বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ইতিমধ্যে প্রাণ গেছে প্রায় অর্ধশত যাত্রীর। হাসপাতালে ভর্তি আছে শতাধিক দগ্ধ মানুষ। আরও অনেকে আছেন যাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে খুবই বেদনাদায়ক কিন্তু আকস্মিক নয়।
বেঁচে-ফেরা যাত্রীদের সাথে কথা বলে একটা পত্রিকা জানিয়েছে, ঢাকার সদরঘাট থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় এমভি অভিযান-১০ নামে লঞ্চটি যখন বরগুনার উদ্দেশে যাত্রা করে, তখন থেকেই এর গতি ছিল বেপরোয়া। ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকায় চারজন টেকনিশিয়ান ত্রুটি মেরামতে কাজ করছিলেন। এজন্য পুরো গতিতে দুটি ইঞ্জিন চালিয়ে ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছিল। আর এতেই মূলত ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন ধরে যায়। আগুন লেগে যাওয়ার পর নেভানোর কোনো চেষ্টা না করে লঞ্চটির ‘শ্রমিক-কর্মচারী ও মালিক’ লঞ্চ থেকে সটকে পড়েন।
প্রত্যক্ষদর্শী বরগুনার আরেক যাত্রী জাহিদুল ইসলাম বলেন, রাত পৌনে একটায় বরিশাল নৌবন্দর ত্যাগ করার পর লঞ্চটির পুরো ডেক উত্তপ্ত হয়ে যায়। শীত থাকায় চারপাশ ত্রিপল দিয়ে আটকানো ছিল। রাত আড়াইটার দিকে লঞ্চটি ঝালকাঠি স্টেশন থেকে দেউরী এলাকায় আসতেই আগুন লাগে। কিছু দূরে এলে ইঞ্জিনকক্ষে আগুন ধরে যায়। এরপর আগুন পুরো লঞ্চের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। লঞ্চের ২০ ব্যারেল ডিজেল, নিচতলায় দুটি মোটরসাইকেল এবং রান্নার জন্য রাখা কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। একই সঙ্গে ভিআইপি কেবিনের এসির কম্প্রেসারগুলোও একে একে বিস্ফোরিত হয়।
ইঞ্জিন রুমের পাশে ক্যান্টিন থাকার বিষয়টি লঞ্চটির একজন কেবিন বয়ও বলেছেন। তিনি বলেছেন, ইঞ্জিন রুমের পাশের ক্যানটিনে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুন লাগে। পরে তা ইঞ্জিন রুমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে আবার প্রচুর ডিজেল ছিল।
আরেকটা পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ইঞ্জিনের তাপে লঞ্চের ফ্লোর গরম হতে থাকলে যাত্রীরা বারবার লঞ্চ চালক ও কর্মচারীদেরকে তা অবহিত করেন। কিন্তু লঞ্চ চালক ও কর্মচারীরা এ কথাকে পাত্তা না দিয়ে যাত্রীদেও আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তারপর প্রায় দুই ঘণ্টা তারা লঞ্চটিকে চালিয়ে নিয়ে যান, যে-সময়টা যথেষ্ট ছিল প্রতিটা যাত্রীকে নিরাপদ স্থানে নামিয়ে দেওয়ার জন্য।
এখন এই যে ইঞ্জিনের পাশে ক্যান্টিন স্থাপন, ৭০০ যাত্রীকে অনবোর্ড রেখে লঞ্চের ইঞ্জিনের ত্রুটি সারানোর চেষ্টা, ত্রুটি সারাতে গিয়ে আগুন লাগার পর, তা না নিভিয়ে লঞ্চের লোকদের সটকে পড়া এবং যাত্রীরা বারবার বলার পরও লঞ্চটিকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে না যাওয়া, এর একটিই কি যথেষ্ট না এ ভয়ংকর অগ্ন্কিাণ্ড ঘটানোর জন্য? বিষযটি যদিও তদন্তাধীন, প্রাথমিক সাক্ষ্য-প্রমাণে এটাই স্পষ্ট যে, লঞ্চের মালিক এবং লঞ্চটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের যেন পরিবহন ব্যবসার মূল শর্ত। যাত্রীনিরাপত্তার প্রতি চরম উদাসীনতা ও অবহেলাই এতগুলো মানুষকে ওই অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছে।
দুর্ঘটনার পর নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, লঞ্চটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক বলেছেন, ‘আমরা রাত সাড়ে তিনটার দিকে লঞ্চে গিয়ে আগুন নেভাই। এ সময় কর্তৃপক্ষের কাউকেই পাইনি। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, ইঞ্জিনরুমে আগুন ধরে গিয়েছিল। লঞ্চে আমরা অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থার কিছুই পাইনি।’ এসব ত্রুটি নিয়ে একটা লঞ্চ চলাচল করে কীভাবে? আমাদের জানামতে ঢাকার সদরঘাট তো বটেই অন্য নৌবন্দরগুলোতেও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) প্রতিনিধি থাকে নৌযানগুলো তাদের দেওয়া গাইডলাইন মেনে বন্দর ছেড়ে যাচ্ছে কি না তা দেখার জন্য। বৃহস্পতিবার ঢাকার সদরঘাটে নিশ্চয় এরকম কেউ ছিলেন। তার চোখের সামনে ইঞ্জিনে ত্রুটি নিয়ে, অগ্নিনির্বাপনের কোনো ব্যবস্থা ছাড়া এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি ৭০০ যাত্রী নিয়ে সদরঘাট ছাড়ল কিভাবে? তাই বিআইডব্লিউটি-এর অগ্নিকাণ্ড ও মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না।
এর আগে যখনই কোনো লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে তখনই সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে একধিক তদন্ত কমিটি গঠনের উদ্যোগ আমরা দেখেছি। সেগুলোর কোনোটা তদন্ত প্রতিবেদেন জমা দিয়েছে, কোনোটা দেয়নি। কিন্তু যেসব তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে তাদের সবাই দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চের ত্রুটিপূর্ণ নক্সা, লঞ্চ চালকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ঘাটতি এবং যাত্রীনিরাপত্তার প্রতি লঞ্চ মালিকদের চরম উদাসীনতার বিষয়কে দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী করেছেন। এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটিও দেখা যাচ্ছে প্রায় একই দোষে দুষ্ট ছিল। এতে বোঝা যায়, ইতিপূর্বে লঞ্চ দুর্ঘটনায় এত এত প্রাণহানির পরও পরিস্থিতির খুব একটা ইতরবিশেষ ঘটেনি।
এ কারণে, অনেকটা হতাশা থেকেই, বৃহস্পতিবারের এমভি অভিযান ট্রাজেডির পরও অনেকে বলছেন, এবার যে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে সেগুলোর প্রতিবেদন নিয়ে কিছুদিন মিডিয়ায় আলোচনা হবে। এরপর সবাই তা ভুলে যাবে। হয়তো আরেকটা এমন ধরনের ট্রাজেডির পর এবারের তদন্ত প্রতিবেদনগুলোর খোঁজ পড়বে।
অনেকে হয়তো দেশে দেশে ইতিপূর্বে সংঘটিত প্রাণঘাতি ফেরি দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে বলবেন, বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এটা তো মানতে হবে যে, অনেক সতর্কতার পরও যখন কোনো লঞ্চডুবি বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে তখন তাকে দুর্ঘটনা বলা যায়। আর যেসব দেশে আইনের শাসন খুব দৃঢ় সেখানে অনেক সতর্কতার মধ্যেও এমন দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায় এবং তা কালেভদ্রে ঘটে।
কিন্তু আমাদের এখানে, বিশেষ করে যাত্রীনিরাপত্তার প্রশ্নে বেশিরভাগ নৌ ও সড়ক পরিবহনের মালিকদের মধ্যে তেমন কোনো উদ্যোগই দেখা যায় না। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোও যে খুব একটা সচেতন তেমনটা বলা যায় না। ‘টাকা দিলে এখানে বাঘের চোখও মিলে’- এ প্রবাদটা তো এখানেই চালু আছে, তাই না। খোদ সড়কপরিবহনমন্ত্রী একাধিকবার প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, সচল মোটযানগুলোর চালকদের অন্তত অর্ধেকের না আছে বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স না আছে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। নৌপরিবহন খাতের অবস্থাও একইরকম অথবা আরও খারাপ। না হলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী নিজেই বলতেন না যে, এমভি অভিযান-১০-এর ইঞ্জিনে ‘ত্রুটি’ ছিল। এবং এই ত্রুটি নিয়েই লঞ্চটি কোনো বাধা ছাড়া যাত্রী পরিহন করল।
এখানে জনসংখ্যা বেশি, যাত্রীরা অসচেতন এবং সবক্ষেত্রে দুর্নীতির দাপট চলছে। এজন্য কোনো ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা বা পেশাদারিত্ব গড়ে উঠছে না। এই সবই সত্য কথা। কিন্তু এগুলো বলে সব ধরনের পরিবহনে যাত্রীদের নিরাপত্তাঘাটতি ও অধিকারহীনতার বিষয়টি সম্পর্কে উদাসীন থাকার সুযোগ নেই। এখানে যার যা দায়িত্ব তা পালনে তাকে বাধ্য করতে হবে এবং এটি সরকারকেই করতে হবে। নাগরিকদেরও এজন্য সোচ্চার হতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট