল্যাণেই। জুন ২০২২ পর্যন্ত সর্বশেষ হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে শীর্ষ ১০‑এর ১ নম্বরে আছে চীন (৩৪৮০ বিলিয়ন ডলার)। এরপরে আছে যথাক্রমে জাপান (১৩৭৬), সুইজারল্যান্ড (১,০৩৩), রাশিয়া (৬৩০), ভারত (৫৯৯), তাইওয়ান (৫৪৮), হংকং (৫০৪), সৌদি আরব (৪৫১), দক্ষিণ কোরিয়া (৪৪৯) এবং সিঙ্গাপুর (৩৬৫ বিলিয়ন ডলার)। ১৪১ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনের ৩ মাসের সমস্ত আমদানি এবং স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ মেটাতে মাত্র ৭৮০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ দরকার। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪তম। ঈদুল আজহার ছুটির দুদিন আগে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১৯৯ কোটি ডলারের আমদানি দায় পরিশোধ করার পর বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা গত দু বছর মধ্যে সর্বনিম্ন।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। ওই বছরের জুন মাসে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। গত বছরে আগস্টে রিজার্ভ সর্বোচ্চ বেড়ে ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। এর মূল কারণ হচ্ছে, কোভিড‑১৯ অভিঘাত, অর্থনৈতিক মহামন্দা, ইউরোপে যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের উন্নত ও ধনী দেশগুলোর অস্ত্র ও মুদ্রা নিয়ে প্রক্সিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় বিশ্বব্যাপী অব্যাহতভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের জন্য মিক্সড ফুয়েল রিজার্ভের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সুফল ঘরে তুলতে না পারা বাংলাদেশের সংকটকে ঘনীভূত করেছে। একই সঙ্গে প্রত্যাশিত মাত্রায় বৈদেশিক বিনিয়োগ, রেমিটেন্স ও রপ্তানির অভাব বাংলাদেশের রিজার্ভের টানতে ত্বরান্বিত করেছে। সব মিলিয়ে আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাড়তি মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের রিজার্ভের ক্রমান্নতি এখন ক্রমাবনতির মুখে পড়েছে, যা সবাইকে ভাবনায় ফেলেছে।
এখন প্রতি মাসে গড়ে ৭ মিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি ব্যয় মেটাতে হয়। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে মে ১১ মাসে আমদানি হয়েছে ৭৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি। এই সময়ে রপ্তানি যদিও বা বেড়েছে, কিন্তু আমদানির তুলনায় তা কম। ৪৪ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়েছে, অর্থাৎ ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি। একই সঙ্গে এই সময়ে বাংলাদেশের রিজার্ভের প্রধান কারিগর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও লক্ষণীয়ভাবে কমেছে। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রেখে অর্থনৈতিক সক্ষমতা ধরে রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী পদক্ষেপগুলোই নিচ্ছে। আশু আশঙ্কা না থাকলেও বাংলাদেশ প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি খরচে বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ এলসি মার্জিন বাড়ানো, পেঁয়াজ, ফুল, ফল, আসবাবসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী ১৩৫টি পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করেছে। এতে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচবে। এ ছাড়া সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য নির্দেশনা জারি করেছে। সরকারের এসব পদক্ষেপ সাধুবাদযোগ্য। তবে এসব কতটা কার্যকর হচ্ছে, সেটাই অনেকের প্রশ্ন। এসব বিষয় কঠোরভাবে দেখা দরকার। কারণ, চূড়ান্ত স্বার্থপর অনেক সরকারি কর্তাব্যক্তি জরুরি কারণ ছাড়াই এখনো বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। ‘অভিজ্ঞতা অর্জন’, ‘শিক্ষা সফর’ নাম দিয়ে বিদেশ সফর শেষে দেশে এসেই এলপিআরে চলে যাচ্ছেন। অফিসে‑ঘরে এসি ও গাড়ির বিলাসিতাও চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনেক ভালো ও সময়োপযোগী উদ্যোগ মাঠেই মারা যাচ্ছে, সরকারকে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। এসব খুবই দুঃখজনক।
এখন তো ব্যক্তিগত খরচেই অপ্রয়োজনে যেকোনো নাগরিকেকে বিদেশ সফরে নিরুৎসাহিত করা উচিত। কারণ, ব্যক্তি নিজ খরচে বিদেশ গেলেও তিনি তো সরকারের (জনগণের) রিজার্ভই ধ্বংস করেন। একইভাবে নিজের টাকায় বিদেশি পণ্য ব্যবহার করলেও সরকারের রিজার্ভ থেকেই সে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে হয়। সাধারণ মানুষ তো সরকারের নানামুখী উদ্যোগ খুশিমনে মেনে নিয়েই বলছেন, ‘এখন না‑হয় দুয়েক ঘণ্টা গ্যাস‑বিদ্যুৎ ছাড়াই চালাব’। বিশ্বব্যাপী একের পর দুর্বিপাকে আমাদের মনে রাখতে হবে, জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় আরও বেড়ে গেলে রিজার্ভের টান বাড়তেই থাকবে। এতে করে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। সরকারকে রিজার্ভ রক্ষার পাশাপাশি বাড়তি প্রণোদনা ও সুযোগ‑সুবিধা দিয়ে রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়নের নামে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে। প্রত্যাশিত রিটার্ন না আসা খাতগুলোতে নির্মোহভাবে দ্রুত সংস্কার করতে হবে। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ব্যাংকের চেয়ে বেশি। তাই সব রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। আর বৈদেশিক মুদ্রা আসার খাতগুলোতে যদি কোনোভাবেই অগ্রগতি না‑হয় তাহলে, দ্রুত স্বল্পসুদে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বিশ্বব্যাংক এরই মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা বলেছে। সরকার আইএমএফ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেওয়ার আলোচনা শুরু করেছে। তবে বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে খুব বুঝেশুনে এগোতে হবে। কারণ, ২০২৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশকে নিয়মিতভাবে বেশ কিছু বিদেশি ঋণের দায়দেনা শোধ করতে হবে।
কিছু অসংগতি ও অপ্রাপ্তি থাকলেও সব দিক বিবেচনায় করোনার ঘাত‑অভিঘাত ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা সামাল দিতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে প্রশংসা না করাটা অন্যায় হবে। তবে দেশে দেশে রিজার্ভশূন্যতা ও দেউলিয়াত্বের বাড়বাড়ন্তে রিজার্ভ প্রশ্নে সরকারকে এখন খুব ভেবেচিন্তে এগোতে হবে, ন্যূনতম বাজার ঝুঁকিতে সর্বোচ্চ স্বল্পমেয়াদি রিটার্ন নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও তার অনুচর রাষ্ট্রগুলো মুদ্রার দর কারসাজিসহ বিদেশে রক্ষিত রিজার্ভে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশকে দেউলিয়া বানানোর নীলনকশা নিয়ে ইতিমধ্যেই যে নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ ও মুদ্রাযুদ্ধ শুরু করেছে, তার শেষ কোথায় এবং কীভাবে হবে তা কেউই জানে না।
এরই মধ্যে নানামুখী নিষেধাজ্ঞাসহ ৬০০ বিলিয়ন ডলার আটকে দিয়ে সর্বোচ্চ রিজার্ভে ৪র্থ অবস্থানে থাকা রাশিয়াকে যথাসময়ে ঋণের অর্থ প্রদান থেকে বঞ্চিত করে দেউলিয়া তকমা দেওয়া হচ্ছে। রাশিয়াও পাল্টা পদক্ষেপে হিসেবে রুবল দিয়ে তার পণ্য কেনার জন্য শত্রু রাষ্ট্রকে বাধ্য করছে, পাশাপাশি মিত্রদের সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় মুদ্রায় লেনদেন শুরু করেছে, যাকে অর্থনীতি পরিভাষায় ‘কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’ বা ‘সোয়াপ’ বলে। রাশিয়ার পাল্টা পদক্ষেপে জ্বালানি সংকটে পড়ে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির জার্মানিসহ ধনী রাষ্ট্র ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালিসহ অনেক দেশ আসন্ন শীতে তীব্র ঠান্ডা থেকে কীভাবে বাঁচবে, সেটা ভেবে এখনই প্রায় কাবু হয়ে পড়েছে। অপর দিকে মুদ্রাযুদ্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ডলারকে দুর্বল করতে ইতিমধ্যেই চীন, ভারত, ইরানসহ অনেক দেশ রুবল, ইউয়ান ও রুপি ও পণ্য দিয়ে সোয়াপ বাণিজ্য শুরু করেছে। ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির ক্রমাগত মান কমে যাওয়ার কারণে সম্প্রতি ভারতও বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্যের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ২০১৩ সালেও রুপির একই দশায় ভারত বাংলাদেশকে এই প্রস্তাব দিয়েছিল। বাংলাদেশ সে সময় রাজি ছিল না। নিকটতম দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে এ ধরনের বাণিজ্য বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ভালো মনে হলেও ভারতের প্রস্তাব আবারও প্রত্যাখ্যান করাই স্বাভাবিক হবে। কারণ, সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক‑সামরিক শক্তি ও বাণিজ্য অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারকে পাশ কাটিয়ে রুপিতে লেনদেন এখন ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন নিশ্চিতভাবেই এর বিরোধী।
ভারতের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বছরভেদে ১২‑১৩ গুণ বেশি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ আমদানি করে, তার ১৮ থেকে ২০ গুণ বেশি রপ্তানি করে যে ডলার আয় করে তা ওই বাজারে খরচ করতে হয় না। ৭০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে বছরভেদে ১৪‑১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি বাংলাদেশের। অন্যদিকে বড়জোর ১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির বিপরীতে ভারত থেকে ৭-৮ বিলিয়ন ডলারের আমদানি করে বাংলাদেশ। উপরন্তু ভারতের প্রচণ্ড সংরক্ষণবাদী পণ্য ও শূন্য বাংলাদেশি জনশক্তি আমদানি নীতি, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাণিজ্য বাধা, বাংলাদেশি পণ্যে অ্যান্টি-ডাম্পিংসহ প্রভৃতি নীতি বাংলাদেশের জন্য কোনোভাবেই অনুকূল নয়। বাংলাদেশ তার মুদ্রার মান ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আর রুপির মান ক্রমশই কমছে। এই সুযোগে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত নানা ইস্যু নিয়ে কূটনৈতিক লড়াই করতে পারে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিশ্বের অনেক দেশই এমনটা করছে। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোয় যোগ দেওয়া প্রশ্নে তুরস্ক সেটাই করছে। এটাই এখন বিশ্ব বাস্তবতা।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জবি ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদশে র্অথনীতি সমিতি