ভগৎ সিং। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রাণপণে গর্জে ওঠা এক সাহসী বীরের নাম। তিনি তৎকালীন ভারত উপমহাদেশ কিংবা আজকের ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত আপসহীন এক স্বাধীনতাসংগ্রামী হিসেবে। মাত্র ২৩ বছর বয়সে ব্রিটিশ শাসক তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল। তাঁর সঙ্গে আরও দুই বিপ্লবী সুখদেব থাপার ও শিবরাম রাজগুরুর ফাঁসি হয়েছিল। লাহোরে এই ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
ব্রিটিশ পুলিশকে খুন করা ও পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলি হাউসে বোমা ছোড়ার অভিযোগ ছিল ভগৎ সিংয়ের বিরুদ্ধে। লাহোরে অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনার জন স্যান্ডার্স হত্যাকাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন তিনি।
১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেসের সময় তরুণ ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় বাংলার আরেক বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর। ভগৎ সিং তখন পলাতক আসামি হিসেবে আত্মগোপনে ছিলেন। পুলিশের কাছে তাঁর নামে ওয়ারেন্ট ছিল। মহারাজের সঙ্গে দেখা করার সময় রামশরণ দাসকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। রামশরণ দাস তখন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় দণ্ডিত আসামি। তিনি ছিলেন মহারাজের পূর্বপরিচিত, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল রামশরণ দাসের সঙ্গে। তাঁরা একসঙ্গে আন্দামানে জেল খেটেছেন।
রবীন্দ্রমোহন সেনের আপার সার্কুলার রোডের বাসায় এক রাতে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। সাক্ষাতে ভগৎ সিং মহারাজের কাছে বোমা ও পিস্তল চান। মহারাজ তাতে সাড়া দিয়ে ভগৎ সিংয়ের হাতে বোমা ও কয়েকটি পিস্তল দিয়েছিলেন। অতি গোপন সে সাক্ষাৎ পর্বে আরও উপস্থিত ছিলেন বিপ্লবী প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলী।
তরুণ বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের ধারণা ছিল, পাঞ্জাব ঘুমিয়ে আছে, পাঞ্জাবের জনতাকে জাগাতে হবে। আর এ জন্য সাহসী কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। সে কারণেই তিনি এই সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলেন। ভগৎ সিং পাঞ্জাবে সন্ত্রাসবাদমূলক কাজ করার জন্য মহারাজের অনুমতি চাইলেন, একই সঙ্গে এর সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তিও উপস্থাপন করলেন।
আলোচনার একপর্যায়ে ভগৎ সিং বললেন, ‘পাঞ্জাব অনেক পেছনে পড়িয়া আছে, পাঞ্জাবকে জাগাইতে হইবে, পাঞ্জাবের লোক ভাব-প্রবণ, জমকাল (sensational) কোন কাজ দেখিলেই তাহারা লাফাইয়া উঠিবে, ঝাঁপাইয়া পড়িবে। আপনারাও ত সন্ত্রাসবাদমূলক কাজ করিয়াছেন। আমরা পাঞ্জাবে বিপ্লবী দল গঠনের চেষ্টা করিয়াছি কিন্তু কিছুই করিতে পারি নাই।’ মহারাজকে উদ্দেশ করে ভগৎ সিং বললেন, ‘আপনি নিজে একবার পাঞ্জাব গিয়া পাঞ্জাবের অবস্থা দেখিয়া আসুন। আপনি রামশরণবাবুকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি ঠিক কথা বলিতেছি কি না।’
