বাংলা, বাঙালিত্ব, বাংলাদেশকে ধারণ করা মৌলবাদের বিরুদ্ধের অনেক স্লোগান নানা সময়ে চওড়া গলায় দিয়েছিলাম। অনেকের সঙ্গে মেলানো কণ্ঠ কত দূর পৌঁছেছিল সে দিকে খেয়াল না রেখে শুধু রেখেছিলাম এটা নিজের ভেতর পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে কি না? ভেতরেই পৌঁছেছে, আছে এখনও। তবে আমাদের সঙ্গে গলা মেলানো জনগোষ্ঠীর সংখ্যা-পতন হয়েছে। সংখ্যাগুরু থেকে আমরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছি। দিনে দিনে যে স্লোগান, যে আহ্বানের ব্যাপ্তির বিস্তার লাভের কথা ছিল, তার উল্টো হয়েছে। এককালের তুমুল প্রগতিশীলের অনেকেই এই কালে এসে অন্য পথ ধরেছে। এখন তারাই নিয়ন্ত্রক প্রায়; সংখ্যায়, প্রভাবে, ক্ষমতার দর্পে। ফলে বাঙালিপ্রধান দেশে বাঙালিই যেন আশ্রয়হীন!
আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির বয়স হাজার বছরের। নানা ধর্ম, নানা বর্ণ, নানা বিশ্বাসে আমরা আপাত বিভক্তি থাকলেও ঐতিহ্য ও কৃষ্টির জায়গায় ছিলাম অভিন্ন—বাঙালি। কালের পরিক্রমায় কিংবা প্রকৃতির নিয়মে অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন টিকে ছিল স্বমহিমায়। টিকে আছে যদিও, তবে এখানেও আছে নানা বাধা, নানা প্রচার-অপপ্রচার, স্পর্শকাতর অনুভূতির ব্যাখ্যায় বিভক্তি, মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মকে। ধর্ম এখানে অপ্রাসঙ্গিক যদিও তবু ধর্মের নামে বিভক্তির রেখা টানার অপচেষ্টা চলমান। এটা একদিনের নয়, তবে এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে গত কয়েক বছর। আগে মিহি গলায় যে আপত্তির রব ওঠত, এখন সেটা উচ্চকণ্ঠে, নির্বিঘ্নে ও আরও শক্তিমান হয়ে উঠেছে।
অন্ধত্ব আর অন্ধকার গ্রাস করছে। চারিদিকে এত অন্ধকার, যার সরাসরি লক্ষ্যবস্তু বাঙালির সংস্কৃতি। আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে ভোগা একদল লোক আগের চাইতে অনেক বেশি সংগঠিত হয়ে এই প্রচারণায় নেমেছে। তারা না বাঙালি, না অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর। পিছিয়ে থাকা ধার করা সংস্কৃতির চর্চায় আকণ্ঠ নিমগ্ন, অথবা সংস্কৃতি আদতে কী—ওটা বুঝতে অক্ষম। তারা তাদের অবস্থান বুঝতে পারছে না ঠিক, তবে অন্যদের বিশেষ করে বাঙালিয়ানায় আঘাত হানছে সরাসরি; ধর্মের নামে। অথচ ধর্ম এখানে বাধা হওয়ার কথা ছিল না। কারণ ধর্ম পুরোটাই বিশ্বাস, আর সংস্কৃতি তো চর্চা-আচার-আচরণ। চিন্তার দীনতা এতখানি দখল করবে তাদের, কে কবে ভেবেছে? অথচ এটাই বাস্তবতা! তাই পহেলা বৈশাখ নিয়ে যত আপত্তি, যত বক্তব্য, যত বাধা!
