“এরা চাহে না তোমারে চাহে না যে, আপন মায়েরে নাহি জানে।
এরা তোমায় কিছু দেবে না, দেবে না— মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভাণে।।”
রামনারায়ণ যদুনাথ মজুমদারের যে নড়াইল, উদয় শঙ্করের যে নড়াইল, ডা. নীহার রঞ্জন গুপ্তের যে নড়াইল, কবিয়াল বিজয় সরকারের যে নড়াইল, কমরেড অমল সেনের যে নড়াইল, লাল বাউল এস এম সুলতানের শিশু-স্বর্গ যে নড়াইল, কবিগানের বরপুত্র তারক গোঁসাইয়ের যে নড়াইল, অষ্টক গানের যে নড়াইল, জারি গানের মোসলেম বয়াতির যে নড়াইল, আগরতলা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফট্যানেন্ট মতিউর রহমানের যে নড়াইল, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের যে নড়াইল, আমাদের ক্যাপ্টেন ম্যাশের যে নড়াইল—তার সঙ্গে আজকের নড়াইলের কোনো মিল নেই। শত বছরের সাংস্কৃতিক আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য-ইতিহাস মুছে প্রথমবারের মতো আজকের নড়াইল অচেনা এক জনপদ। কারা মুছল এই শত বছরের সাংস্কৃতিক আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য? কারা এই সুযোগ তৈরিতে সহায়তা করল? স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের নড়াইলের এ অর্জন; গর্ব করার মতোই বিষয় বটে! শিকড় উপড়ে বাঁচার সাহস মহীবৃক্ষেরাও দেখাতে পারে না। আমরা দেখাচ্ছি। এ তো কম কথা নয়! স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা নড়াইলবাসী না-ই বা পেলাম কোনো মন্ত্রী, আমাদের অঞ্চলে না-ই বা হলো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, বিদেশবিভুঁইয়ে ম্যাশ (এখন যার ভুলিয়ে রাখা বাংলা নামটি ‘কৌশিক’)-এর মতো না-ই বা ওড়াল আমাদের আর কেউ দেশের বিজয় পতাকা। কী আসে যায় তাতে? কিচ্ছুটি না। তেমনিভাবে শত বছরের ঐতিহ্য; সাংস্কৃতিক আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসও কাজে লাগবে না কোনো। ওসব কি আর কর্ম করে স্বর্গে যাওয়ার পথে আলো বিলাবে? না তো! সে জন্য কিছু কর্ম তো করা লাগে এবং সে জন্য সেই মাপের বুকের পাটাও লাগে। আমরা যা পেরে ফেলেছি, তুলনা তার নেই। পৃথিবীর ইতিহাস সাপেক্ষে বলুন তো কটা বাপের ব্যাটার এমন বুকের পাটা আছে; যে নিজেও একজন শিক্ষক(?) হয়ে প্রশাসনের (পুলিশ) উপস্থিতিতে অন্য একজন শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানোর নেতৃত্ব দিতে পারে? অমন বুকের পাটাওয়ালা মানুষ(?) হতে গেলে, তার সপক্ষের প্রশাসনের বড় কর্মকর্তা হতে গেলে, তার সপক্ষের রাজনৈতিক আদর্শের খুঁটি হতে গেলে নিশ্চিতভাবেই তাদের বানান করে করে লেখাপড়া শিখে তারপর পরীক্ষায় পাস করা লাগে। এক দিনেই তৈরি হয় না অমন মনন। দীর্ঘদিন ধরে নিবিড় পরিচর্যা লাগে। অপ-নীতি-আদর্শের, অপ-রাজনীতির, অপ-সংস্কৃতির, অপ-অর্থনীতির, অপ(লোকদেখানো)-ধর্মের নিয়ত চর্চা সে নিবিড় পরিচর্যায় মুনশিয়ানা দেখায়। তবেই না একজন মায়ের গলায় দড়ি দিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে হবে অমন একটা সুবোধ সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য!
অপমানিত সে শিক্ষক যে ধর্মেরই অনুসারী হন না কেন; তিনি শিক্ষক। কোনো জাতি, কোনো দেশ ধর্মের বাটখারায় শিক্ষকের মান-মর্যাদা পরিমাপ করে বলে শুনিনি তো! ঘটতেই থাকা এমন অঘটনকে কত দিন ধরে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে? দেশজুড়ে শিক্ষক অপমানের এমন সব ঘটনায় দেশের শিক্ষামন্ত্রী বা সরকারের ক্ষমতার অনুভূতিতে কতটুকু আঘাত লাগে জানি না, তবে ধর্মনির্বিশেষে সত্যিকারের শিক্ষকদের মর্যাদার অনুভূতিতে আঘাত লাগে বৈকি! তাঁদের সন্তানদের মাতৃ-পিতৃ পরিচয়ের গর্বের অনুভূতিতেও আঘাত লাগে। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধও হোঁচট খায় না কি?
যদিও আজকাল এই সব মামুলি অনুভূতির সংবেদনশীলতা, মূল্য বা কদর কোনোটাই নেই। আজকাল সবচেয়ে দামি আর সংবেদনশীল অনুভূতির নাম “ধর্মীয় অনুভূতি”। কেন? বুঝি না, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা মানুষের কাছে এই দৈব বাণী পৌঁছে দিয়েছেন যে সৃষ্টির আদিকালে সৃষ্ট “ধর্মীয় অনুভূতি” নামক একপ্রকার অতি সংবেদনশীল অনুভূতি বিশেষ কিছু মানুষদের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে এবং অনুভূতিটির আধা অংশ “মানুষ” নামক কিছু প্রাণীকে এখন থেকে চরমভাবে প্রভাবিত করবে। তারা একে অপরের এই অনুভূতিতে অতি সহজেই আঘাত দিতে এবং আঘাত পেতে সক্ষম হবে মাত্র, কিন্তু এই অনুভূতি সৃষ্টিকর্তার কোনো সৃষ্টিকে ভালোবাসায় বা পৃথিবীর কোনো মঙ্গলার্থে ব্যবহার করতে পারবে না। এবং যিনি বা যারা ওই অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত হবেন; তিনি সৃষ্টিকর্তারই সৃষ্ট অন্য ধর্মের মানুষকে নির্যাতন না করলে আঘাতপ্রাপ্তদের জন্য স্বর্গ-দ্বার চিরতরে বন্ধ হয়ে থাকবে, নির্যাতন করার মাত্রা যত বেশি, স্বর্গে একখানা প্রশস্ত জমি তত যেন নিশ্চিত। নড়াইলের লোহাগড়ার দিঘলিয়ায় আমরা যে দাঙ্গা সংঘটিত করলাম, তা কি এই স্বর্গের জমির বায়না নিশ্চিত করতে, নাকি ধর্মীয় সংখ্যাল্প মানুষকে ভিটে ছাড়া করে বিনা মূল্যে তার পৃথিবীর জমি দখল করে নেওয়ার ফন্দিবাজি? কী অদ্ভুত আঁধার! কী আলোকিত অন্ধকার!
মানুষ পালন করে—এমন প্রায় ৪৩০০ ধর্ম পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত নাকি টিকে আছে। প্রতিটি ধর্মেই একজন করে সৃষ্টিকর্তা আছেন। প্রতিটি ধর্মেই আরও আছে স্বর্গ এবং নরকের ধারণা। নড়াইলেরই কবিয়াল বিজয় সরকারের মনে প্রশ্ন জাগে—জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটা কী?/“ওই ৪৩০০ ধর্মের সৃষ্টিকর্তারা একে অপরের সঙ্গে ধর্মীয়ই শুধু নয়; কোনো অনুষঙ্গেই দাঙ্গা করেছেন—এমন ইতিহাস আছে? নেই। কিন্তু আমরা তা করে ইতিহাস তৈরি করলাম। যারা এই ইতিহাস তৈরি করলেন বা করালেন বা ঘটনা ঘটার সময় নিশ্চুপ থাকলেন, তারা কি এই কমপক্ষে ৪৩০০ ধর্মের মতানুসারে ৪৩০০ জন সৃষ্টিকর্তা আছেন বলে বিশ্বাস করেন? না, করেন না। সৃষ্টিকর্তা একজন বলেই মানেন। সকলে একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি যদি মানি, আমরা কাদের ঘরে আগুন দিলাম? কাদের গোয়ালের গরু নিজের মনে করে খুলে নিয়ে গেলাম? কাদের সম্পদ লুট করলাম? কাদের মনে আমাদের প্রতি চিরস্থায়ী ঘৃণার উদ্রেক করলাম? নিজ ধর্মের অপমান হলো না? ধর্মকে রক্ষা করবার, ধর্মের মান-সম্মান বৃদ্ধি করবার গুরুদায়িত্ব কবে সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দিয়েছেন, শুনি? এখন পর্যন্ত টিকে থাকা প্রায় ৪৩০০ ধর্মের ধর্ম-আদর্শ, ধর্ম-বিশ্বাস কি এত ঠুনকো যে টোকা দিলেই ভেঙে পড়ে? পড়ে না তো! তাহলে ধর্মীয় অনুভূতি এত সহজেই আঘাতপ্রাপ্ত হয় কী করে? তার প্রতিক্রিয়াই-বা এক অমানবিক কেন? এই সব প্রশ্ন মনকে ভাবায়। পৃথিবীজুড়ে ধর্মের নামে যত হানাহানি, তা সবই নিছক জাতের নামে বজ্জাতি, ভোগ-দখলের ধান্দাবাজি। কাজী নজরুল ইসলাম সে জন্যই বুঝি লিখেছিলেন—…ক্ষমা করো হযরত। /ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ, তোমার দেখানো পথ।/মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা/ সার করিয়াছি ধর্মান্ধতা, “কিসের মোহ আমাদের? ধর্মের? স্বর্গের? নাকি ইহজাগতিক সম্পদের? ধর্মীয় সংখ্যাল্প মানুষদের ভিটে ছাড়া করে সহজেই তাদের জমিজমা-সম্পদ ভোগ-দখলের সুযোগ না হয় পেয়েই গেল “তথাকথিত” ধর্মীয় সংখ্যাগুরু। তারপর কী“সব আমরা-আমরা” সুখ? এই ‘আমরা-আমরা’ কত শত ভাগে বিভক্ত-সে হিসেব যদি সামনে আসে, তখন কারা, কার অনুসারীরা সঠিক, সহি, কাদের ক্ষমতা, জোশ কত বেশি, তা নিয়ে মারা আর মরার খেলার তামাশা যে শুরু হবে না; আমরা নিশ্চিত তো? ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর বেলায় “তথাকথিত” শব্দটি সে জন্যই বলা। কারণ, ধর্মীয় সংখ্যাল্প হয়ে যাওয়া তখন এক নিমেষের ব্যাপার মাত্র। আমরা-আমরা-র মোহেই তো ৪৭-এর দেশভাগ। এবং পরে ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য লক্ষ লক্ষ প্রাণ বিলিয়ে সে মোহের প্রায়শ্চিত্ত! রবি ঠাকুরের সেই বাণী—
“ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে / অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।—
বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে,/ নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে।”
এই কপালপোড়া মোহ তার মায়াজাল বিছানোর অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছে একটা গোটা জাতির ভাষা, পোশাক, খাদ্য থেকে শুরু করে তাদের জীবনাচরণের প্রতিটি উপাদানকে দীর্ঘকাল ধরে ‘ধর্মীয়করণের’ নীরব কর্মযজ্ঞ নির্বিঘ্নে চলতে পেরেছে বলে। কেন? এর একটা কারণ হতে পারে আরেকটি মোহ, যার নাম ক্ষমতা। এই মোহে মোহগ্রস্ত ব্যক্তি, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ক্ষমতা পেতে, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে লোভী আর শিকারি বিড়ালের মতো সারাক্ষণ বাতাস শুঁকে শুঁকে বেড়ায় সাধারণ মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখার মোহ খুঁজতে। ধর্মের বেশে যে মোহ, তা দিয়ে সাধারণ মানুষকে অতি সহজেই মোহাচ্ছন্ন, অন্ধ করে রাখা যায়। অন্ধ এ মোহের মায়াজাল স্বর্গে যাওয়ার টিকিট নিশ্চিত করতে পারে পর্যন্ত। তাতে রাষ্ট্রের ইহজাগতিক দায়িত্ব-কর্তব্যকে ভুলিয়ে রেখে ক্ষমতা পেতে এবং ক্ষমতা আপাত টিকিয়ে রাখতে সুবিধা। সুবিধা নীতিহীন ব্যবসায় চট করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হতেও। দুর্দান্ত উর্বর এ ধর্ম, শস্যক্ষেত্র তাই যুদ্ধ বা দাঙ্গামুখর, ধর্মব্যবসামুখর তথা ধর্মীয় রাজনীতিমুখর। অথচ বিদ্যাবিমুখ, জ্ঞানবিমুখ, বিজ্ঞানবিমুখ, বাংলাবিমুখ। এখানে বিদ্যায় ভয়, জ্ঞানে ভয়, বিজ্ঞানে আরও ভয়। আর সবচেয়ে বেশি ভয় জাতির শিকড়, জাতির আদর্শ-বাংলা ভাষা আর বাঙালি সংস্কৃতিতে। এ সমাজ, এ সমাজের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এখন তাই বিদ্যা বা জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীন-রাশিয়ায় না গিয়ে বরং ধারের কাছের চেনা-পরিচিত ধর্মীয় তীর্থস্থানে যাওয়াকেই শ্রেয়তর মনে করে। তাতে ধর্মান্ধের রাজনীতির চর্চা বাড়বাড়ন্ত হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দেয়; বিনা পুঁজির ট্যাক্স-ফ্রি ধর্মব্যবসা আর অবৈধ পুঁজির নীতিবিবর্জিত রকমারি ব্যবসার রমরমা ভাবটি অনায়াসে তৈরি হতে পারে। যেখানে মুক্ত বুদ্ধি আর বুদ্ধির মুক্তিকে ঠেকিয়ে রেখে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে অধিক মুনাফা লাভের বড্ড বেশি সুবিধা হয়।
