ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, আমদানি বিধি-নিষেধ এবং আর্থিক খাতের দুর্বলতার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে (সরকারি লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৭ শতাংশ)। সংস্থাটির মতে, গত জানুয়ারির নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হওয়ায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কমে এলেও দৃষ্টিভঙ্গিতে নেতিবাচক ঝুঁকি রয়ে গেছে। এ ছাড়া মুদ্রা ও বিনিময় হার সংস্কারে অগ্রগতি পর্যাপ্ত না হওয়ায় রিজার্ভ আরও কমতে পারে, মূল্যস্ফীতিও আরও বাড়তে পারে এবং তারল্য সংকট ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশেশের আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে রাজস্ব ঘাটতি, সম্ভাব্য আর্থিক দায় ও ঘাটতি নগদীকরণ। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে বর্তমানে চার ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক খাতের ঝুঁকি। ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি বেসরকারি কেনাকাটায় প্রভাব এবং জ্বালানি ও আমদানি উপকরণের ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের এসব মূল্যায়ন উঠে এসেছে ২ এপ্রিল প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট বা বাংলাদেশ উন্নয়ন হালনাগাদ’ প্রতিবেদনে। এতে আরও বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে রেজুলেশন ফ্রেমওয়ার্ক প্রয়োজন। এ জন্য বড় ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণগত মান পর্যালোচনা, খেলাপি ঋণ কমাতে আইনি কাঠামো, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর করপোরেট সুশাসন বাড়ানো ও দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য দ্রুত সংশোধন কর্মসূচির মতো বিধানগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি। বিশ্বব্যাংক মনে করে, বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারে সরকারের বড় বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নে সহায়তার প্রয়োজন। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মন খারাপ করা মূল্যায়ন করা হলেও সংস্থাটি আশাবাদ প্রকাশ করে বলেছে, সঠিক আর্থিক নীতি, বিনিময় হার ও আর্থিক কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়িত হলে মধ্যমেয়াদে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ক্রমশ বাড়তে পারে বলে।
সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা আছে, যা কোভিড-১৯ মহামারি থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি তার শক্তিমত্তা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান, মজুরিও অনেকটা একই জায়গায় আটকে আছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রবৃদ্ধি নিয়ে এই পূর্বাভাস এবং অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করাকে মূলধারার বাইরের অনেক অর্থনীতি বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক অনেকটা শাপের দংশন ও ওঝার ঝাড়ফুকের সঙ্গে তুলনা করছেন। তাদের মতে, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ও নীতি পরিকল্পনা অনুসরণ করেই বাংলাদেশ অর্থনীতির অনেক কিছু প্রণীত হয়েছে, নির্ধারিত হয়েছে। বাংলাদেশ তাতে যত না বেশি উপকৃত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে। বিশ্লেষকদের এই অভিমত নিয়ে আলোচনার আগে আইএমফ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবৃদ্ধিবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা প্রয়োজন।
গত বছরের ৯ অক্টোবর এক পূর্বাভাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সংশোধন করে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনে, যা এর আগে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের হালনাগাদ তথ্যে সংস্থাটির অক্টোবরে করা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাস শূন্য দশমিক ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৩ দশমিক ১ শতাংশ নির্ধারণ করলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলেনি। ২০২৫ সালের জন্যেও সংস্থাটি একই পূর্বাভাস দেয়। অন্যদিকে ১৭ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশিত মুদ্রানীতিতে অর্থনীতিতে চলমান চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য জিডিপি পূর্বাভাস ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছিল। আইএমএফের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার পর বাংলাদেশ ব্যাংকও প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস কমানোর ঘোষণা দেয়।
মূলধারার বাইরের অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বিশ্বব্যাংক তার সর্বশেষ হালানাগাদ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে যেসব মূল্যায়ন করেছে, তার অনেক কিছুর সাথে সহমত পোষণ করার সুযোগ রয়েছে। খেলাপি ঋণ, ব্যাংক ব্যবস্থা, মুদ্রানীতি নিয়েও ভালো ভালো কথা বলা হয়েছে। এসবের অনেক কিছু সত্যি। কিন্তু এসব বাংলাদেশের অনেক পুরোনো সমস্যা। অনেক আগেই সরকারকে স্বপ্রণোদিত হয়ে এসব সমস্যা দূর করা উচিত ছিল। কেননা বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রকৃত অর্থেই নানামাত্রিক সংকটে রয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক যেভাবে ‘হায় হায়’ অবস্থা তুলে ধরছে, অর্থনীতি সম্ভবত একেবারে তেমন অবস্থায় নেই। অযাচিত হস্তক্ষেপ না করলে বাংলাদেশ এই সমস্যা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসবে। কারণ, এসব সংকটের পেছনে সরকারের কিছু ভুল নীতি ও বাংলাদেশের সংখ্যাস্বল্প প্রচণ্ড পুঁজিলোভী মানুষের কার্যকলাপের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক-আইএমফের দীর্ঘদিনের নীতি-পরিকল্পনারও অনেক দায় আছে। যেমন মূল্যস্ফীতি বিষয়ে সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে এবং এতে দরিদ্র মানুষ খুব চাপে থাকবে ইত্যাদি। প্রয়োজনের জায়গায় ক্রমাগত ভতুর্কি তুলে দেওয়ার চাপ দিয়ে, অপ্রয়োজনীয় ভতুর্কির বিষয়ে চুপ থাকলে এবং প্রয়োজনের জায়গায় সংস্কার করতে না বলে সরকারকে বেকাদায় ফেললে মূল্যস্ফীতি তো অবশ্যই বাড়বে। বিশ্বব্যাংক বলছে, খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে রেজুলেশন ফ্রেমওয়ার্ক করতে হবে, বারবার ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কথা বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা এক দশক আগে থেকেই উচ্চকণ্ঠে বলে আসছেন। এখন চারিদিক থেকে শোরগোল জোরদার হওয়ায় বিশ্বব্যাংকও এতে শামিল হয়েছে। আসলে আইএমএফের কাছ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি এবং আরও কিছু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেওয়ার পর থেকে বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীরা (বিশ্বব্যাংক-আইএমফের ভাষায় তারা দাতা সংস্থা) যেভাবে বাংলাদেশকে চেপে ধরেছে, দেদারছে সংস্কারের চাপ দিচ্ছে; তাতে প্রয়োজনীয় অনেক কাজই বাদ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে করে সংকট আরও ঘণীভূত হতে পারে। বিশ্বব্যাংক এখন বাংলাদেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি আরও কঠোর করার পরামর্শ দিয়েছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিত্যপণ্যের শুল্ক আরও কমানোরও কথা বলছে। মুদ্রানীতিতে দুর্বলতা রয়েছে, এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এসব মুদ্রানীতির দুর্বলতা তো অতীতের জাতীয় বাজেট প্রণয়ন ও মুদ্রানীতি প্রণয়নের সময় মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যালয়ে অযাচিতভাবে প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমফ ও ব্যবসায়ীদের সম্মিলিত চাপের মাধ্যমেই প্রণীত হয়েছে। আমদানিতে কম শুল্কের পাশাপাশি ছাড় দিয়েও তো মুনাফাকামী ব্যবসায়ীদের বাগে আনা যাচ্ছে না। এদের বাগে আনার কৌশল নিয়ে বিশ্বব্যাংক কোনো কথা বলছে না।
এদিকে গত বছর আইএমএফ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সঙ্গে এক বৈঠকে জানতে চেয়েছিল, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বারবার নির্ধারণ করতে পারবে কি না। জবাবে বিইআরসি বলেছিল, আইন সংশোধন করা হয়েছে। ফলে কেউ আবেদন করলে তা করার সুযোগ আছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) নিয়েও সংস্থাটি কথা বলেছিল। কিন্তু পরে দেখা যায়, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বারবার নির্ধারণের বিষয়টি কার্যকর হয়েছে। কিন্তু বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয়টি আগের অবস্থাতেই রয়ে গেছে। এমনটাই হওয়ার কথা। কারণ অতীত ইতিহাস বলে, নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর জন্য সুবিধাজনক কোনো বিষয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য বা শক্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বা চাপ সৃষ্টি এসব সংস্থা সন্তর্পণে এড়িয়ে চলে। এর মূল কারণ, উদার বাজারব্যবস্থার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষকতাকারী আন্তর্জাতিক এসব উন্নয়ন সংস্থার মতাদর্শ ও কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীই তো সমাজের গুটিকয় মানুষের স্বজনতোষী এসব শ্রেণি-ই, যাদের কারণে সরকারের নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো চাপের মধ্যে রয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের চাপে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘোষণার পর থেকেই বাংলাদেশে হু হু করে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। কিছুদিন আগেও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয়ের নামে বাড়ানো হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে। আসলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অনুরূপ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরামর্শকদের কথা শুনে নিও-লিবারেল প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়ন করলে পরিণতি এমনটাই হয়। এমনটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অতীতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের প্রয়োজন সংবিধানে বিধৃত নির্দেশনা অনুযায়ী বৈষম্য হ্রাসকারী দেশজ উন্নয়নদর্শন গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। কিন্তু বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এই নীতির ঘোর বিরোধী। বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের চাপ ও ব্যবসায়নির্ভর শাসন ব্যবস্থা পরোক্ষ কর বা ভ্যাট বেশি করাকেই পছন্দ করে। কারণ ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সবাইকেই একই দ্রব্যের ওপর একই হারে অন্যায় ও সবচেয়ে নিকৃষ্ট এই কর দিতে হয়। এতে করের ভিত্তি প্রশস্ত হয়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো চলে; আরো ঋণ দেওয়া যায়, ফেরতও পাওয়া যাবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত এতে যে দেশ ও সমাজে বৈষম্য বাড়ে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ধনী ছাড়া সবাই; তাতে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের কোনো কিছু আসে-যায় না। আর এ জন্যেই বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ অর্থনীতির নানা দিক তুলে ধরলেও কখনো বৈষম্য নিয়ে বিন্দুমাত্র শব্দ করে না। এরা কখনো সরকারকে প্রশ্ন করে না যে বাংলাদেশে ধনী-অতিধনীরা কত আয় করে, আর কত আয়কর দেয়। কোনো দিন প্রশ্ন করে না যে বাংলাদেশে বছরে কত ঘুষ লেনদেন হয়, দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের বছরে কী পরিমাণ কর-শুল্ক দেওয়ার কথা আর কী পরিমাণ আদায়ই বা হয়। কোনো দিন সরকারকে এরা জিজ্ঞেস করে না, বাংলাদেশে বছরে কী পরিমাণ সম্পদ কর আহরিত হওয়ার কথা, আর কী পরিমাণ হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ৫২ বছরে কোনো দিন বিশ্বব্যাংক জিজ্ঞেস করেনি যে, বাংলাদেশে কালোটাকার পরিমাণ কত, আর অর্থ পাচার হয় কত। কোনো দিন এরা বলবে না যে, ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রভুদের প্রায় ২০০ বছর শোষণ, পাকিস্তান উপনিবেশ প্রভুদের ২৪ বছর শোষণ এবং বিশ্ববাজারে মুক্তবাজার বিশ্বায়নের অন্যায্যতার ফলে বিগত ৫০ বছরে আমরা যেভাবে ঠকেছি, তার প্রতিকার কী কিংবা কীভাবে বৈশ্বিক প্লাটফর্মে এসব বিষয় তুলে ধরে বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ-ভূমিকা ও পূর্বাভাস সবকিছুই যে মন্দ, তা নয়। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের স্বদেশজাত উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়ন করতে না পারায় বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের ঋণে আসলে তাদের তেমন কোনো উন্নতি হয় না, উপকার হয় না। তারা ঋণের দুষ্টচক্রেই আটকে থাকে। ফলে খবরদারী করা সহজ হয়। আর এর জন্য বিশ্বব্যাংকের নানা দ্বিচারী ভূমিকা ও কার্যকলাপই দায়ী। অথচ ৮০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক সৃষ্টির মূল লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ দূর করা। কিন্তু বিশ্বে দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ আদৌ কমেছে? ফিলিস্তিনে মানব ইতিহাসে প্রথবারের মতো মনুষ্যসৃষ্ট মতো দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। কিন্তু সংস্থাটি এ নিয়ে এখন পর্যন্ত একটি শব্দ উচ্চারণ করেনি। শুধু বলেছে ২০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ভবিষ্যতে বিপুল পরিমাণ ঋণ লাগবে। বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে সব দেশকে দেওয়া ঋণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলেও ইসরায়েল-সম্পর্কিত কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। এমনকি গত বছর ৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে বিশ্বব্যাংক উগান্ডাকে সমকামিতাবিরোধী আইন পাস করায় প্রতিশ্রুত ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ রকম নানা দ্বিচারী কার্যকলাপের ইতিহাস বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের আছে। অথচ বাংলাদেশেরও বিশ্বব্যাংকে মালিকানা রয়েছে, প্রতিবছর চাঁদা দিয়ে সংস্থাটির তহবিল বৃদ্ধি করে থাকে এবং সংস্থাটির কাছ ঋণ নিলেও আসলসহ বিপুল পরিমাণ সুদসহ পরিশোধ করে। আর সংকটের সময় ঋণ চাইলেই নানা তোড়জোড় শুরু করে, সংস্কার কর্মসূচি চাপিয়ে দেয়।
এখানে উল্লেখ্য, মূলত মার্শাল পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর ইউরোপকে পুনর্বাসনের জন্য যে তহবিল জোগান দেওয়া হয় তার ধরন থেকেই পরে বিদেশি দাতা নামে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীকালে এই বিদেশি সাহায্যকেই একটা লাভজনক বিনিয়োগ ও তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতিতে অতি প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবহার করতে থাকে। এখন বাংলাদেশও এর ভুক্তভোগী।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের মাত্র ৩৩ শতাংশ বা ১৮ দশমিক ১২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নেওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) থেকে। এই পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের অতিধনী কয়েকজন মানুষের নানা উপায়ে উপার্জিত অর্থের কিয়দংশের সমান। কিন্তু বাংলাদেশের বাজেট ঘোষণার আগে সাম্প্রতিক এই প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস সরকারের নীতিপরিকল্পনা প্রণয়নকে নিশ্চিতভাবে প্রভাবিত করবে। প্রবৃদ্ধির বাড়তি রূপ কিংবা নিচে নামার ধরণ বিষয়ে পূর্বাভাস-আভাস দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উপকার হবে না। উপকার হবে সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে দিলে। আর বাংলাদেশের সরকারকে মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের পরামর্শ মেনে প্রবৃদ্ধির পেছনে ছুটে চলা আসলে কখনোই মানুষের উন্নতি নিশ্চিত করতে পারবে না। কারণ এই প্রবৃদ্ধি যদি সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর না করে, মানুষের সুস্থ-দীর্ঘায়ু নিশ্চিত না করে, যদি মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি না ঘটায় এবং যদি প্রবৃদ্ধি বলতে মনমতো বেসরকারীকরণ বোঝায়, নির্বিচার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বোঝায়, বেশি বেশি বিদেশি ঋণ বোঝায়, কৃষকের অন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি বোঝায়, বেকারত্ব বৃদ্ধি বোঝায়; তাহলে ওই প্রবৃদ্ধি দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট কোনো দিন দূর হবে না, বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রও হতে পারবে না।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতি