• ঢাকা
  • বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১, ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৬

‘অসফল’ হরতালেও প্রশ্নবিদ্ধ সরকার!


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২২, ০৮:৪২ পিএম
‘অসফল’ হরতালেও প্রশ্নবিদ্ধ সরকার!

আগে কোনো কর্মসূচি নিয়ে রাস্তায় নামলে আওয়ামী লীগ মার খেতো। মার খেয়ে দলটি ক্ষমতাসীনদের বলত নিপীড়ক-স্বৈরাচার। টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়, স্বাভাবিকভাবেই মার খাচ্ছে না তারা; দিচ্ছে। পুলিশ দিয়ে মার দিচ্ছে, সময়ে-সময়ে নেতাকর্মীদের দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মার দিচ্ছে। আগের সরকারগুলো যে ভাষায় কথা বলত, এখনও সেই ভাষা থেকে গেছে, শুধু বক্তা বদল হয়েছে। বক্তা বদলে আওয়ামী লীগ নেতারা আগের জাতীয় পার্টি-বিএনপির সুরে কথা বলছেন। কথনদৃশ্যগুলো পরিচিত, বক্তা-বদলের ঘটনাও পরিচিত। এ করুণ বাস্তবতা, রাজনীতির।

হরতাল সংস্কৃতির দীর্ঘ বিরতির পর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের ডাকা আধাবেলা হরতালের দিন কাটল সোমবার। বরাবরের মতো এই হরতালও ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলতে পারেনি জনজীবনে। বাম দলগুলোর জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভাবেই হোক আর রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির প্রতি মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া হোক কিংবা সব সওয়া মানুষের নিষ্পৃহ ভাব, যাই হোক না কেন, এই হরতালকেও সফল বলা যাবে না। যদিও সিপিবি সফল দাবি করেছে এ হরতালকে। তবে যে দাবিতে হরতাল হয়েছে, সেই দাবি জনগণের দাবি বলে এটাকে ব্যর্থও বলা যাবে না। মানুষ হরতালের পক্ষে মাঠে না নামলেও দাবিকে আবার উড়িয়ে দেয়নি। এটাকে যৌক্তিকও বলছে অনেকেই। মাঠের প্রভাব গৌণ হয়েছে তাই দাবির ন্যায্যতায়।

সিপিবি এবং বাম গণতান্ত্রিক জোটের কর্মী-সমর্থক হাতেগোনা, জনসমর্থনেরও একই অবস্থা। ফলে ধারণা করা যায়, রাজধানীতে হাজারের মতো মানুষও নামেনি রাস্তায়। মাঠের মানুষের এই সংখ্যার হিসাব দিয়ে তবে কি দাবির ন্যায্যতা নিরূপণ সম্ভব? উত্তরে বলি—না! কারণ দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে মানুষ আদতে সুখে নেই, স্বস্তিতে নেই। গত কিছুদিন ধরে যে বাজার-পরিস্থিতি তাতে মানুষের মনে ক্ষোভ আছে, হতাশা আছে। কিন্তু এই হতাশা কিংবা ক্ষোভ প্রতিবাদে রূপান্তর হচ্ছে না। নাগরিক ভোগান্তির এই অস্বস্তিতে গণজাগরণ ওঠার অবস্থা থাকলেও সেটা হচ্ছে না। বলা যায়—এমনটা আর ঘটবেও না!

মানুষের মধ্যকার পুঞ্জিভূত ক্ষোভ গণজাগরণে রূপান্তরের কারণ হয়তো অনেক। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে কারণ এখন সরকার কিংবা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে মানুষ আস্থায় নিতে পারছে না একদম। নাগরিক বুদ্ধিজীবী নিয়েও আছে মানুষের অবিশ্বাস-সন্দেহ। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে কোনো কাজ হবে না—এমন একটা ধারণা জেঁকে বসেছে সমাজের সর্বত্র। এই ধারণা কেবল সাধারণ মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর ব্যাপ্তি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মাঝেও। ফলে ব্যক্তিগত ক্ষোভ সমষ্টিতে পরিণত হচ্ছে না, সবাই নিজেদের সীমিত রাখছে নিজস্ব গণ্ডিতে।

দ্রব্যমূল্য নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটছে তাতে ধারণা করা হচ্ছিল মানুষ সুযোগ পেলেই রাস্তায় নেমে আসবে। সেটা হয়নি। তুলনামূলক কম দামে নির্দিষ্ট কিছু পরিমাণের নির্দিষ্ট কিছু পণ্য কিনতে টিসিবির ট্রাকের পেছনে যে লাইন পড়েছিল সেই লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের একাংশেরও উপস্থিতি ছিল না সদ্যসমাপ্ত এই হরতালে। যত লোক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ে সরকারের ব্যর্থতায় সরব ছিল, তাদের ক্ষুদ্র অংশও ছিল না এই হরতালে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও ছিলাম না। তবে আমি দ্রব্যমূল্য নিয়ে আমার অস্বস্তির কথা জানিয়েছিলাম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে। হরতালের সমর্থনে মানুষ রাস্তায় নামেনি—এতে কি ন্যায্য দাবি প্রশ্নবিদ্ধ হয়? না—হয় না, কারণ মানুষের মধ্যকার অস্বস্তি চলমান, বলা যায় ক্রমপ্রসারমান। মানুষ সংক্ষুব্ধ ঠিক, তবে প্রতিবাদে প্রবল অনীহা তাদের। এই অনীহা রাজনীতির প্রতি, অনাস্থা সরকারের দায়িত্বশীলদের প্রতি, ক্ষোভ ব্যবসায়ীদের প্রতি।

বামজোটের এই হরতাল পুলিশি হামলার মুখে পড়েছে। এই হামলায় কী লাভ পুলিশের, কী লাভ সরকারের? কতজনই বা ছিল মাঠে যে তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে হবে? এই বলপ্রয়োগে যে বার্তা গেছে সেটা আমাদের গণতন্ত্রের জন্যে অশনি সংকেত। মানুষের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, সরকার নিত্যপণ্যের দাম কমাতে যতটা না আগ্রহী তারচেয়ে বেশি আগ্রহী নাগরিক-মত রুদ্ধ করতে! এখানে অর্জন নেই সরকারের, বরং তাদের অস্থিরতা ও দুর্বলতার প্রকাশ হয়েছে জোরালোভাবে। এই পথে না যেতে পারত সরকার। সরকার বামজোটের নেতাকর্মীদের এই হরতাল পালনের সুযোগ করে দিতে পারত। এতে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারের আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটত।

পুলিশি হামলা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি সরকার, হরতাল নিয়ে রসিকতা করেছেন একাধিক মন্ত্রী। কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ সমমনা দলগুলোকে ‘ভুঁইফোড়’ রাজনৈতিক দল আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “এই হরতালে জনজীবনে কোনো প্রভাব পড়েনি।” হরতাল প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি সিপিবির সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামকে তুলনা করে বলেছেন, “এরচেয়ে হেফাজত ভালো ছিল। তারা (হেফাজত) তো অন্তত মতিঝিলে সমাবেশ করতে পেরেছে। কিন্তু এদের (বামজোট) হরতালকে জনগণ সমর্থন করেনি, জনগণ নির্বিঘ্নে কাজ করছে।” কৃষিমন্ত্রী সিপিবিকে ‘ভুঁইফোড়’ রাজনৈতিক দল বলছেন, অথচ দলটি জনসমর্থন ও নেতাকর্মীর সংখ্যার বিচারে পিছিয়ে থাকলেও আওয়ামী লীগের চাইতেও পুরনো একটি রাজনৈতিক দল। এছাড়া তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, “বাম জোটের হরতালে রাজধানীতে যানজট দেখা গেছে। যারা হরতাল ডেকেছে, তাদের লজ্জা হচ্ছে কি না জানি না। তাদের জন্য বরং আমারই লজ্জা লাগছে যে, হরতালে জনগণ বিন্দুমাত্র সাড়া দেয়নি।” দ্রব্যমূল্য নিয়ে চলমান অস্বস্তিকর সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস, উদ্যোগ ও সহনশীলতা আশা করতে গিয়ে মন্ত্রীদের এই ধরনের বক্তব্যে আশাহত হয়েছি।

মাঠের কর্মসূচিতে দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া ফেলতে না পারলেও বাম গণতান্ত্রিক জোটকে অসফল বলা যাবে না। এই হরতালের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাকে তারা সামনে এনেছে, হামলার মুখে পড়ে সরকারের আন্তরিকতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। কর্মসূচি থেকে বামজোটের লাভের খাতায় কিছু যোগ না হলেও সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই ক্ষতি হয়তো দৃশ্যমান নয়। কিন্তু জনমতের দিক থেকে প্রভাববিস্তারী।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

Link copied!