সকালে ভাত খেয়ে লিখতে বসলাম। কতটুকু খেলাম? মেপে দেখেনি। উপযোগ বা তৃপ্তির চূড়ান্ত ধাপ অবধি খেলাম।
আমি ছোটবেলা থেকেই মানুষের খাবার সময়টা পর্যবেক্ষণ করি। বাড়িতে, রেস্টুরেন্টে , ফুটপাতে, লঞ্চ, ট্রেন, বাস বা জমির আলে বসে মানুষকে খেতে দেখি। কত রকম খাবারই-না মানুষ খায়। ভাত-রুটি ছাড়াও আমি বাঙালিদের কত বিদেশি খাবার খেতে দেখি। দেশে-বিদেশে দুই জায়গাতেই দেখেছি বাঙালির পাতে ভাত থাকলে তার চোখেমুখে যে পরিতৃপ্তির হাসি, তার সঙ্গে বুঝি ফুল প্রস্ফুটিত হওয়ার হাসির তুলনাও খাটো হয়ে যায়। ছোটবেলায় গ্রামে দেখেছি, মাঠে যাওয়ার আগে কৃষিশ্রমিকরা সাঝিতে ভাত ভরে নিচ্ছে। ভাতের মাঝে মাটির হাঁড়িতে মাষকলাইয়ের ডাল ও অন্য তরকারি। ঠিক দুপুরে তাদের ভাত খাওয়ার আগেই আমি পৌঁছে যেতাম, তারপর মুগ্ধ চোখে তাদের ভাত খাওয়া দেখেছি।
পোশাকশ্রমিকরা কাজের মাঝে যে এক ঘণ্টার খাবার বিরতি পান, তখন অ্যাথেলেটিকসের চেয়ে দ্রুতবেগে তারা ঘরে ছুটে আসেন, চটজলদি সংসার সামলে ভাতটুকুও খেয়ে নেন, আহ কী অনবদ্য সেই খাবারের ছবিটি! কাজের জায়গাতে দলবেঁধে খাওয়ার দৃশ্যটির মতো অনবদ্য আড্ডা আর হতে পারে না। মৃত্যুর কিছুদিন আগে কবি শামসুর রাহমানকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলেন পুত্রবধূ টিয়া। কবির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ভাত খেতে পারেন ঠিকঠাক? সমস্যা হয় না? কবি বলেছিলেন, বাঙালির জন্য ভাতের চেয়ে আর অমৃত কী আছে? ঠিক একই কথা নিউইয়র্কের বাড়িতে সোফায় হেলান দেওয়া কবি শহীদ কাদরীকে যখন ভাত খাওয়াচ্ছিলেন নীরা ভাবি, তখন কবি বলছিলেন আমাদের, “এখানে ভাত খাই, কিন্তু দেশে ভাত রান্ধার পর যে সুবাস পেতাম, সেটা এখানে পাই না।”
ভাতের ওপর চাপ কমানোর চাপ বা তাড়া, নানা সময়ে জনগণের কাছে এসেছে, কিন্তু মাছেভাতে বাঙালি ভাতকে ছাড়তে পারেনি। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে স্বাস্থ্য, চিকিৎসাও বাজারি হয়ে গেছে। মেদ, ওজন কমানো, সরু থাকার জন্য কত রকম ব্যবস্থাপত্র বাজারে ছাড়া হয়েছে। বিকল্প কত খাবার মনোহারি দোকানে। সেগুলো চেটেপুটে শেষমেশ কিন্তু স্বাস্থ্য টেকাতে ফিরতে হয় ভাতের কাছেই। কিছু রোগবালাই তো আছেই। যেখানে যৌক্তিক কারণে ভাত পরিমিত ও নিষিদ্ধ হবেই। আমাদের গ্রামের কৃষক পরিবারগুলো পান্তা ভাত শাকভর্তা খেয়েই শরীরকে কেমন সুঠাম রেখেছে। জীবনের এই অভিজ্ঞতা থেকে ভাত থেকে সরে আসতে পারিনি অনেক বাজারি ষড়যন্ত্রের পরেও। ঠোঁটে-নাকে লাল বিরুইর ঘ্রাণ রেখেই খেয়ে যাচ্ছি মেশিনে সরু হয়ে আসা মিনিকেট। তবু পাতে ভাত দেখাতেই আনন্দ।
বাজারে চাল আবার চড়ে উঠেছে। দাম বাড়তি। সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। আমাদের কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, আমরা বেশি ভাত খাই। ৪০০ গ্রামের বদলে ২০০ গ্রাম খাওয়া উচিত। তাহলে চালের চাহিদা কমবে। তাঁর কথায় আমার গোসসা হয়নি। চাপে পড়ে আলটপ্পা কথা আমরা অনেকেই বলি। চালের দাম বাড়াতে একজন বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রোদ উঠলে চালের দাম কমবে। আরেকজন খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। চালের দাম বাড়লেও অস্বস্তিতে নেই মানুষ। মানুষের সচ্ছলতা আছে। তারা চাল কিনে খেতে পারছেন। আরেকজন বলেছেন, মানুষ এখন গরু-ছাগলকেও চাল খাওয়াচ্ছে, তাই চালের ওপর চাপ বাড়ছে।
এসব কথায় কান দিয়ে ভাত খাওয়া কমাইনি রাগ করে। তবে কৃষকের ক্ষোভ কাটে না। কারণ, পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়লেও, কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। বাজার সিন্ডিকেটের কারণে মাঠে ধান রেখেই তাকে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে চাতালমালিকদের কাছে। আমদানি শুল্ক কমানো, সরকারি ক্রয়মূল্য বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েও কৃষকের মুখে যেমন হাসি ফোটানো যায়নি, তেমনি ক্রেতার মুখেও আসেনি স্বস্তির হাসি। এই দুই হাসি নিশ্চিত করার জন্য যে বাজার অবকাঠামো বা ব্যবস্থাপনা তৈরির প্রয়োজন ছিল, তা স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আইন করে, ধমক দিয়ে বাজার শান্ত রাখা যাবে না। পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনের মধ্যে সহজ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। উৎপাদক ও ক্রেতাকে যত কাছে আনা যাবে, ততই বাজারের অস্থিরতা কমবে। ই-কমার্স তার একটি উপায় হতে পারে। কিছু ত্রুটি ও অজ্ঞানতাকে জয় করে, ই-কমার্সনির্ভর বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে চালের বাজারকেও নিয়ে যেতে হবে।
সুতরাং দায় না এড়িয়ে বাজার অবকাঠামো তৈরির দিকেও মনোযোগী হওয়া উচিত। মানুষ তার উপযোগ মেটাতে, কতটুকু খাবে, না খাবে, সেই অধিকারটুকু তার কাছেই থাক। সরকারকে আগে ভাবতে হবে সরু না হোক, মোটা চাল খাওয়ার সক্ষমতা যেন সব নাগরিক অর্জন করে। দুধেভাতে না হোক, শাকেভাতে যেন থাকতে পারি আমরা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক