বরিশালের সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনে হামলা এবং পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষের ঘটনার পর মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছেন রাজনীতিবিদ ও আমলারা। বিবৃতি এসেছে আমলাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে। এরই মধ্যে এ নিয়ে থানায় একাধিক মামলা হয়েছে। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে।
একটা বিভাগীয় শহরের এমন ঘটনার পর বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ঘটনার পরের দিন এক জরুরি সভায় এই ঘটনার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি তারা এককভাবে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে দায়ী করেছে। তারা আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানায় ‘আইনের মাধ্যমেই দুর্বৃত্তদের মোকাবেলা করা হবে’ এবং ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে’। অ্যাডমিন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বরিশালের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে সরকারি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে একজন নির্বাহী অফিসার কীভাবে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের দ্বারা হেনস্তা হয়েছেন। তার বাসায় হামলা করা হয়, যেখানে তার করোনায় আক্রান্ত অসুস্থ পিতামাতা উপস্থিত ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতেই উক্ত কর্মকর্তাকে গালিগালাজ করা হয়েছে, তার বাড়ির গেট ভেঙে প্রবেশ করা হয়েছে, আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি ব্যবহার করা হয়েছে, তার চামড়া তুলে নেওয়ার জন্য প্রকাশ্যে স্লোগান দিয়ে মিছিল করা হয়েছে। মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও তার দুর্বৃত্ত বাহিনী সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের দিয়ে নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে এবং সমস্ত জেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।’
এতে আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এমন কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা জানায় এবং বরিশালের মেয়র, যার অত্যাচারে সমগ্র বরিশালবাসী অত্যন্ত অতিষ্ঠ সেই সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর হুকুমেই এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে তারা মনে করেন। অতএব বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অবিলম্বে তার গ্রেপ্তার দাবি করছে এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে’। ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অত্যন্ত আস্থাবান’ উল্লেখ করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘আমরা দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকব, সেই সঙ্গে এই সব রাজনৈতিক দুর্বৃত্তকে আমরা আইনের মাধ্যমেই মোকাবেলা করব এবং আইনের মাধ্যমে স্বচ্ছ জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে অভিপ্রায় সে ব্যাপারে সকলেই অঙ্গীকারবদ্ধ এবং কোনো পরিস্থিতিতেই তারা সেই পথ থেকে বিচ্যুত হবে না।’ সদস্যদের পক্ষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সাক্ষর করেন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার।
‘মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অত্যাচারে অতিষ্ঠ বরিশালবাসী’, বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এই অভিযোগ আমলে নেওয়া দরকার। ওখানে ‘ত্রাসের রাজত্ব’ কায়েমের যে অভিযোগ সেটাকে হালকাভাবে নেওয়ার অবকাশ নাই। সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের ভাষায় ‘ত্রাসের রাজত্ব’ কায়েমের যে অভিযোগ সে জন্য কি তারা নিজেদের দায় এড়াতে পারে? ত্রাসের রাজত্বের বিরুদ্ধে তারা এত দিন কেন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি? কেন করেননি—মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ নিজেকে ‘প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়’ বলে পরিচয় দেন এজন্য? এটা যদি সত্য হয় এই প্রশাসনও তাহলে সাদিক আবদুল্লাহর ত্রাসের রাজত্বের সহযোগী। প্রধানমন্ত্রীর দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় কেউ হতেই পারেন। আবার কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এ নিয়ে সতর্কতামূলক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, যেখানে তিনি তার ও শেখ রেহানার পরিবার ছাড়া আরও কাউকে আত্মীয় বলে স্বীকৃতি দেননি। এর মাধ্যমে তিনি আত্মীয় পরিচয়ে অন্য কারও সুযোগ-সুবিধা আদায়ের পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। সেখানে কেন সাদিক আবদুল্লাহ কিংবা অন্য কেউ যেকোনো অন্যায়ে প্রশাসনের সহযোগিতার কিংবা নীরব ভূমিকার সুবিধাভোগী হবেন?
ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণকে কেন্দ্র করে অথবা অন্য কোনো কারণে বরিশালে যে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক বিচার সবাই চায়। তবে এভাবে তদন্তের আগে আগবাড়িয়ে জরুরি সভা করে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এমন অবস্থান গ্রহণ ও বিবৃতি কতখানি জরুরি ছিল, সেটাও ভাবার বিষয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরাও সংগঠন করার অধিকার রাখেন কিন্তু এভাবে কোনো ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এভাবে একটা পক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া কি উচিত হলো?
