বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ—ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সমান্তরাল। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হবে না। অন্যদিকে তিনি বাঙালির আত্মদর্শনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিভাস। এমন নিগূঢ় চেতনায় বাঙালির মৌল অনুভব অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতার মধ্যে পাওয়া যায়নি। সামগ্রিক সত্যে তিনি আমাদের শিকড়ের মানুষ।
বঙ্গবন্ধু কখনো ক্ষমতা বা দম্ভের জায়গা থেকে রাজনীতি করেননি। তাঁর রাজনীতির পুরোটাই ছিল মানবকল্যাণে নিবেদিত। তিনি রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। তিনি সেই রাজনীতি করতেন, যেখানে মানুষ মানুষের কথা ভাববে, সবার অধিকার নিশ্চিত করবে, দেশকে নিয়ে ভাবাবে। যেমন : ৬ দফার দাবি ছিল দেশের মানুষের অধিকারের দাবি। ৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর ’৬৭ সালে বঙ্গবন্ধু দেশের নানা প্রান্তে গিয়ে মানুষকে জাগিয়েছেন। অনেক জায়গায় তিনি তাঁর সঙ্গে শিল্পীদের নিয়ে গেছেন। সেখানে মিটিং শুরুতেই পরিবেশিত হতো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এর মানে তিনি মানুষকে আগেই দেশপ্রেমের আবেগে উজ্জীবিত করতেন।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শারীরিক মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু আদর্শ ও দর্শনের প্রেক্ষাপটে তিনি আমাদের সামনে মৃত্যুঞ্জয় মুজিব। ইতিহাসের অমর মানুষ হয়ে থাকবেন হাজার বছরের বাঙালির জীবনে। পাশাপাশি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আমাদের সামনে এক অসাধারণ মানবচেতনার পঙ্খিরাজ। আগস্ট মাসে জন্ম এবং মৃত্যুকে ধারণ করে তিনি এক অসাধারণ মানবী। রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা।
চোখের জলের সেদিনের কথা ভুলবার নয়। তারিখটা ছিল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল। আমরা থাকতাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পেছনের দিকে কলেজ স্ট্রিট নামের গলিতে, একটি ভাড়াবাড়িতে। আমি আর আনোয়ার বাংলা একাডেমিতে চাকরি করি। আমার দুই মেয়ে মুনা ও লারা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়ে। আমার মায়ের মৃত্যুর পরে আমার আব্বা সেই সময়ে আমাদের কাছে ছিলেন। আমার বড় ভাই পেশোয়ারের ওয়ারস বন্দিশিবির থেকে ফিরে সেই সময়ে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। পাঁচজন শিশুসহ বাড়িতে আমরা দশ-বারোজন ছিলাম।
বেশ ভোরে ওঠা আমার অভ্যাস। মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতিরও তাড়া থাকত। প্রতিদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমি রেডিওর খবর শুনতাম। ১৫ আগস্ট রেডিও ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পাই মেজর ডালিমের সদম্ভ কণ্ঠস্বর, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হইয়াছে।’
আমি তাৎক্ষণিকভাবে হকচকিয়ে গিয়ে পরক্ষণে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করি। আব্বা আব্বা বলে ডাকতে থাকি। আব্বা নিজের ঘরে নামাজ পড়ছিলেন। জায়নামাজ ছেড়ে উঠে আসেন। জিজ্ঞেস করেন, কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে? বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হয়েছে। অ্যাঁ, শব্দ করে আমার আব্বা ঘরের একটি চেয়ারে বসে পড়েন। দুহাতে মাথা চেপে ধরে রেডিও থেকে ভেসে আসা যাবতীয় কথা শোনেন।
দশটা-এগারোটার দিকে আমি আর আনোয়ার গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার ধারে যাই। রাস্তায় আর্মির গাড়ি ছাড়া অন্য যানবাহন নাই। নিউমার্কেটের দিক থেকে একটি খোলা জিপ আমাদের সামনে এসে থামে। দেখতে পাই কালো পোশাকধারী পাঁচ-ছয়জন বসে আছে। হাতে রাইফেল। আমাদের ধমকের স্বরে বললেন, রাস্তায় এসেছেন কেন? যান, বাড়ি যান।
শহরে কী হচ্ছে তা বোঝার জন্য আমরা বের হয়েছিলাম। বুকভরা আতঙ্ক আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমরা ফিরে আসি। তারপর কত দিন আর রাত চলে গেছে। সময়ের হিসাব ফুরিয়েছে। কিন্তু ফুরোয়নি বুকের ভেতরের সেই ভোরের আর্তনাদ। অনেক ভেবেছি, আমার হাতে কীভাবে রূপায়িত হবে সে রাতের ঘটনা! কিন্তু না, কিছুই করতে পারিনি। করা সম্ভবও ছিল না। তারপরও অপেক্ষা করেছি নিজেকে তৈরি করার জন্য। একসময় মন স্থির করি যে, একটা কিছু লিখতেই হবে। পনেরোই আগস্টের রাতকে পটভূমি করে উপন্যাস লেখার স্বপ্ন আমার ভেতরে ঘুণপোকার মতো কাটে। একসময় লিখতে শুরু করি ‘আগস্টের একরাত’ উপন্যাসটি।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শারীরিক মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু দর্শন এবং আদর্শে তিনি বাঙালির জীবন স্পৃহা। বাংলা ও বাঙালির সবটুকু ধারণ করে তিনি বেঁচে আছেন অমলিন সত্যের ধারাবাহিকতায়। বাংলার মাটি তাঁর জীবনদর্শনের রূপরেখা।
লেখক : সম্পাদক, সংবাদ প্রকাশ