যত দূর জানি, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিড়াল’ গল্পটি পাঠ্য। এ ছাড়া মাধ্যমিক স্তরে শরৎচন্দ্রের ‘অতিথির স্মৃতি’ গল্প পাঠ্য ছিল দীর্ঘদিন। শিক্ষার্থীরা কি শুধুই সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখে এ প্লাস পাবার জন্য এ গল্পগুলো পড়ে? গল্পগুলো পড়তে পড়তে অবোধ প্রাণীদের প্রতি এতটুকু মায়াদয়াও কি তাদের মনে জাগে না? জানি না, শিক্ষকেরা তাদের কীভাবে এ গল্পগুলো পড়ান। সেই শিক্ষকদেরও প্রাণীদের প্রতি মনোভাব কেমন? প্রশ্নগুলো মনে এলো, কারণ, কত অবলীলায় অবুঝ প্রাণীদের হত্যা করার উদ্যোগ নেয় লোকে, সেসব দেখে শুনে।
একটা ছোট্ট বিড়াল বা কুকুর আপনাদের কী এমন ক্ষতি করে বলেন তো, এভাবে আঘাত করে ফেলতে পারেন? সমাজে এত অন্যায় অনাচার ঘটে কই, তখন তো সবই মুখ বুঝে সহ্য করেন। একটা বিড়াল যে কিছুই করেনি, শুধু চুপ করে বসে রইলো, তাকে হত্যা করতে চান? কুকুর বা বিড়াল ওরা চুরি ডাকাতি কী তা বোঝে। ওদেরও আপনাদের মতোই ক্ষুধা পায়। নিয়মিত রোজা রেখে আশা করি, ক্ষুধার কষ্ট আপনারা উপলব্ধি করতে পারছেন! এ ক্ষুধা শুধু গরিব দুঃখী মানুষেরই নয়, জগতের সকল প্রাণীর বেলাতেই একই রকম। পৃথিবীটা শুধু মানুষের একার জায়গা নয়। প্রাণীরা যদি ভালো না থাকে, পাখিরা যদি ভালো না থাকে, গাছগুলো যদি ভালো না থাকে, একটা জলাশয়ও যদি না থাকে, আপনিও ভালো থাকতে পারবেন না। এমন উৎকট প্রকৃতিবিরুদ্ধ নগর তৈরি করে পাখি, প্রাণী, বৃক্ষদের মানুষ বিপদে ফেলেছে। তাই ওদের সব দায়িত্ব মানুষকে নিতে হবে। আশরাফুল মাখলুকাত তো সেই হতে পারে, জগতের সকল প্রাণীর সুখ কামনা করে, তাদের সুখের জন্য কাজ করে। কোন উদ্ভিদের গায়ে সে একটা আঁচড়ও কাটে না।
অবুঝ প্রাণীদের দায়িত্ব কেউ নিলেও রক্ষা নেই। মানবদরদিরা এসে সংলাপ দিয়ে যায়, ‘কত মানুষ না খেয়ে থাকে, আবার কুকুর বিড়াল!’ একই নগরে, একই রাষ্ট্রে মানুষ কেন না খেয়ে থাকে, কেন মানুষে মানুষে এত বৈষম্য মানব দরদীরা কি সেসব নিয়ে কখনো ভেবেছেন? মানুষের বৈষম্য নিরসনে স্থায়ী কোন পদক্ষেপ কি তারা কখনো নিয়েছে, নাকি রমজানে একবেলা ইফতার আর প্রতি শীতকালে কম্বল বিতরণ করেই তাদের দায়িত্ব সেরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে? তার চেয়ে বরং পথের সেই ভিক্ষুকটি আপনাদের চেয়ে বেশি প্রাণবিক, বেশি মানবিক। একটা কুকুরকে নিজ ভাগ্যের সাথে তুলনা করে, নিজের সামান্য খাবারটুকুই প্রতিদিন সে ভাগ করে খেতে জানে।
একটা নিরপরাধ বিড়ালকে চুরির অপবাদ দিয়ে যারা হত্যা করতে পারে, তাদের পক্ষে মানুষ খুন করাও সম্ভব। একটা বিড়াল চুরি কী, তা জানে না, তার ক্ষিদে পায়, তাই সে খাবারটা খায়। ওই খাবারে তার অধিকার রয়েছে। তা ছাড়া একটা বিড়াল কতটুকুই বা খেতে পারে? কয়েক হাজার বিলিয়ন ডলার যারা চুরি করে, তাদের সামনে গিয়ে তো উল্টো আপনারাই মিউ মিউ করেন! আর সেই পাপের বদলা নিতে কুকুর বিড়াল হত্যা করেন। কারণ, আপনারা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। আপনারা জানেন, এইসব অবুঝ প্রাণীদের হত্যা করলে কোন বিচার হবে না, শাস্তি হবে না। তাই আজ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, কখনো সড়ক দুর্ঘটনায়, কখনো মাদকাসক্ত ছিনতাইকারীর হাতে, কখনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভুল চিকিৎসায় বেঘোরে মারা পড়ছেন। আবার কখনো সড়কের ধুলাবালি আর সিসার বিষক্রিয়ায় অকালে মারা যাচ্ছেন। আপনাদের খুনেরও কিন্তু কোন বিচার হচ্ছে না। এটাকেই বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ।
যে সমাজ একটি বিড়ালের জন্য, একটি কুকুরের জন্য, একটি পাখির জন্য, একটি বৃক্ষ জন্য নিরাপদ নয়, সে সমাজ, সে রাষ্ট্র একটি শিশু, একজন নারী, একজন বৃদ্ধ, একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি এবং একজন নাগরিকের জন্যেও নিরাপদ নয়।
লেখক : শিক্ষক ও লেখক