সবকিছু ছাপিয়ে আজকাল নারীর পোশাক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা জাতীয় ইস্যুতে রূপ নিয়েছে। একুশ শতকে এসেও নারীর পোশাক নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে, এটা ভাবলেও মন বিষিয়ে ওঠে। আসলেই কি পোশাকের মতো এত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা বলার ফুরসত মানুষের আছে? প্রশ্নটা যে অবান্তর, তা নিশ্চয়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যমে খবরের বরাতে দেশের ছেলে-বুড়ো সবাই জানে।
বহির্বিশ্ব যখন পারমাণবিকভাবে শক্তিধর হচ্ছে, মহাকাশে স্টেশন নির্মাণ করছে, মহাকাশ-চন্দ্র অভিযানে ব্যস্ত, সেখানে আমরা পড়ে আছি নারীর পোশাকের কোটরে। নারী কেন ছোট পোশাক পরবে, তার কাটাছেঁড়া করতে। অথচ এই বিষয়টার ওপর জাতির উন্নতি-অবনতি কোনোটাই নির্ভর করে না। তাহলে ডিজিটাল যুগ, আধুনিকতার যুগে এসেও কেন নারীর পোশাক নিয়ে এত বাগ্বিতণ্ডা, এই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছে। কেন পোশাকের জন্য অনেকটাই নারীকে একঘরে করে রাখার মনোভাব পোষণ করা হচ্ছে। কেন নারীর প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হচ্ছে কতিপয় পুরুষ?
পোশাক নিয়ে পুরুষতন্ত্রের বিদ্বেষপরায়ণ মনোভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যখন একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষার্থী ব্যানার-পোস্টার নিয়ে আন্দোলনরত। তাদের ব্যানারে-পোস্টারে নারীর পোশাক নিয়ে অকথ্য ও বাজে মন্তব্য। কেউ নারীর পোশাককে কেন্দ্র করে তার গড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠাকে ফোকাস করেছে, কেউবা পোশাকের জেরে সাধারণ জনগণের প্রতি উৎপাত না করার কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আবার কেউবা এক নারীর ছোট পোশাক, অন্য নারীর নির্যাতনের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। এমন নানা মন্তব্য দিয়ে তাদের পোস্টার-প্ল্যাকার্ড সাজানো। বিষয়টি নারীদের জন্য কতটা অস্বস্তির, তা বোঝার ক্ষমতা বা বিবেক কোনোটাই পুরুষতন্ত্রের আজ্ঞাবহদের নেই। শুধু বিষয়টা অস্বস্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং বিষয়টা আরও গভীরতর।
বিষয়টি স্বাধীনতার। স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার ফলে মানুষের কিছু অধিকার জন্মেছে। তার মধ্যে চলাফেরার অধিকার অন্যতম। একজন ব্যক্তি কীভাবে চলবে, সেটা একান্তই ব্যক্তির রুচি ও মর্জির ওপর নির্ভর করে। তবে সে ক্ষেত্রে কেউ যদি বলে বসে, অপরাধ করেও কি পার পাবে? সেখানে অবশ্যই কোনটা অপরাধ, কোনটা অধিকার, সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার।
পোশাক পরিধান করে ব্যক্তি নিজের স্বাচ্ছন্দ্যে, রুচি-মর্জিতে। সেখানে ব্যক্তির অভিরুচিই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের পোস্টারের বরাতে বোঝা যাচ্ছে, পোশাক অন্যকেও বাধাগ্রস্ত করে। কীভাবে, সে সম্পর্কে ভাবতে হলে হয়তো রামায়ণ রচনা হবে। কিন্তু তাদের মতটুকুরই বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। ‘ছোট পোশাক বিজ্ঞানী বানায় না বরং পণ্য বানায়’। কথাটার সঙ্গে একমত হওয়া তো দূরের কথা, কোনোভাবে আলোচনাযোগ্যও নয়। বরং এই কথাটা হাসির খোরাক জোগায়। এ ক্ষেত্রে পণ্য কীভাবে পোশাকের জেরে হয়? মানুষ কিভাবে পণ্য হতে পারে! শুধু পোশাকের জন্য কি কেউ বিজ্ঞানী-অবিজ্ঞানী হয়? তবে যদি পোশাকই বিজ্ঞানী বানায়, তাহলে তো বলতে হবে, যেসব নারী বিজ্ঞানী রয়েছেন, তাদের ছোট পোশাকেই দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের কাজের কোনোই অসুবিধা হয়নি। বরং সুবিধার কথা বলতে গেলে লিস্ট খানিক লম্বাই হবে।
অথচ বানোয়াট ও মনগড়া মন্তব্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কীভাবে রাস্তায় নামতে পারেন, সেটাও মাথায় আসে না। পোশাকের কথা বলতে গেলে কয়কটি বিষয় অবশ্যই লক্ষণীয়। একেক দেশের সংস্কৃতি একেক রকম। সেই অনুযায়ীই মানুষ পোশাক পরিধান করতে চেষ্টা করে। কিন্তু বর্তমান সময়টা গ্লোবালাইজেশনের। এখন কেউ শুধু নিজের সংস্কৃতির মধ্যেই আবদ্ধ নন। বরং জীবনযাপনের তাগিদে মানুষ নিজের মতো করে জীবনকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে বেশি পছন্দ করেন। সে ক্ষেত্রে ঘর সাজানো থেকে শুরু করে পরিবার-পরিজন এমনকি নিজেকে সুসজ্জিত করতেও। ফলে মানুষের মন একটা জায়গায় আর আবদ্ধ নয়। ফলে বাঙালি রমণীদের শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোটের যুগ এখন অনেকটাই শিথিল। আবার পুরুষের ক্ষেত্রে লুঙ্গি, ধুতি, পায়জামা, পাঞ্জাবির চলও অনেক কমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে যদি পরিস্থিতি বিবেচনা করেন অনেকটাই বোঝা সুবিধা। আগের যুগে নারী, পুরুষের জীবন এতটা যান্ত্রিক ছিল না। বেশির ভাগই ছিলেন কৃষিজীবী। আর নারীরা ছিলেন গৃহিণী।
কালের বির্বতনে পুরুষের সঙ্গে নারীদের অংশগ্রহণও বেড়েছে। ফলে নারী-পুরুষ উভয়েই এখন কর্মজীবী। শুধু বাচ্চা লালন-পালন, সংসারেই নারীরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছেন না। এক্ষেত্রে নারীকে অল্প সময়ে বহু কাজের ঝুঁকি এবং প্রেশার নিতে হচ্ছে। তেমনই পুরুষেরও। তবে পুরুষের ক্ষেত্রে পরিবারের অর্থাৎ সংসারের দায় কয়জন নেন? দিন শেষে বা মাসান্তে গৃহকর্ত্রীর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়েই অধিকাংশ পুরুষ খালাস। ফলে ঘরে-বাইরে নারীকে সমানভাবে দক্ষতার সঙ্গে পুরোটা সামলাতে হয়। আবার যেই নারী গৃহিণী বা কর্মজীবী নন, তিনি হয়তো শিক্ষার্থী। তার জীবনের টানাপড়েন কোনো অংশেই কম নয়। বরং অনেকটা বেশি। ঢাকা শহর থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নারীদের জীবনযাত্রার চিত্র পাল্টাছে। সময়ের সঙ্গে নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের যোগ্য করে তুলেছেন নারীরা। ফলে আগের মতো পোশাকে অনেক নারী এখন আর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। তাদের পোশাকের ধরন কিছুটা ভিন্ন হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সংস্কৃতি ধরে রাখা বা অন্যের মন রক্ষার চেয়ে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য এবং রুচিটা বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।
নারীদের কাজের ক্ষেত্র এত বিস্তৃত হয়েছে যে, পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে তাকে পোশাকের দিকেও নজর দিতে হচ্ছে। কীভাবে অল্প সময়ে ও স্বাচ্ছন্দ্য চলা যায়, নারীকে ভাবতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুরুষ যেমন তার আদিম ভোল পাল্টে সাহেবিয়ানা পোশাকেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে, তেমনি নারীও তার কাজের সুবিধার্থে, জীবনযাপনের সুবিধার্থে, নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে পোশাককে পাল্টেছে। সে ক্ষেত্রে কেউ শাড়ি পছন্দ করছেন, কেউবা সালোয়ার-কামিজ, কেউ টপস, জিন্স, কেউবা বোরকা-হিজাব। এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তির নিজস্ব অভিরুচি।
এখানে পুরুষের ক্ষেত্রে নারীর কখনোই কোনো আপত্তি কোনো দিন ছিল না। আর কোনো দিন হবে বলেও মনে হয় না। যদিও পুরুষেরা শার্ট-প্যান্ট বা টিশার্টে অভ্যস্ত।
পোশাক নিয়ে নারীকে দায়ী করার আগে প্রত্যেকের ভাবা উচিত—এ সম্পর্কে কথা বলার দায় কে তাকে অর্পণ করেছে? আপনাকে কেউ বলেনি যে, কে কী ধরনের পোশাক পরিধান করবেন, তার তদারকি করতে। তার চেয়েও বড় কথা—নারী প্রথমে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ। পরে নারী। ফলে তার নিজের ভালো-মন্দ বোঝার দায় একান্ত তার ব্যক্তিগত। অন্যের ক্ষতি নাহলে তা কোনো অপরাধ নয়। আর পোশাকের ক্ষেত্রে অপরাধের প্রশ্নই ওঠে না। কথা বলার দরকার হলে গুম, ধর্ষণ, খুন, যৌন-হয়রানির মতো বিষয় নিয়ে কথা বলা যেতেই পারে। কিন্তু তার সঙ্গে পোশাকের কোনোই সম্পর্ক নেই। একটি নিতান্ত তুচ্ছ জিনিসকে সামনে এনে সমাজে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা মাত্র।
নারীর পোশাক, নারীর অধিকার সেখানে অন্যের নাক গলানোর কোনোই অধিকার নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীরা আজীবনই বৈষম্যের শিকার, নিপীড়নের শিকার। পুরুষের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে কাজ করাকে একশ্রেণি খুব একটা সাদরে গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে নারীকে দমিয়ে রাখা, অবরুদ্ধ করে নির্যাতন করতে তুচ্ছ একটি ইস্যুকে নিয়ে এত চর্চা চলছে। কিন্তু বর্তমানে নারীরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের অনেক পরিবর্তন করে নিয়েছে। নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে শিখেছে। ফলে নারীর নিজস্ব মতই তার কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। এ ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্রের ঠুনকো সমালোচনায় আজকের নারীরা নিজস্ব রুচিকে জলাঞ্জলি দেবে না। কারণ পোশাকের স্বাধীনতা প্রত্যেক ব্যক্তির আছে। তিনি তার পজিশন, রুচি, ইচ্ছে অনুযায়ীই পরিধান করবেন, এটাই স্বাভাবিক।
যে নিজের কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসে, সে অন্য এক জগৎ আবিষ্কার করে। সে নিজের দৃষ্টি, অনুভূতি ত্যাগ করে। মানুষকে গ্রহণ করে তাদের মতো করে। ফলে নিজের বদ্ধমূল সংস্কার, কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। আসুন আমরা মানুষকে বুঝতে শিখি। মানুষ হিসেবে মানুষকে মূল্যায়ন করা শিখি। নারী বলেই তিনি চার দেয়ালের মাঝে বন্দি থাকবেন, এই ধারণা পরিহার করি। সেই সঙ্গে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করতে শিখি। নারীও মানুষ। তার নিজেরও ইচ্ছে থাকতে পারে, ভালো লাগা থাকতে পারে বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধকে প্রাধান্য দেবেন এটাই স্বাভাবিক। ফলে নারীর পোশাক নিয়ে আর নয় মাথাব্যথা। বরং সমাজের মাঝে গজিয়ে ওঠা অপরাধপ্রবণতাকে কীভাবে রুখে দিয়ে আমাদের সামনের পথচলা হোক। নারীর জীবনযাত্রাকে সহজ করতে পুরুষতন্ত্রের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটুক। সুস্থ সুন্দর সমাজ গড়ে উঠুক।
লেখক : গবেষক ও শিক্ষক