সরকারি কর্মচারীরা রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে, এখানে ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। পাবলিক সার্ভেন্টদের যারা সংগঠন করে তদন্তের আগে কোনো একটা পক্ষে অবস্থান নেওয়া তাদের উচিত নয়। বরিশালের ঘটনায় তড়িঘড়ি করে জরুরি সভা করে বিবৃতি দেওয়ার অবকাশ নেই। এই বিবৃতি তদন্ত প্রক্রিয়া ও সরকারের অবস্থানকে প্রভাবিত করবেই। যার প্রভাব পড়বে বিচারের ওপরও। ঘটনার পর পর যেখানে মামলা হয়েছে, একাধিক আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্র উল্লিখিত এলাকার নির্বাহী অফিসারের বিপক্ষে যায়নি, যেখানে আক্রান্তের বিচারপ্রাপ্তির ন্যায়সংগত অধিকারের ক্ষুণ্ণ হয়নি, সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের সংগঠনের এমন অবস্থান নেওয়ার দরকার ছিল না। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন গঠনের মিশন ও ভিশন অংশের (খ) অংশে বলা হয়েছে—‘যে কোন সদস্য বা সকল সদস্যের আইন অনুযায়ী ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার যথা: চাকুরির কাঠামো, বেতন, পদমর্যাদা, আপেক্ষিক জ্যেষ্ঠতা ইত্যাদি সকল স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দাবিসমূহ ন্যায়নীতি, ন্যায্য অধিকার ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ।’ এখানে হুট করে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর বড় পরিসরে রাজনীতিবিদ ও প্রশাসন ক্যাডারদের মুখোমুখি করার দরকার তো ছিল না। এমন অবস্থায় উভয় সংকটে পড়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। একদিকে ‘প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়’ পরিচিতিকে আনতে চাওয়া মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ আর অন্যদিকে ‘আমলাতন্ত্র’। এখানে দিন শেষে যা-ই ঘটুক না কেন, ক্ষতিটা মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের।
বাংলাদেশের ক্ষমতার বলয় মূলত ঘুরপাক খায় ব্যবসায়ী, আমলা আর রাজনীতিবিদদের মধ্যে। মাঠের রাজনীতি মাঠের বাইরে চলে যাওয়ার পর থেকে ব্যবসায়ী আর আমলাদের দখলে অনেক কিছুই। এটা রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশেষত শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। যত দিন যাচ্ছে ততই সবখানে আমলাদের পদায়ন হয়ে চলেছে, এবং এটা করে চলেছে রাজনৈতিক সরকারই। আগের সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকারও এর ব্যতিক্রম নয়। ব্রিটিশরা আমলাদের দিয়ে দেশ শাসন করত। পাকিস্তানিরা সামরিক আমলাতন্ত্রে আস্থা রেখেছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু সেই পথে হাঁটেননি। যদিও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আমলাতন্ত্র সেই আগের তো শক্তিমান হয়েছে, আর এখন শেখ হাসিনার সরকার সেই আমলাতন্ত্রকে শক্তিমান হতে সমূহ জ্বালানির জোগান দিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে একের পর এক সাবেক আমলাদের পদায়ন করেছে, করছে। নির্বাচনে আমলাদের ব্যবহার হয়েছে, রাজনৈতিক সরকারেও আমলাদের স্থান হয়েছে, এমনকি দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির শীর্ষ পদেও আমলারা জায়গা পেয়েছেন। সিইসি, দুদক, বিমান, মেট্রোরেল, পিএসসি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিমান, বিআরটিসিসহ যেখানেই তাকানো যায়, সেখানেই আমলাদের স্থান। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ গড়ার কারিগর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর রাষ্ট্রীয় যে আয়োজন সেখানেও আমলাদের স্থান, অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভাবে আমলাতান্ত্রিক দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেননি। চলমান করোনাকালে দেশের ৬৪ জেলার ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিতে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা জনপ্রতিনিধি নন, তারাও আমলা; অথচ সাংবিধানিক পদমর্যাদায় সচিবদের ওপরে সংসদ সদস্যদের স্থান।
আমলাদের যখন এই অবস্থান, তখন স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতিবিদেরা দৃশ্যপটের বাইরে চলে গেছেন, অথবা তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন সরানো হলো? তারা কি অযোগ্য, ব্যর্থ? উত্তর সরাসরি পাওয়ার মতো নয়; আদতে রাজনৈতিক সরকার রাজনীতিকদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের এই সময়ে সরকার চালাচ্ছেন যারা তাদের বেশির ভাগই অনভিজ্ঞ। এই অনভিজ্ঞতা তাদের দুর্বলতা রূপে প্রতিপন্ন হয়েছে। আর এর সুযোগ নিয়েছে আমলাতন্ত্র। ফলে দেখা যায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের লোকজন আমলাতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করছে। এতে তাদের দুর্বলতা যে প্রকাশিত হচ্ছে তা না ভেবেই তারা একপাক্ষিকভাবে অনেক ঘটনায় তদন্তের আগেই আমলাতন্ত্রের পক্ষাবলম্বন করে আসছে।
স্মরণ করছি প্রয়াত আহমদ ছফার একটা মন্তব্য যেখানে তিনি বলেছিলেন—‘আমলারা নিজেরাই একটা পার্টি’। আপনি আহমদ ছফাকে পছন্দ-অপছন্দ যা-ই করুন না কেন, এটাই বাস্তবতা। বরিশাল পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের অবস্থান এই লেখকের মন্তব্যের গভীরতাকে সামনে নিয়ে আসে। অস্থিতিশীল ও দুর্বল সরকার ব্যবস্থায় আমলারা তাদের আমলাতন্ত্রের ছড়ি ঘোরাতে শুরু করে। এখন কি সেই অবস্থা? যখন দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই, যখন শক্তিশালী বিরোধী দল নেই, যখন সরকার প্রশাসননির্ভর, যখন সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নেই, তখন অন্য কেউ ছড়ি ঘুরাতে যাবে না তো কখন যাবে? অথচ এমনটার জন্য একাত্তরে আমাদের সেই ঐতিহাসিক ত্যাগ ছিল না।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন কোনো ঘটনায় সংক্ষুব্ধ হয়ে জরুরি সভা করে এবং গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে কাউকে ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত’ বলে আখ্যা দেওয়া কতখানি সুবিবেচনার, সেটা আলোচনার দাবি রাখে। তবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিকসহ নানা ক্ষেত্রে যে দুর্বৃত্তায়নের ধারা চলছে সেটা সংস্কৃতি রূপে স্থায়িত্ব পাওয়ার পথে। এ থেকে আমাদের বেরোতে হবে; এ ছাড়া উপায় নেই।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক