তালেবানদের পুনরুত্থান কেন সতর্কতার


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২১, ০৮:৫৬ পিএম
তালেবানদের পুনরুত্থান কেন সতর্কতার

আফগানিস্তানে সশস্ত্র উগ্রবাদী গোষ্ঠী তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের বিষয়টি স্রেফ সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ইতোমধ্যেই তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বরাদারের নাম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শোনা যাচ্ছে, যিনি কাতারের দোহায় তালেবানের কূটনৈতিক দপ্তরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারীও।

আফগানিস্তানের ধর্মীয় উগ্রবাদীরা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, মার্কিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে তারা নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে দেশটির ক্ষমতা দখল করেছিল। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানি শাসন চলে ওখানে। এরপর ক্ষমতাচ্যুত হয় তারা। ক্ষমতায় আসা আফগান সরকারকে আমেরিকার পাপেট সরকার বলে অনেকে অভিহিত করলেও মূলত গত দুই দশকে আফগানিস্তানের নানা ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সেগুলোর বিকাশ লাভ করে। এরপর মার্কিনিরা কিছুদিন আগে আফগান ছাড়ার পর আশঙ্কা করা হচ্ছিল তালেবানরা তিন মাসের মধ্যে কাবুল দখল করবে, কিন্তু তার আগেই সেটা সম্পন্ন হলো।

আফগানিস্তানে মার্কিনিদের উপস্থিতি নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে। গত দুই দশকের আফগান সরকার নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে ঠিক, তবে তাদের চলে যাওয়ার পর পরই তালেবানরা কাবুল পুনর্দখল করার যে কাজ সম্পন্ন করল তাতে করে মার্কিনিদের উপস্থিতি কতখানি প্রাসঙ্গিক ছিল এ নিয়ে এখন নতুন করে আলোচনার জন্ম দেবে। বৈশ্বিক এই রাজনীতি, আমেরিকার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং অন্য পরাশক্তিদের ভূমিকা নিয়ে সে অন্য আলোচনা; বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে বিশ্লেষণ করবেন। এই নিবন্ধ বৈশ্বিক এই রাজনীতির নয়, আলোচনা তালেবানদের পুনরুত্থানে আমাদের সমাজমানসে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তন নিয়ে।

তালেবানরা যখন সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল তখন বাংলাদেশের কিছু কওমিপন্থী লোক এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বলে নানা মাধ্যমের খবর। বাংলাদেশে বর্তমানে যে জঙ্গি তৎপরতার উদ্ভব তার সঙ্গে তালেবানদের ক্ষমতা দখলের সম্পর্ক রয়েছে। হরকাতুল জিহাদ নামের যে জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করেছে তাদের জন্মও ওই সময়ে। এবং তারা তাদের উপস্থিতি ও সংগঠনের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াতে ইসলামির চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। হরকাতুল জিহাদ নামের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনসহ আরও যে সকল উগ্রবাদী গোষ্ঠীর উপস্থিতি দেশে সেগুলোর অনেকেই আফগানিস্তান তালেবানদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া। আফগানিস্তানে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছে তারা তালেবানদের সমর্থনে সেখানে গেছে। তালেবানরা ধর্মের নামে, খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে মানুষকে মগজ ধোলাই করে তাদের দলে ভিড়িয়েছে। বাংলাদেশের যারা আফগান ফেরত তারাও তালেবানদের মত দেশে শরিয়া আইন চায়, নারীদের অন্তঃপুরবাসিনী হিসেবে দেখতে চায়।

কারা দেশে শরিয়া আইন চায়? নিশ্চিতভাবেই কিছু ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী। কারা তালেবান, আল কায়েদা, আইএসদের সমর্থক? তারাও দেশের উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠী। বাংলাদেশের রাস্তায় প্রকাশ্য স্লোগানও দেওয়া হয়েছিল— ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। ভাবা যায়, স্বাধীন দেশে রক্তের সোপান ধরে আসা স্বাধীনতার মাধ্যমে অর্জিত আমাদের দেশ ও জাতীয়তার বিরুদ্ধে এমন স্লোগান! বাংলাদেশি বাঙালি হয়েও এই দেশের একদল লোক নিজেদেরকে ‘তালেবান’ বলে দাবি করে, এবং বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানোর স্বপ্ন দেখে। এটা একদিকে যেমন ধৃষ্টতা, অন্যদিকে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক স্লোগান। লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রকাশ্য রাজপথে, সভা-সমাবেশে এই স্লোগান দেওয়া সত্ত্বেও এদের বিরুদ্ধে কোনো সরকারই দৃষ্টান্তমূলক কোন শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।  

বাংলাদেশের তালেবান, আল কায়েদা, আইএস সমর্থকেরা এই দেশেও কথিত খেলাফত কায়েম করতে আগ্রহী, শরিয়া আইনের বাস্তবায়ন চায়। তারা সংগঠিত, চরম মাত্রার উগ্রবাদী। গত কয়েক বছর ধরে তারা নানাভাবে নানা জায়গায় নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পেরেছে। সরকারের কাছ থেকেও নানা প্রকার সাহায্য সহযোগিতাও পেয়ে আসছে। তালেবানদের সমর্থিত হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আবির্ভাব, প্রচার-প্রচারণা, ভূমিকা এবং তাদের প্রতি সরকারের অবস্থান আর জনসাধারণের একটা অংশের প্রকাশ্য-পরোক্ষ সমর্থন আমাদের উদ্বিগ্ন করে। এটা ঠিক যে হেফাজতসহ ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশের ক্ষমতায় নেই তবে নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে তাদের উপস্থিতি ও আদর্শের বিস্তার নিশ্চিতভাবেই আমাদের জন্যে আশার খবর নয়।

সম্প্রতি মামুনুল হক নামের এক উগ্রবাদী ধর্মীয় নেতার নৈতিক স্খলন প্রকাশ্য হওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনের কমিটি বিলুপ্তি এবং এরপর ফের কমিটি গঠনের পর সংগঠনটির প্রকাশ্য কর্মসূচি নেই রাজপথে। তবে এর কিছুদিন আগেও এই ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর নানা কর্মসূচি ও সেখানকার উপস্থিতি আমাদেরকে অবাক করেছিল। এই উপস্থিতির বাইরেও সমাজের প্রগতিশীল অংশ বলে পরিচিত জনগোষ্ঠী ও প্রগতিশীল নামধারী কিছু রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের পরোক্ষ সমর্থন যেভাবে ওই উগ্রবাদীদের দিকে ঝুঁকেছিল সেটা উদ্বেগের।
 
ফ্রান্সের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত কার্টুনের প্রতিবাদে বাংলাদেশে যে বিক্ষোভ ও জঙ্গিমিছিল হয়েছিল সেরকম কিছু পৃথিবীর আর কোনো দেশে হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠী যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল সেরকম প্রতিক্রিয়া অভাবনীয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বানচাল করতে ধর্মরক্ষার নামে উগ্রবাদী গোষ্ঠী যে শোডাউন ও কর্মসূচিগুলো পালন করেছিল সেটাও উল্লেখের মতো। এই কর্মসূচিগুলোসহ তাদের আরও যেসব দাবিদাওয়া সেগুলোও প্রগতির পথের অন্তরায়। ধর্মীয় এই উগ্রবাদী গোষ্ঠী সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যসূচিতেও হস্তক্ষেপ করেছে। তাদের কিছু দাবি মেনে নিতেও হয়েছেও সরকারকে। সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন থেকে জাস্টিসিয়া ভাস্কর্যকে সরিয়ে নিতে হয়েছে, খোদ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়েও সরকারকে ভাবতে হয়েছে। একটা সময়ে জাতির পিতা ভাস্কর্য সারাদেশে নির্মাণের যে আলোচনা ছিল সেটাও থেমে গেছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা হওয়ার কথা ছিল একাত্তরের চেতনার পথ ধরে বাহাত্তরের সংবিধানের আলোকে। কিন্তু পঁচাত্তরের দুঃখজনক ট্রাজেডির পর ধর্মাশ্রিত ও পাকিস্তানপন্থী সামরিক সরকারগুলোর হাত ধরে রাষ্ট্রধর্মের সন্নিবেশ হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার বদলে রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তন হয়েছে সংবিধানে। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক একাধিক সংশোধনী বাতিলের পক্ষ মতো দিলেও বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরেনি, রাষ্ট্রধর্মের ধারণারও পরিবর্তন হয়নি। বলা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তন আনার সাহস করতে পারেনি। এটা সম্ভব হয়নি, কিংবা বলা যায় করার সাহস করেনি সরকার মূলত এই ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর কারণেই। সরকার দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাহাত্তরের সংবিধানের পুনর্প্রবর্তনে যায়নি মূলত তাদের কারণেই।

