• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর পর হেরে যাবে হামাস?


সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশিত: মে ২২, ২০২৪, ১১:০৩ এএম
প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর পর হেরে যাবে হামাস?

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইয়েদ ইব্রাহিম রাইসি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর নানামুখী আলোচনা চলছে। বহু প্রশ্ন চারদিকে ডালপালা মেলছে। যেমন, রাইসির মৃত্যুর পর ইরান কি পথ হারিয়ে ফেলবে? ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে? ইরান কি মধ্যপ্রাচ্যে তার অবস্থান হারাবে? মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে ইরান যে খানিকটা আগ্রাসী বা জোরালো ভূমিকা রাখছিল, তা কি বন্ধ হয়ে যাবে? মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্ব এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরান সামগ্রিকভাবে যে নীতি অনুসরণ করে আসছিল, তা থেকে কি সরে যাবে? চলমান গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কী হবে? ইরান কি হামাসকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করে দেবে? হামাস কি তাহলে হেরে যাবে? অথবা ইসরায়েল কি এই যুদ্ধে জিতে যাবে? 
শুধু এসব প্রশ্ন না, আরও প্রশ্ন আছে। যেমন, সত্যিই কি প্রেসিডেন্ট রাইসি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে? ইরানি প্রেসিডেন্টের পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা দিতে পারেনি কি ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী? ইরানের প্রেসিডেন্ট কেন এত পুরোনো একটি হেলিকপ্টারে চড়লেন? এই হেলিকপ্টারের নাকি ওড়ার যোগ্যতাই ছিল না? কেন একই সঙ্গে ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক হেলিকপ্টার চড়লেন? তাদের কে হত্যা করল? মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা নাকি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ?

আরও প্রশ্ন উঠেছে, অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন যে মোহাম্মদ মোখবের তিনি কতটা রাইসির শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবেন? তিনি কতটা রাইসির পথ অনুসরণ করবে? রাইসি যতটা বিপ্লবী চেতনার অধিকারী ছিলেন, মোহাম্মদ মোখবের কী তেমনি?
এ রকম নানা প্রশ্নের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে চলমান এই সময়। প্রতিদিন বহু প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে ইরান। অথবা বহু প্রশ্নের মুখোমুখি করা হচ্ছে ইরানকে। 

যাহোক, এই সব প্রশ্নের জবাব তথা মূল আলোচনায় আসা যাক। প্রথম এবং প্রধান যে প্রশ্ন সেটি হচ্ছে- প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর পর কি ইরান পথ হারিয়ে ফেলবে? এ প্রশ্নের জবাবে আমি বলব, না, ইরান পথ হারাবে না। বরং সাহস রাখার যথেষ্ট কারণ আছে এবং গন্তব্যে পৌঁছানোর সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ইরান তার গন্তব্যের একেবারেই দ্বারপ্রান্তে বলা যায়।

কেন পথ হারাবে না? পথ হারাবে না এই কারণে যে ইরান ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল দেশ নয় বরং একটি সুশৃঙ্খল সুবিন্যস্ত শক্তপোক্ত প্রশাসনিক ও সরকারব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি দেশ। শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই দেশের একজন প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাইসি। ধরুন চলমান ক্ষমতার মেয়াদকাল শেষে নতুন নির্বাচনে যদি প্রেসিডেন্ট রাইসি হেরে যেতেন এবং নতুন কোনো প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসতেন, তাহলে কি ইরান পথ হারাবে বলে প্রশ্ন আসত? আসত না। প্রেসিডেন্ট রাইসি যদি বেঁচে থাকতেন এবং সামনে নির্বাচনে হেরে যেতে তাহলে তিনি ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হতেন অর্থাৎ ইরানের প্রশাসনিক কাঠামোয় তার তেমন কোনো ভূমিকা থাকতো না। তারপরও ইরান কিন্তু সামনের দিকে এগিয়ে যেত। রাইসি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন না তখনো ইরান তার পথ পাড়ি দিয়েছে, আবার যখন প্রেসিডেন্ট রাইসি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন তখনো ইরান পথ পাড়ি দেবে। ইরান কোনো ছোট্ট শিশুরাষ্ট্র নয়, ইরান দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম করে, বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে শক্তপোক্ত হয়ে বিপ্লবের পর ৪৫ বছর পেরিয়ে আজকের এই অবস্থানে। তাতে বলা যায়, জটিল রাজনীতির উত্তাল তরঙ্গমালা পেরোনোর দারুণ সব অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে রয়েছে। ফলে ছোট্ট শিশুর মতো সে বনের মাঝে কিংবা পথের মাঝে পথ হারিয়ে ফেলবে না। জটিল, কুটিল এবং বন্ধুর পথ সে পাড়ি দেবে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে? এই প্রশ্ন খানিকটাই অবান্তর। কারণ, প্রেসিডেন্ট রাইসি এমন কোনো অভ্যন্তরীণ টামাটাল বা রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভেতরে নিহত হননি, অথবা দেশে তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড রকমের অসন্তোষ ছিল কিংবা বিদ্রোহ সৃষ্টির অবস্থা ছিল, তা-ও নয়। আগে উল্লেখ করেছি, ইরানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অথবা সরকারব্যবস্থা খুবই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, দেশটিতে টনটনে সংবিধান রয়েছে, নির্বাচনী ব্যবস্থা রয়েছে, নির্বাচিত সংসদ রয়েছে, দেশে কোনো বিক্ষোভ বা গণ-অসন্তোষ নেই, সরকারবিরোধী কোনো গণজোয়ারও নেই। সে ক্ষেত্রে তিনি বা তার অন্য সহচর নিহত হওয়ার কারণে দেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে, এটা ভাবার আসলে কোনো কারণ আমি দেখি না। 

সবচেয়ে যে প্রশ্ন, এখন বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হলো ইরান কি মধ্যপ্রাচ্যে তার অবস্থান হারাবে? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান আজকে যে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে, তা কি শুধু প্রেসিডেন্ট রাইসির আমলে তৈরি হয়েছে? নিশ্চয় নয়। বরং এটি তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিনের চেষ্টা-প্রচেষ্টা এবং কূটনৈতিক উদ্যোগের কারণে। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন উপস্থিতির অবসান, ইসরায়েলের ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করা এবং ইসরায়েলের থেকে আল-আকসা মসজিদসহ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড মুক্ত করার নীতি গ্রহণ করেছে ইরান এবং সেই পথে চলা অব্যাহত রেখেছে। রাইসি শুধু সেই নীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। অবশ্যই এই নীতি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার সরকারের যথেষ্ট জোরালো অবস্থান ছিল; সেটা হয়তো অন্য কোনো সরকারের সময় অতটা জোরালো ছিল না। কিন্তু রাইসির আমলে শুধু এ রকম নীতি গ্রহণ করা হয়নি। এটা অনেক আগে থেকেই অনুসৃত নীতি। ফলে রাইসির নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই নীতি অনুসরণ বন্ধ হয়ে যাবে বা মুখ থুবড়ে পড়বে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অবস্থানও হারাবে না। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান যে জোরালো ভূমিকা রাখছিল তা-ও বন্ধ হবে না। এগুলোর ভিত্তি অনেক গভীরে এবং দীর্ঘদিন এই সমস্ত নীতি এবং চেতনা বাস্তবায়ন করে এসেছে ইরান। এটা যেমন কথিত লিবারেল সরকারের আমলে চালু ছিল, তেমনি রাইসির মতো বিপ্লবের মূল চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রেসিডেন্টের আমলেও অনুসরণ করা হয়েছে। 

মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিম বিশ্বে ইরানের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বহুদিন ধরে এই ভূমিকা পালন করে আসছিল। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে ঐক্য প্রতিষ্ঠা, সংহতি সৃষ্টি এবং ইসরায়েলের কবল থেকে আল-আকসা মসজিদ ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড উদ্ধারের জন্য বিশেষ কর্মপন্থা ও পদ্ধতি অনুসরণ করছিল ইরান। এ জন্য ইরান যেমন অর্থবিত্ত খরচ করেছে, তেমনি বিরাটসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য হামাস, হিজবুল্লাহ, জিহাদ আন্দোলনসহ ইরানের বিভিন্ন প্রতিরোধ সংগঠন ও ইয়েমেনের হুথি আনসারুল্লাহ সংগঠনের মতো বহুসংখ্যক সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। আবারও বলছি, এটি শুধু প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির আমলে হয়েছিল তা-ই নয়, বরং বিপ্লবের পর থেকেই গত ৪৫ বছর ধরে এই নীতি অনুসরণ করে আসা। জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর যেমন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও মার্কিনবিরোধী তৎপরতা বেড়েছে, তেমনি জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর মধ্যপ্রাচ্যে রেজিস্টেন্স ফোর্সগুলোকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে ইরান, এটা সহজেই বলা যায়। একইভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বলদর্পী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে ইরান, রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বে যে বলয় গড়ে উঠেছে তার কার্যক্রমও থেমে থাকবে না বরং তা জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা। পানির স্রোতে যেমন বাধা দিয়ে তার গতি বাড়ানো যায়, তেমনি প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর এই ঘটনা মার্কিনবিরোধী বলয়ের গতি বাড়াবে, সে কথা বলা যায়। 

ইরানের বিপ্লব-পরবর্তী সরকারগুলোর নীতি কখনোই এমন ছিল না যে এক একজন প্রেসিডেন্টের আমলে একেক রকম নীতি গ্রহণ করা হয়েছে বরং তাদের পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। 

চলমান গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কী, এমন প্রশ্নও জেগেছে। ইরান কি হামাসকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করবে? এসব প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, শুধু প্রেসিডেন্ট রাইসির আমলে হামাসকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়নি কিংবা রাইসির সময়কালে হামাস প্রতিষ্ঠা হয়নি। সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে হামাসসহ বিভিন্ন প্রতিরোধকামী সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে এবং তাদের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছে। ফলে রাইসির মৃত্যুর পরেও হামাসকে সমর্থন দেবে ইরান। তার ধারাবাহিকতায় গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ তার পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে। হামাস, হিজবুল্লাহ ও জিহাদ আন্দোলন যে কঠিন ও দীর্ঘ সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছে, তার পেছনে রয়েছে শহিদি চেতনা। যে মানুষের কাছে জীবনের চেয়ে মৃত্যু বেশি কাম্য, তাকে তো মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে লাভ হয় না। তার কাছে দুনিয়ার ক্ষণিকের জীবনের চেয়ে মৃত্যুর পরবর্তী অন্তকালের জীবন অনেক বেশি প্রত্যাশিত। ফলে হামাসকে যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করা খুবই কঠিন কাজ হবে, গত সাত মাসের যুদ্ধে সেটি পরিষ্কার। বরং হামাস যেকোনো সময় চূড়ান্তভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড মুক্তির লড়াই শুরু করতে পারে, এমন সম্ভাবনা প্রবল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইসরায়েল এই যুদ্ধে জিতে যাবে, এটা বলাও কঠিন। 

প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুকে ঘিরে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তিনি কি সত্যিই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন, নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে? যে দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি সেই দেশের পক্ষ থেকে এখনো বলা হচ্ছে প্রচণ্ড দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের পার্বত্যাঞ্চলে ঘন-জঙ্গলের মধ্যে তার হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়। যেখানে ইরান কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি একটি দুর্ঘটনা‌, সেখানে আমার আপনার দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা হিসেবে না দেখে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং হত্যাকাণ্ড বলে দেখার সুযোগ নেই। 

পুরোনো হেলিকপ্টার বলে সেই হেলিকপ্টারে চড়া যাবে না, এমন চিন্তাও সম্ভবত ঠিক নয়। যেকোনো বিমান এবং হেলিকপ্টার উড্ডয়নের আগে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। ইরান এমন কোনো গরিব দেশ নয় যে, তার প্রেসিডেন্টের চলার জন্য একটি নতুন হেলিকপ্টার কিনতে পারবে না। নিষেধাজ্ঞার কারণে আমেরিকা থেকে হয়তো আধুনিক মডেলের হেলিকপ্টার কিনতে পারেনি কিন্তু রাশিয়ার কাছ থেকে যে নতুন হেলিকপ্টার কেনেনি, তা তো নয়। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে এমন কথা বলেছেন যে এই হেলিকপ্টারের নাকি ওড়ার যোগ্যতাই ছিল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করিনি ইরানকে নিতান্তই গরিব রাষ্ট্র এবং একেবারে ক্ষমতাহীন দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য এই সব কথা বলা হচ্ছে। এটি ইরানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলে মনে করি। তারা হয়তো দেখাতে চায়, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইরানকে তারা একেবারে কাবু করে ফেলেছে। যেখানে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচিসহ সব খাতে এত উন্নয়ন করেছে, সেখানে প্রেসিডেন্টের চলার জন্য একটা ভালো হেলিকপ্টার কিনতে পারবে না, এটা মোটেই যুক্তিসংগত কথা নয়। এমনও তো হতে পারে, অধিক নিরাপদ হেলিকপ্টারেই উঠেছিলেন দেশের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তারপরও তা বিধ্বস্ত হয়েছে। ধরে নিই, যদি আমেরিকার প্রযুক্তি সবচেয়ে ভালো হয়, তারপরও কি মার্কিন নির্মিত একেবারে নতুন মডেলের বিমান বা হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয় না? হয়। তাহলে? আসলে এসব কথা বলা হচ্ছে অন্তত দুটি কারণে। একটি হচ্ছে, যারা ইরানকে এবং প্রেসিডেন্ট রাইসিকে ভালোবাসেন, তারা এই মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না, তারাই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খুঁজছেন। অন্যটি হচ্ছে, ইরানবিরোধী শক্তি এই মুহূর্তে ইরানকে দুর্বল হিসেবে দেখাতে চায় এবং নিজেদের অতিমাত্রায় শক্তিশালী ও প্রযুক্তিতে উন্নত দেখাতে চায়। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত কি না, তা সময় বলে দেবে। চূড়ান্তভাবে তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত সে কথা বলা যাবে না। মধ্যপ্রাচ্য যেহেতু চরম উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থার মধ্যে রয়েছে এবং সম্প্রতি সীমিত পরিসরে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সামরিক সংঘাত হয়েছে, সে কারণে অনেকেই প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর সঙ্গে মার্কিন কিংবা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার জড়িত থাকা বিষয়টি ভাবতে পছন্দ করছেন। 

এমনিতর হাজারও প্রশ্নের চিন্তা যাদের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে, তারা অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবেরের যোগ্যতা, নীতি আদর্শ ও চিন্তাচেতনা নিয়েও ভাবছেন। তাদের মনে শঙ্কা, যদি ইরানের এই ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মতো বিচক্ষণ ও দৃঢ়চেতা না হন! একটা কথা পরিষ্কার, ইরানের সংবিধান যেহেতু বলছে প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হলে অথবা তিনি অপসারিত হলে বা দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তী দায়িত্ব পালন করবেন সে কারণে প্রেসিডেন্টের রানিংমেট তথা ভাইস প্রেসিডেন্টকেও সেই রকম যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হয়, সেভাবে বাছাই করা হয়। রাইসি ছিলেন যেহেতু অত্যন্ত বিপ্লবী চেতনার প্রেসিডেন্ট, সে ক্ষেত্রে তার ভাইস প্রেসিডেন্টও তারই মত ও পথের অনুসারী হবেন, সেটা স্বাভাবিক। ফলে মোহাম্মদ মোখবেরের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, মেধা ও চেতনা নিয়ে প্রশ্ন তোলার খুব একটা যৌক্তিক কারণ নেই। তেমনি এ কথা ভাবারও প্রশ্ন নেই যে চলমান পরিস্থিতিতে ইরান পথ হারাবে। বরং যা কিছু চলছিল তার সবই নিজস্ব গতিতে চলবে। সবকিছুই ঠিকঠাক এগিয়ে যাবে; কিছুই থেমে থাকবে না।
 

লেখক: সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক।

 

 

 

Link copied!