আজকের ‘বাংলাদেশ’ নামক ভূখণ্ডের জন্ম সেই সব অন্ধ মোহ থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত হতে, স্বাধীন হতে। সে জন্যই তো ৭১ মুক্তির সংগ্রাম, ৭১ স্বাধীনতার সংগ্রাম! ৪৭-এ ব্রিটিশ কুবুদ্ধির দ্বিজাতিতত্ত্বে দেশভাগের পর থেকেই ‘আমরা-আমরা’ নামক অলীক সুখের মোহভঙ্গ শুরু হয়। মুক্তির মিছিলে শামিল হতে থাকি আমরা। চরম আঘাতটি আসে ৫২-তে, মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চায় দেশতুতো ভাই। জানা হয়ে যায় যে বিশেষ কোনো সম্প্রদায় নয়, বাঙালি-এই পরিচয়ই আমাদের বাঁচার একমাত্র পথ, না হলে মরণ। তাই ভাষা-সংস্কৃতি বাঁচানোর লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল সকলে, জাতিগতভাবে বাঙালিত্বের পরিচয় দিয়েছিল এ তল্লাটের সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষ। ৫২-এর পথ বেয়েই ৭১-এর জনযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাওয়া, ৬০-এর দশকে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা, ৭১-এ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড, গণহত্যা-এ সবই এক সুতোয় গাঁথা। শুধু জমি দখলের নয়, একটি জাতির মস্তিষ্ককে মোহাচ্ছন্ন করে রেখে সে জাতিকে দাসে পরিণত করার বিরাট এক ষড়যন্ত্র সেটি। ইতিহাসের পথ বেয়ে সে জন্যেই বাংলা ভাষার জন্য জীবন দান, ৩০ লাখ মানুষের দেশের স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য জীবন দান। অবশেষে বিজয়, স্বাধীনতা, মুক্তি।
এই বাংলাদেশ তাই নিশ্চিতভাবেই খুব চড়া দাম দিয়ে কেনা। ‘দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি, জানা আছে জগৎময়।‘ দাম দিয়েই ‘জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’৭২-এর সংবিধানের এই চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি।
জাতিকে দাসে পরিণত করার ষড়যন্ত্র তবু থামে না। দেশের বুকে এক কালো ইতিহাস তৈরি হয় ৭৫-এর ১৫ আগস্ট। যাঁর তর্জনী ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ বলেছিল, যাঁর স্বপ্নে সোনার বাংলায় নব সূর্যোদয় হলো, যাঁর ডাকে জনযুদ্ধে অংশ নিতে জনগণ তিলমাত্র দ্বিধা করেনি, সেই মানুষটিকে, মহান নেতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা হলো। আবার দাসত্ব, আবার অমানিশা।
সেই অমানিশাও কাটিয়ে আজকের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। এখানে তো এখন দাম দিয়ে অর্জিত ‘জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’- ৭২-এর সংবিধানের এই চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিই প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা। কিন্তু তা পায়নি। কারণ, আপসের চাষ বেড়েছে, মূল্যবোধের চুরি ঠেকানো যায়নি বা চুরি হওয়ার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। আমরাই করেছি এসব। এই দায় আমরা কেউই এড়াতে পারি না। আমরা বাম-ডান, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ নির্বিশেষে স্রেফ লোভে পড়ে ব্যক্তিস্বার্থে জনপদ থেকে জনপদে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে অমৃত বিলানোর বদলে বিষ ছড়িয়েছি, ছড়াবার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছি, যার ফল আজকের নড়াইল। এবং বলতে দ্বিধা নেই যে বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদ নড়াইলের মতোই আত্মপরিচয় ভুলে যেতে বসেছে। আমরা আমাদের জাতিসত্তা বাঁচানোর যুদ্ধে হারছি, হেরেই যাচ্ছি, তা আমাদের কারণেই।
এখনো ঘুরে দাঁড়াবার সময় আছে, চাইলেই দাঁড়ানো যায়। বাঙালি তা বারবার প্রমাণ করেছে। সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়তে এখনই ঘুরে দাঁড়াবার কোনো বিকল্প নেই। নড়াইলকে পুণ্যভূমি জানি। আত্মপরিচয় স্বীকার করে ঘুরে দাঁড়াবার জন্য নড়াইলের চেয়ে ভালো মাটি আর আছে বলে বিশ্বাস করি না। ৭১ ও ৭৫-এর সব শহীদের আত্মা শান্তি লাভ করুক।
জয় বাংলা।
লেখক : সাংস্কৃতিককর্মী