• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
ভাড়া বৃদ্ধি

বন্ধ হোক বাসমালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা


সাইফুর রহমান তপন
প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২১, ০২:১৩ পিএম
বন্ধ হোক বাসমালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা

ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির পর থেকে গণপরিবহনে, বিশেষ করে ঢাকা শহরের পাবলিক বাসগুলোতে ভাড়া নিয়ে যা চলছে, তা নজিরবিহীন। দেশে ডিজেল বা জ্বালানির দাম আগেও বহুবার বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কখনোই হুট করে সব ধরনের পরিবহন বন্ধ করে মানুষের ভোগান্তি চরমে তুলে বাস ভাড়া বাড়ানো হয়নি।

অতীতে দেখা গেছে, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির পর পরিবহনমালিকেরা কিছু ক্ষেত্রে সরকার বাসভাড়া পুনর্নির্ধারণ করার আগ পর্যন্ত ভাড়া না বাড়িয়ে, কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের মতো করে ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে বাস চালু রেখেছেন। এবারই প্রথম তারা ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সড়ক-মহাসড়ক থেকে সব ধরনের পরিবহন উধাও করে দিলেন। এমনকি সরকারের আহ্বানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মালিকদের পছন্দমতো ভাড়ার হার নির্ধারণের আগ পর্যন্ত তারা নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকেছেন।

অথচ রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অনুসারে এটা বাসমালিকেরা করতে পারেন না। অন্যান্য সব সেক্টরের মতো তাদেরও কিছু সুনির্দিষ্ট শর্ত মেনে অপারেশনাল লাইসেন্স নিতে হয়। সেসব শর্তের একটি হলো যেকোনো ধরনের ধর্মঘট ডাকার একটা নির্দিষ্ট সময় আগে তাদের উচিত সরকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ সরকারকে না জানিয়ে কোনো ধর্মঘট ডাকা যাবে না।

কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এবার বাসমালিকেরা এ শর্তটি জঘন্যভাবে লঙ্ঘন করার পরেও সরকার তাদের কাছে কোনো জবাবদিহি চায়নি। শুধু তা নয়, সরকার ও মালিকপক্ষের বৈঠকে সিটি সার্ভিস ও দূরপাল্লার বাসের ভাড়া পুনর্নির্ধারিত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন গড়িয়ে গেলেও এখনো প্রতিশ্রুত গেজেটেড ভাড়ার তালিকা সব ধরনের পরিবহনে টানানো হয়নি। আর এ পরিস্থিতির সর্বোচ্চ অপব্যবহার করে বাসমালিকেরা যাত্রীদের ‘পকেট কেটে’ চলেছেন।

যাত্রীরা শুধু এটুকুই জানেন যে নগরসমূহে সরকার বাসভাড়া ২৬.৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। সরকার-নির্ধারিত তালিকা অনুসারে নগর পরিবহনে কতটুকু ভ্রমণ করলে কতটুকু ভাড়া আসে, একজন যাত্রী তা জানেন না। তাই তাকে সংশ্লিষ্ট বাসের কন্ডাকটর যা দাবি করছেন, তা-ই মেটাতে হচ্ছে। কেউ যদি এর অন্যথা করতে চায়, তাকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

যদি এমন হতো যে কন্ডাকটর ৫ টাকার জায়গায় ৭ টাকা চাচ্ছেন, তাহলে হয়তো যাত্রীরা খুব শোরগোল করতেন না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাস অপারেটররা ৫ টাকার জায়গায় ১৫ টাকা পর্যন্ত দাবি করছে! এমন পরিস্থিতিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই যাত্রীদের প্রতিবাদ করতে হচ্ছে। আর এর ফল হিসেবে দুই পক্ষের মধ্যে বচসা এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে।

সরকার বোধ হয় এমন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল। তাই ভাড়া পুনর্নির্ধারণের পরদিনই তাদের পরামর্শে বাসমালিক সমিতির নেতারা ঘোষণা দিলেন যে, ঢাকায় কোনো বাস গেটলক বা সিটিং সার্ভিস নামে চলতে পারবে না। তারা এ সিদ্ধান্ত তামিল করার জন্য সাধারণ বাসমালিকদের তিন দিন সময় দিলেন; সঙ্গে এ-ও ঘোষণা করলেন যে, যারা এ সিদ্ধান্ত অমান্য করবে, তাদের শুধু জরিমানা গোনা নয়, এমনকি রুট পারমিট বাতিলের মতো শাস্তিও ভোগ করতে হবে।

তাদের ওই ঘোষণা অনুসারে একদিন ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে কিছু মোবাইল কোর্ট বসতে দেখা গেল। সেখানে মালিক সমিতির কোনো কোনো নেতাকেও দেখা গেল বেশ হম্বিতম্বি করতে। কিন্তু ওই এক দিনই, এরপর আর কোনো মোবাইল কোর্ট দেখা গেল না। মালিক সমিতির নেতারাও শীতনিদ্রায় গেলেন বলে মনে হলো।

গেটলক বা সিটিং সার্ভিসের বিষয়টা একটু পরিষ্কার করলে মনে হয় ভালো হবে। যদিও নগর পরিবহন আইনে এ ধরনের কোনো সার্ভিসের বিধান নেই তারপরও গত কয়েক দশক ধরে সড়ক পরিবহনে—নগরে কিংবা দূরপাল্লায়—গেটলক বা সিটিং সার্ভিস বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এসব সেবার আওতাধীন বাসগুলোতে সাধারণত নির্ধারিত আসনের বাইরে কোনো যাত্রী তোলা হয় না। এর ফলে যাত্রীরা গাদাগাদি করে চলার হাত থেকে রেহাই পান। আর এটুকু আরামের বিনিময়ে তারা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে একটু বেশি ভাড়া দিয়ে থাকেন। যেমন আগেরবার সরকার ন্যূনতম ভাড়া ঠিক করে দিয়েছিল বড় বাসের ক্ষেত্রে ৭ টাকা এবং মিনিবাসের ক্ষেত্রে ৫ টাকা। কিন্তু গেটলক ও সিটিং সার্ভিসের জন্য উভয় ক্ষেত্রেই যাত্রীদের দিতে হতো ১০ টাকা।

অথচ কয়েক বছর ধরে ঢাকা শহরের বাসগুলোতে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে গেটলক বা সিটিং সার্ভিসের রেট অনুসারে, কিন্তু যাত্রী তোলা হচ্ছে অপারেটরদের ইচ্ছেমতো গাদাগাদি করে। এর ফলে যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ দানা বাঁধছিল। পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে সম্প্রতি যখন বাস অপারেটররা ভাড়াবৃদ্ধির ভিত্তি ধরে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার পরিবর্তে ওই কথিত গেটলক ও সিটিং সার্ভিসের ভাড়াকে। বাস অপারেটরদের এ স্বেচ্ছাচারিতার ফলে নতুন হার অনুসারে যেখানে ভাড়া হওয়ার কথা ছিল ১০ টাকা সেখানে যাত্রীদের ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৫ টাকা, কোনো কোনো পরিবহনে তা এমনকি ২৫ টাকাও হয়ে যাচ্ছে।

আরেক দিক থেকেও জোচ্চুরি চলছে ঢাকার পরিবহন জগতে। এখানে বেশির ভাগ বাস চলে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজিতে। সরকার বলেছে, এবারের বর্ধিত ভাড়া শুধু ডিজেলচালিত বাহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সিএনজি বা অন্য কোনো জ্বালানিচালিত বাহনে নয়। সরকার এ সিদ্ধান্ত কতটুকু মানা হচ্ছে, তা নজরদারিরও ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম সব নগর সার্ভিসে লিখে দেওয়া হলো, এ গাড়িটি ডিজেলচালিত। অর্থাৎ সিএনজিচালিত বাসগুলো ঢাকা শহর থেকে রাতারাতি ভোজবাজির মতো হাওয়া গেল! অন্যদিকে সরকারের নজরদারিও স্রেফ কাগুজে ঘোষণাই রয়ে গেল।

শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ-ভাড়ায় ভ্রমণের প্রথাটিও উল্টে দেওয়া হয়েছে চলমান পরিস্থিতিতে। প্রথাটি চালু হয়েছিল পাকিস্তান আমলে, যা স্বাধীনতার পরও বহু বছর চালু ছিল। মাঝখানে গেটলক-সিটিং সার্ভিসের নামে তা বন্ধ হয়ে গেলেও ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সংঘটিত ছাত্র আন্দোলনের পর আবারও বেশ ভালোভাবে চালু হয়।

বাসমালিকেরা এখন আবারও তা বন্ধ করার চেষ্টা করলেও শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে। গত ২০ নভেম্বর শনিবার ঢাকার সায়েন্স ল্যাব মোড়, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন পয়েন্টে হাফভাড়া জারি রাখার দাবিতে ওরা বিক্ষোভ দেখিয়েছে, সেই সঙ্গে কিছু বাসও ভাঙচুর করেছে। আমাদের আশঙ্কা, সরকার যদি দ্রুত এতে হস্তক্ষেপ না করে তাহলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে।

অনেকের অভিযোগ হলো, সড়ক পরিবহন সেক্টর দেখভালের দায়িত্বে মন্ত্রীসহ যেসব সরকারি কর্মকর্তারা আছেন, তাদের সঙ্গে বাসমালিক ও বাসশ্রমিক নেতাদের একধরনের অশুভ আঁতাত আছে। সে কারণেই দেশের অন্যতম জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট যে খাতটি চলার কথা জনপ্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধানে সেটি অনেকাংশেই চলছে একটি মাফিয়া গোষ্ঠীর খেয়ালখুশিমতো, যার নগ্ন চেহারা চলমান বাসভাড়াবিষয়ক নৈরাজ্যে ফুটে উঠেছে।

কিন্তু এ অবস্থা চলতে পারে না। সাধারণত বাসে যারা চলেন তাদের প্রায় সবাই সীমিত আয়ের মানুষ। ফলে তাদের বর্ধিত বাসভাড়া বহন করার একটা সীমা আছে। সেই সীমা লঙ্ঘিত হলে তাদের ধৈর্যের সীমাও ভেঙে যেতে পারে, যার পরিণাম কারও জন্যই শুভ হবে না। বিশেষ করে সরকারকে বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে, যেহেতু জনগণের সুবিধা-অসুবিধা দেখার দায়িত্ব তারা নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন শপথের মাধ্যমে।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!