বিপ্লবী আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে অমর বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের। এ সম্পর্কে শুভেন্দু মজুমদার লিখেছেন, ‘সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে লাহোরে পুলিশের হাতে চরম নিগৃহের শিকার হয়ে মারা গিয়েছিলেন পাঞ্জাব কেশঠী লামা...রাই (১৭ নভেম্বর, ১৯২৮)। ছেপি স্যান্তার্স নামে যে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার এ ঘটনার জন্য দায়ী ছিলেন, তাকে এক মাসের মধ্যে (১৭ ডিসেম্বর, ১৯২৮) ভগৎ সিং, রাজ্যগুরু, চন্দ্রশেখর...প্রমুখ হিন্দুস্থান.... রিপাবলিকান আর্মির সদস্যরা হত্যা করে...বুঝিয়ে দেন যে প্রতিরোধই হল...সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। ভগৎ সিং কলকাতায় এসে আত্মগোপন করেন। বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলী প্রমুখের সঙ্গে ভগৎ সিং ও তাঁর সঙ্গীসাথিদের বিপ্লবী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হয়। ত্রৈলোক্যবাবুরা ভগৎ সিংকে খুশি করার জন্য কয়েকটি পিস্তল ও বোমা দেন। এ ঘটনার কিছুদিন পরে ভগৎ সিংরা দিল্লীর কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা ছুড়ে (৮, এপ্রিল ১৯২৯) গ্রেপ্তার হন। ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেবের ফাঁসি হয়।
বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বইতে বর্ণনা করেন এভাবে—‘ভগৎ সিং এর কথার মধ্যে সরলতা ছিল, আন্তরিকতা ছিল। অল্পবয়স্ক যুবক—তাহার কথা এবং আন্তরিকতা দেখিয়া আমরা সকলেই মুগ্ধ হইয়াছিলাম। আমি রামশরণবাবুকে বলিলাম, ‘আগামী লাহোর কংগ্রেসের সময় আপনি কংগ্রেসে যোগদান করিয়া সুভাষবাবুর ভলান্টিায়ার বাহিনীর মত একটি কংগ্রেসের ভলান্টিয়ার বাহিনী গড়িয়া তুলুন। আপনার অতীত ইতিহাস আছে, আপনি বহু বৎসর জেলে ছিলেন, আপনি চেষ্টা করিলে কংগ্রেসের মধ্যে নিজের স্থান করিয়া লইতে পারিবেন এবং ভগৎ সিং যাহাতে ভলান্টিয়ার বাহিনীর চার্যে থাকিতে পারে সে ব্যবস্থা করিবেন।’ আমি ভগৎ সিংকে বলিলাম, ‘তুমি পাঞ্জাবের বিভিন্ন জেলা হইতে পাঁচ হাজার ভলান্টিয়ার সংগ্রহ করার চেষ্টা কর। এই দল হইবে তোমার ভাবী বিপ্লবের প্রধান সম্বল। পাঞ্জাবীরা সামরিক জাতি। অনেকের আত্মীয়-স্বজন সৈন্যবিভাগে আছে। যদি তুমি একটি ভাল ভলান্টিয়ার দল গড়িয়া তুলিতে পার, তবে তাহাদের দ্বারাই একটা অভ্যুত্থান সম্ভব করিতে পারিবে। আমরা ভগৎ সিংকে খুশি করার জন্য কয়েকটা পিস্তল ও বোমা দিলাম। আমি পরে রামশরণ দাসকে বলিলাম, ‘এখন এই পিস্তল, বোমা ব্যবহার করিবেন না।’ ভগৎ সিং খুশি হইয়া পাঞ্জাব চলিয়া গেল। ভগৎ সিং প্রথমে দল গঠন করার চেষ্টা করিয়াছিল কিন্তু কোন সাড়া না পাইয়া নিরাশ হইয়া পড়িল। তখন তাহার এই ধারণাই বদ্ধমূল হইল, পাঞ্জাবকে জাগাইতে হইলে চমকপ্রদ কিছু করিতে হইবে, নতুবা পাঞ্জাবের যুবকদিগের মোহনিদ্রা ভাঙ্গিবে না। কিছুদিন পর দেখা গেল, পাঞ্জাব এসেম্বলিতে বোমা পড়িয়াছে। এই বোমা নিক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল,‘চমকপ্রদ কিছু করিলে পাঞ্জাবের যুবকেরা জাগিবে।’ ভগৎ সিং ইহা জানিত, এই বোমা নিক্ষেপ দ্বারা বা কতিপয় সাহেব খুন দ্বারা দেশের স্বাধীনতা আসিবে না। ভগৎ সিং বিশ্বাস করিত, ইহা দ্বারা দেশ এগিয়ে যাবে, দেশের যুবকদিগের মধ্যেও আসিবে নব-জাগরণ। দেশপ্রেমিক বীর ভগৎ সিং ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়া দেশের যুবকদিগের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করিয়াছিল। ধন্য ভগৎ সিং।’
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক