নারীবাদী লেখক নাওমি ওলফ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য বিউটি মিথ’ লিখেছেন সেই ১৯৯০ সালের দিকে। নারীকে সৌন্দর্যের সংজ্ঞায় বেঁধে বিভিন্নভাবে পণ্যায়ন করা ও বিভাজিত করার পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন তিনি বইটিতে। আমরা সেই বহু বহু কাল আগে থেকেই দেখে আসছি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারী দেহ, নারী চরিত্র সংজ্ঞায়িত হয়ে আসছে। ১৭ শতকের কবি রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র, লিখেছিলেন “স্ত্রী জাতি কথন”। দেহের আকার আকৃতি অনুযায়ী, কোন ধরনের নারী চরিত্রহীন, মিথ্যেবাদী, বহুগামী, কোন ধরণের নারী সত্যবাদী, চরিত্রবতী, স্বামীর প্রতি অনুরক্ত সেরকম কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছিল মধ্যযুগের এই পুরুষতান্ত্রিক কবিতাটিতে।
একবিংশ শতাব্দীতে, যেখানে সাস্টেইনেবল ডেভলপমেন্ট গোলে আমরা জেন্ডার ইকুয়েলিটি নিয়ে কথা বলছি, সেই সময়ে, ফ্যাশন ম্যাগাজিন ও নানান পত্রপত্রিকা নারীকে উপস্থাপন করছে মধ্যযুগীয় ভঙ্গিতে।
নারীদেহ এবং নারীদেহের সৌন্দর্য নিয়ে কোন বিরোধিতা নেই। নারী, পুরুষ, বাইনারি, নন-বাইনারি জেন্ডার সহ সকল ক্ষেত্রে, মানব শরীরকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করাতেই সমতা বিদ্যমান। বডি শেইমিং নয়, চাই বডি পজিটিভিটি।
সম্প্রতি ফ্যাশন ম্যাগাজিন ক্যানভাসের করা একটি ফিচার, যেখানে নারী শরীরকে উপস্থাপন করা হয়েছে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, আমরা যারা বাংলাদেশে নারীবাদী আন্দোলনের কর্মী তারা ক্ষুব্ধ হয়েছি। আমরা এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে যৌথভাবে বিবৃতি প্রদান করেছি। বিবৃতিটি নিম্নে তুলে ধরা হলো।
লেখক: আইনজীবী ও অধিকারকর্মী
মিডিয়ায় বডি শেমিং বন্ধ করুন – নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্টদের যৌথ বিবৃতি
--------------------------------------------------------------------
প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও লিঙ্গ সমতা ও বৈষম্যহীনতার লক্ষ্যে যে বৈশ্বিক যাত্রা তা থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে এই বাংলাদেশ। দেশে নারীর প্রতি অবমাননা, নির্যাতন ও বঞ্চনা অপমানের যে করুণ চিত্র আমরা দেখতে পাই, তাতে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কিংবা স্বপ্ন দেখবার সুযোগ নেই। তবুও, এই নিদারুন প্রতিকূলতার ভেতরেও, নারী পুরুষ ও সব লিঙ্গের মানুষের জন্য একটি সমতার পৃথিবী গড়তে এবং বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করছেন এদেশের নারীবাদীরা। এদেশে নারীবাদ আন্দোলন ধীরে এগুলেও বর্তমানে তা জোরালো হয়ে উঠছে। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য নারীর প্রতি সকল অবিচার, অন্যায়, বৈষম্য ও অবমাননা দূর করা। আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন, গোঁড়ামীপূর্ণ সমাজে এই ধরনের মানবিক বোধ প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন। তবু সেই কাজটি যে যার অবস্থান থেকে করে যাচ্ছেন। আমরা জানি, যে কোনো সমাজ বদলে একটি দেশের গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর প্রতি অবমাননা ও অবিচার দূরীকরণে গণমাধ্যমের প্রগতিশীল চিন্তা ও পদক্ষেপ সবসময়ই জরুরি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমরা, বাংলাদেশে নারীবাদ আন্দোলনের সাথে জড়িত কর্মীরা, লক্ষ্য করছি যে, বেশ কিছুকাল ধরেই এদেশের বেশ কিছু মূলধারার গণমাধ্যম নারীর প্রতি অবমাননাকর ফিচার, রিপোর্ট, ফটো ইত্যাদি প্রকাশ করে চলেছে। আমরা আতঙ্কিত হয়ে দেখছি যে, যেখানে ক্রমশ আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে চলবার কথা, সেখানে নানারকম কন্টেন্ট তৈরি ও প্রকাশ হচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যমে, যে কন্টেন্টগুলো সরাসরি নারীর প্রতি চরম অপমান, অবমাননার পক্ষে অরুচিশীল বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। সম্প্রতি লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন হিসেবে খ্যাত ক্যানভাস পত্রিকা ১৭ শতকের কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের লেখা কবিতা ‘স্ত্রীজাতি কথন’কে সামনে রেখে ফটোশ্যুট ও ফিচার প্রকাশ করেছে। নারীর প্রতি চরম অসম্মানজনক এই কবিতাটিতে বর্ণিত পদ্মিনী, হস্তিনী, চিত্রিণী ও শঙ্খিনী নারী কেমন হবে, তার প্রেজেন্টেশন হয়েছে। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের তৎকালীন সামাজিক ও মানসিক চেতনার প্রেক্ষাপটে লেখা এই চরম পুরুষতান্ত্রিক, নারীবিদ্বেষী, ভোগবাদী কবিতাটিকে নতুন করে কেন সামনে আনা হলো, সেটি নিয়ে ভেবে দেখবার আছে বলে আমরা মনে করি। এর পেছনে কোনো পক্ষের কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখবার রয়েছে। এই একবিংশ শতকে নারীর প্রতি এই চরম রেসিস্ট, বডি শেমিংভিত্তিক পদ্যটিকে মহিমান্বিত করে তুলে ধরবার পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে একটি গণমাধ্যমের এদেশের নারীরা তা জানতে আগ্রহী। আমরা যারা নারীবাদী আন্দোলনে সম্পৃক্ত, তারা আশংকা অনুভব করছি এই ভেবে যে, কোনো একটি অসৎ মহল অসৎ উদ্দেশ্যে নারীর অগ্রযাত্রা, কুপ্রথা ভাঙ্গবার লড়াই ও মাথা উঁচু করে চলবার জন্য অর্জিত সাহস, মনোবল ও আত্মবিশ্বাসকে ভেঙ্গে দিতে তৎপর হয়েছে। নারীর প্রতি এ ধরনের মনোভাব পোষণকারী কবিতাকে নতুন করে সামনে এনে এই পুরুষতান্ত্রিক, ন্যাক্কারজনক মনোভঙ্গি ও চেতনা তোষণকারী গণমাধ্যম- ক্যানভাসের এ ধরনের আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে নারীবাদী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মীরা। অবিলম্বে ক্যানভাস কর্তৃপক্ষকে এই ফিচার প্রকাশের দায়ে ক্ষমা চাইবার আহ্বান জানানো হচ্ছে। সেইসাথে আমাদের দাবি ক্যানভাসের অনলাইন সংস্করণ থেকে লেখাটি তুলে নিতে হবে। একইসাথে ভবিষ্যতে এ ধরনের সেক্সিস্ট, বডি শেমিংমূলক কন্টেন্ট প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে সতর্ক থাকবারও অনুরোধ জানানো হচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করছি, নারীর অগ্রযাত্রা, লিঙ্গ সমতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় এদেশের প্রতিটি গণমাধ্যম ভবিষ্যতে আরো প্রগতিশীল ও সংবেদনশীল আচরণ করবে।
১। সুপ্রীতি ধর
২।শারমিন শামস্
৩।কাবেরী গায়েন
৪।স্নিগ্ধা রেজওয়ানা
৫।ফারহানা হাফিজ
৬।কাশফিয়া ফিরোজ
৭।আফসানা কিশোয়ার লোচন
৮।তাসলিমা মিজি
৯।নাহিদ সুলতানা
১০।দিলশানা পারুল
১১।গীতি আরা নাসরিন
১২।প্রমা ইসরাত
১৩।লাকী আক্তার
১৪।অপরাজিতা সঙ্গীতা
১৫।মাহা মির্জা
১৬।ইশরাত জাহান ঊর্মি
১৭।নাহিদ আক্তার
১৮।কানিজ আকলিমা সুলতানা
১৯।ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী
২০।শাশ্বতী বিপ্লব
২১।জান্নাতুন নাঈম প্রীতি
২২।নাহিদা আক্তার
২৩।অরণি আঞ্জুম
২৪।ফাহমিদা হানিফ ইলা
২৫।মেহেরুন নূর রহমান
২৬।ক্যামেলিয়া আলম
২৭।হাবিবা রহমান
২৮।মিতি সানজানা
২৯।বীথি সপ্তর্ষী
৩০।শাহাজাদী বেগম
৩১।মারজিয়া প্রভা
৩২।ফেরদৌস আরা রুমী
৩৩।জোবাইদা নাসরীন
৩৪।রাওয়ান সায়েমা”