বাঙালির প্রাণের উৎসব বর্ষবরণ ও পহেলা বৈশাখ এখন সেই শ্রেণির কারণে আতঙ্কে পরিণত হতে চলেছে। বর্ষবরণের সময়ে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তুমুল প্রাণোন্মাদনার বর্ষবরণের সময়ে জঙ্গি হামলার আশঙ্কার কথা জানায় পুলিশ প্রশাসন। এবারও এসেছে এই বিধিনিষেধ। দুপুর দুইটার মধ্যে শেষ অনুষ্ঠান! দিন দিন কীভাবে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে প্রাণের উৎসবের আয়োজনকে, ভাবা যায়! অথচ হুমকিতে ভীত না হয়ে প্রশাসন তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারলে ফি-বছর এমন বিধিনিষেধ আসতো না। বিধিনিষেধের নামে সংস্কৃতির এই সঙ্কোচনের রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের দুরভিসন্ধি রয়েছে। হুমকিদাতা পক্ষ এবং শাসক পক্ষ উভয়েই এ ফায়দা নিচ্ছে। অথচ শাসক পক্ষে সঙ্কোচন প্রক্রিয়ায় না হেঁটে বিস্তৃতকরণধারায় গেলে লাভবান হতো দেশে, সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিসেবীরা।
বাঙালিপ্রধান মানুষের দেশে বাঙালিই এখন নিজস্ব উৎসবের দিনে প্রাণের ভয়ে ভীত। একদিকে প্রাণের হুমকি, অন্যদিকে নিরাপত্তার নামে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, গণমানুষের প্রাণাবেগ কুক্ষিগত করার চেষ্টা। লক্ষ্য, ভয়ের পরিবেশ তৈরি। ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। দেশের কোথাও কি এখন যাত্রাপালা, কবিগান বা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন নির্বিঘ্নে হয়? হয় না। হয় না কারণ জঙ্গি হামলার ভয়। আয়োজকরা যেমন নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন, তেমনি প্রশাসনের তরফেও রয়েছে অনুমতি নামের বিশাল ভোগান্তি। এসবের বাইরে দেশের নানা জায়গায় কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, তবে ওগুলো যতটা না সংস্কৃতি চর্চার তারচেয়ে বেশি সরকারি কর্মসূচি। গণমানুষের অংশগ্রহণের চাইতে কর্মকর্তা-উপস্থিতিই মুখ্য থাকে ওসবে। মঙ্গল শোভাযাত্রাগুলো যেভাবে ঘিরে রাখে পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী তাতে নিরাপত্তা দেওয়া হলেও মনে হয় বাঙালি নিজ দেশেই পরবাসী হয়ে আছে। এগুলো গৌরব নয়, গ্লানি-বিশেষ আমাদের।
এই অপ্রাপ্তি, হাহাকারগুলোর মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকা আমরা পহেলা বৈশাখ ও বর্ষবরণে সান্ত্বনা আর আকাঙ্ক্ষার কথা জানাতে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নিই। রবীন্দ্রনাথ বৈশাখকে দেখেছেন গ্লানি মোছার উপলক্ষ হিসেবে, জরা ঘুচিয়ে ধরিত্রীকে অগ্নিস্নানে শুচি দেখতে চেয়েছেন। বৈশাখে রাবীন্দ্রিক আকাঙ্ক্ষাও তাই আমাদের চাওয়ার সঙ্গে মিলে যায়। ❛মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা❜। সেই রবীন্দ্রপর্ব থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিবারই মানুষ গায় এমন, প্রতিবারই এমন আকাঙ্ক্ষার কথা জানান দেয়। শাশ্বত এই আকাঙ্ক্ষা, অনিঃশেষ।
বৈশাখ আসে, বৈশাখ যায়; আমাদের চাওয়াটা স্থির। প্রতিবারই ভাবি এই সময়টা দুঃসহ, এই সময়টা কঠিন, এই সময়টা অশুচি। তাই অনিঃশেষ আকাঙ্ক্ষার পালে হাওয়া লাগিয়ে প্রতিবারই একই কথা বলি। গতবারও বলেছি, এবারও বলছি, এর আগে অনেকবার বলে এসেছি, ভবিষ্যতেও এমন বলবো। বলবো জানি, তবে জানি না গ্লানি মোচনের পর্বটা কেমন, জরা কেটে গেলে কেমন, জানি না শুচিপর্বটাও কেমন। ফের রবীন্দ্রনাথে আশ্রয়—❛রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি/ আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ/ মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক❜।
শুভ নববর্ষ ১৪২৯!
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক