• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মৃত্যু নয়, জীবনই মহীয়ান


তানিয়া কামরুন নাহার
প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২৪, ০১:৩০ পিএম
মৃত্যু নয়, জীবনই মহীয়ান

সাম্প্রতিক সময়ে এত কিছু ঘটেছে যে সব কিছুর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মাত্র একটি লেখাতেই দেওয়া সম্ভব নয়। তারপরেও ঝুঁকি নিয়ে শেষ পর্যন্ত কলম ধরতে হয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে নৈরাজ্য চলাকালে রাষ্ট্রীয় সম্পদে আগুন লাগিয়ে সব পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিলো। অগ্নিকাণ্ডের সময় প্রতিটি স্পটে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি গিয়েছে। কিন্তু আগুন নেভাতে দেওয়া হয়নি। ফায়ার ফাইটারদের পিটিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এসব ধংসযজ্ঞের দায় তো সাধারণ শিক্ষার্থীদের নয়।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেরাও এখন বিপর্যস্ত, তাই তারা এখন আবেগে, রাগে ক্ষোভে ভুল স্লোগানের মতো অনেক কথাই বলতে পারেন। তাই এ মুহূর্তে যে যাই বলুক, তাতে কোনো তীব্র প্রতিক্রিয়া যেন কেউ না দেখাই। কেউই ঠিক স্বাভাবিক মানসিকতায় এখন নেই।

আন্দোলন যখন আর স্বাভাবিক ছিলো না, সুযোগ সন্ধানীদের অনুপ্রবেশ ঘটবে, ঘটছে—এটা আগে থেকে টের পেলেও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় কেন বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? এত অরক্ষিত ছিলো কেন এসব? এসব প্রশ্নও চলে আসে। কেউ কেউ বলছেন, এক মতিউর বা দুর্নীতিবাজ পিএসসি কর্মকর্তাদের অবৈধ আয়ের অংশ দিয়েই হয়তো ওসব ঠিক করে ফেলা যাবে। তারপরেও ধ্বংস সমর্থনযোগ্য নয়। জানি না, এত ধ্বংসে কাদের এত আনন্দ হচ্ছে!

আর মানুষ তো ফেরত পাবোই না। সাধারণ শিক্ষার্থী হোক বা পুলিশ হোক কিংবা ওই যে কাজের জন্য পথে বেরিয়েছিল, যে মানুষটা... যে আসলে জানেই না, কোটা সংস্কার কী কিংবা কেন। তবুও প্রাণ হারালো। আর কি তারা ফিরে আসবে? স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কবে পাবো আমরা?

জীবনের মূল্য কি আসলেই আমরা বুঝি? কোটা সংস্কার নিশ্চয়ই নিজের জীবনের চেয়ে মূল্যবান নয়। তবুও শিক্ষার্থীরা যেন জীবনবাজি রেখেছেন। অথচ মৃত্যু নয়, জীবনই মহীয়ান। সব সময় এত বেশি মৃত্যুর মহিমা নিয়ে চর্চা হয় যে জীবনের মূল্যটাও ঠিকমতো এখন আর কেউ বুঝতে চায় না। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গুলি গ্রহণ করতে পারে যে তাকেই সবাই বীরের মর্যাদা দেন। কিন্তু নিজের নিরাপত্তা বুঝতে পেরে যে দূরে চলে গেলো, নিজের জীবন রক্ষা করলো গুলি থেকে, সে কি কাপুরুষ হয়ে গেলো? সক্রেটিসের হেমলক পানের উদাহরণ সকলে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেন। অথচ মহানবী (স.), তিনি কিন্তু ঠিকই লুকিয়ে মদিনায় চলে গেলেন। তাতেই কি তিনি কাপুরুষ হয়ে গেলেন? কিংবা আইনস্টাইনও আমেরিকার আশ্রয়প্রার্থী হলেন। অথচ তারাও কিন্তু বুক চিতিয়ে মৃত্যুকে গ্রহণ করতে পারতেন। আমরাও তাহলে তাঁদের সাহসিকতার প্রশংসা করে বীরপূজা করতাম। কিন্তু তাতে পৃথিবী কি আজ একজন মহানবী (স.) পেতো? আইনস্টাইনকে পেতো? তাঁরা কিন্তু নিজ দেশ কাল সব ছাপিয়ে বিশ্বমানব, সব যুগের মানুষেই পরিণত হয়েছেন। বেঁচে ছিলেন বলেই তা সম্ভব হয়েছে।

‘স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না’ জাতীয় মৃত্যুকে বরণ করানোর ফিলসফি কেন স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও দেখতে হবে? শহীদ রুমি যুদ্ধে গিয়েছিলেন, স্বাধীন একটি দেশে তার মতো বয়সের তরুণদের জীবন নিশ্চিত করতে, এই তরুণেরা যেন অকালে না মারা যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হলো?

আবু সাইদের ঘটনার পর অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা মৃত্যুকে বরণ করার জন্য বেপরোয়া হয়ে গেলো। আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কারের জন্য এত বেপরোয়া হলো কেন? কোটা কি জীবনের চেয়েও মূল্যবান? কেউ একজন ছিলো না, তাদের নিরাপদে দূরে সরে থাকার পরামর্শ দেওয়ার। অবশ্য নিরাপত্তা কাকে বলে, বলবেন? নিজের ঘরেও কিন্তু নিরাপত্তা ছিলো না। পত্রিকায় দেখেছি, নিজ ঘরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে একাধিক শিশু। দিগ্বিদিক এত গোলাগুলির কারণ কী?

আমরা তো দেখেছি, টিয়ার শেলগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ছিলো। তাছাড়া আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও যথেষ্ট প্রশিক্ষিত ছিলো? অত্যন্ত জরুরি হলেই কেবল গুলি ছোঁড়া যায়। ধারণা করছি পরিস্থিতি জরুরিই ছিলো। জরুরি হলেও গুলি করা যেতে পারে অবশ্যই কোমরের নিচের অংশে, পায়ে; তা সে যত কুখ্যাত অপরাধীই হোক না কেন। তাহলে এত কাছ থেকে কেন বুক মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হলো? 

নাকি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রাবার বুলেটে মানুষ মারা যেতে পারে, দেহের কোন অংশে গুলি করা যেতে পারে, কীভাবে টিয়ার শেল ছুঁড়তে হয়—এসব নিয়ে প্রশিক্ষিত ছিলেন না?

মাঝে মাঝে ভাবি, বাংলাদেশ কীভাবে কীভাবে যেন প্রায় সব সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়গুলো এখানে এসে হালকা হয়ে যায়। আশেপাশে ভূমিকম্প হলেও এখানে এখনো ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেনি। এমন কি করোনাও এসেছে দুর্বল হয়ে। অথচ পাশের দেশেও মহামারিতে রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে ছিলো।

তবে সড়ক দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, খুন খারাপির মাধ্যমে সব ব্যালেন্স হয়ে যাচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল আয়ু কমাচ্ছে। বায়ু দূষণের ফলে দেশের ৩ কোটি শিশুর রক্তে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত সিসা। নিতান্ত শিশুরাও ডান্ডি নামক নেশায় আসক্ত। এছাড়াও আছে  কিশোর অপরাধী, ইয়াবা, এলএসডি, আইস! আমাদের নিজ হাতে বানানো বড় বড় দুর্যোগ। কোটা সংস্কারের মতো, এগুলো নিয়েও মানুষ জেগে উঠুক। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কবে জাগবে মানুষ? কোটা সংস্কারের মেধাবী আন্দোলনকারীরা কি পারবে, ভবিষ্যতে তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র ঠিক একইভাবে দুর্নীতিমুক্ত রাখার চ্যালেঞ্জ নিতে? যদি পারে, তাহলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আজ পুড়ে গেলেও দুঃখ থাকবে না।

লেখক : শিক্ষক ও লেখক

Link copied!