প্রগতির পথের অন্তরায় হয়ে থাকে এই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন যখন দেশে হচ্ছে না এবং দেশে প্রকাশ্যে যেখানে ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগান দেওয়া হয় তখন আফগানিস্তানে এই পরিবর্তন আমাদের জন্যে এলার্মিং নিঃসন্দেহে। হ্যাঁ, অনেকেই বলতে শুরু করেছেন— ‘আফগানিস্তানে সরকারব্যবস্থা কীভাবে চলবে, তারা গণতন্ত্র নাকি শরিয়া আইনে চলবে সেটা তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয় এই যখন আমাদের পররাষ্ট্রনীতি তখন আফগানিস্তানের বিষয়টি নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে।’ আফগানিস্তানের সরকারব্যবস্থা তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তে হবে এটা সাধারণ অর্থে যৌক্তিক হয়ত, কিন্তু আমাদের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী যখন উগ্রবাদী ধর্মীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থানে এই দেশেও শরিয়া আইন বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখে, বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায় তখন এমন সাধারণীকরণে আমাদের যাওয়া উচিত হবে না। আমাদের সতর্কতার দরকার আছে।

সশস্ত্র তালেবান গোষ্ঠী কর্তৃক কাবুল দখলের ঠিক একদিন আগে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী জানিয়েছে বাংলাদেশের বেশ কজন তালেবানদের হয়ে যুদ্ধ করতে আফগানিস্তান চলে গেছে। এরইমধ্যে একজনের নাম জানিয়েছে পুলিশ। আব্দুর রাজ্জাক খান নামের ওই কিশোর সিলেটের একটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথা বলে সে বাড়ি ছেড়েছিল। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজ্জাকের বন্ধুদেরও খোঁজ নেই। এরইমধ্যে খবর এসেছে একই এলাকার বেশ কজন মাদ্রাসা ছাত্রও নিখোঁজ। এগুলো গণমাধ্যমে আসা খবর। এরবাইরে এমন আরও ঘটনা থাকতে পারে।

তালেবানদের প্রতি বিশেষত একই ধারার উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রতি শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বিশাল মানুষের সমর্থন রয়েছে এই দেশে। এই সমর্থনের কিছুটা প্রকাশ্য, আর অনেকটা গোপনীয়। এগুলো আমাদের জন্যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। আর তালেবানরা যখন আফগানিস্তানের ক্ষমতা পুনর্দখল করল তখন আরও বেশি ভয়ঙ্কর ও সতর্কতার। প্রতিক্রিয়াশীল অংশ খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আর কথিত প্রগতিশীল অংশ আফগানিস্তানে আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট সরকারের পতনের নামে যে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে তাদের সকলকে নজরদারির মধ্যে রাখা দরকার।

তালেবানদের পুনরুত্থান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয় তাই আমাদের জন্যে। বাংলাদেশিদের মধ্যে থাকা তালেবানি মতাদর্শের মানুষের অভাব নেই। প্রগতিকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিক্রিয়াশীলদের স্বপ্নে কঠিন বাঁধ সাধতেই হবে! 

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

Link copied!