• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গণপরিবহন খাতে রাজনীতির প্রভাব


তুষার আবদুল্লাহ
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২১, ০৮:২৬ পিএম
গণপরিবহন খাতে রাজনীতির প্রভাব

পায়ের তলায় তিলও নেই, শর্ষেও নেই । তাই বরাতে বিদেশ ভ্রমণ জোটে কালেভাদ্রে । যে কয়টি দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়, সেখানে গিয়ে শহর ঘুরতে আমার প্রথম নজর থাকে গণপরিবহনের দিকে। কারণ, নিজের পর্যবেক্ষণে দেখেছি, যে শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল, নাগরিক বা যাত্রীবান্ধব, সেই দেশ এবং জাতি সভ্য। অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রেও তাদের সভ্য আচরণের পরিচয় পাওয়া যায়। সেদিক থেকে বিদেশ ঘুরে এসে বা যারা বাংলাদেশ সফরে আসেন, তারা বিমানবন্দরের উঠান থেকেই আঁচ পেয়ে যান, এই শহরের পরিবহনব্যবস্থা কতটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে, এবং আমরা কতটা সভ্য।

গণপরিবহন নিয়ে ছোটবেলা থেকেই অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো নয়। স্কুলে যেতাম গুলশান থেকে ৬ নম্বর বাসে ফার্মগেট। কখনো টেম্পোতে চড়তে হতো। বাড্ডা থেকে হিউম্যান হলার নামের একপ্রকার বাহন যেত গুলিস্তান। সারাস্তা মোড় পর্যন্ত তার যাত্রী হতে হয়েছে বহুবার। যখন কাজ শুরু করি তখন রামপুরা ব্রিজ থেকে মুড়ির টিন নামক বাহনে পল্টন, সদরঘাট গেছি । খুব কম দিন ছিল যেদিন চালক, কন্ডাক্টর বা হেলপারের সঙ্গে ঝগড়া দেখিনি কোনো না কোনো যাত্রীর। আমার সঙ্গেও হয়েছে একাধিক দিন। ঝগড়ার কারণগুলোর মধ্যে ছিল নারী যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, ভাড়া কমবেশি নিয়ে তর্ক, যাত্রীকে যেখানে-সেখানে নামিয়ে দেওয়া, যেখানে বাস থামবে, সেই বাসস্টপেজের বাইরে বা দূরে বাস থামানো। এ নিয়ে ঝগড়া তর্ক, কখনো কখনো গাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটেছে।

শৈশবকালের সেই পরিবহন নৈরাজ্য এখনো থামেনি। তখন পরিবহন সেক্টরের সিন্ডিকেট কী, জানা ছিল না। এখন সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও শোষণে পিষ্ট হচ্ছি। বেপরোয়া গতিতে মানুষ হত্যা, গাড়ি থেকে যাত্রীকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া, চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণের পরেও, পরিবহন মালিক শ্রমিকরা কাউকেই পরোয়া করছে না। যেকোনো ছুতোয় বা মন চাইলেই ধর্মঘট ডেকে দিচ্ছে। তেলের দাম যে কয় টাকা বাড়ে, তার কয়েক গুণ ভাড়া তারা জোর করে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করে। প্রতিবাদ করলেই ধর্মঘট। এবার তো দেখলাম ডিজেলের দাম বাড়ায়, সিএনজিচালিত বাসেও তারা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। আছে গেট লক, সিটিং সার্ভিস নিয়ে মাস্তানি। যে মাস্তানির কাছে অসহায় সাধারণ যাত্রী।

অসহায় শুধু সাধারণ যাত্রীরাই নন, সরকারও। সব সরকারের সময়েই দেখেছি পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা ধর্মঘট, কর্মবিরতি ডেকে সরকারকে চাপে রেখেছে। বিআরটিএ মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গেলেই ধর্মঘট। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকেই বরাবর পরিবহন খাতে নেতৃত্বে দেখা যায়। তাদের মুখ থেকেই শোনা যায়, কারা ধর্মঘট ডেকেছে আমরা জানি না। বিআরটিসিতে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন চেয়ারম্যান একবার অসহায়ভাবে বলেছিলেন, তার দলের লোকেরাই বিভিন্ন রুটে বাস নামাতে বাধা দেয়।

ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক, ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে কোম্পানি গঠন করে রুট বিন্যাস করতে চেয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর ওই প্রকল্পে শীত নেমে এসেছে। বর্তমানে দুই প্রান্তের মেয়র কয়েকটি রুটে কোম্পানির আওতায় পরীক্ষামূলক বাস চালুর কথা বলছেন শিগগিরই। কিন্তু সাধারণ যাত্রীরা এই আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না।

শুধু ঢাকাতেই নয়। দেশের সব রুটেই পরিবহন, মালিক শ্রমিকরা তাদের খুশিমতো চলছে। প্রশাসন কোনোভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এবার ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর আবার সেই পুরোনো নৈরাজ্য দেখে, পরিবহন খাতের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা প্রশ্রয়মুক্ত না হলে এ খাতও বিড়ম্বনামুক্ত হবে না।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!